যে কারণে আমেরিকার মধ্যবর্তী নির্বাচন বর্তমান বিশ্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ
আমেরিকায় আর কয়েক ঘণ্টা পরেই মধ্যবর্তী নির্বাচন শুরু হতে যাচ্ছে। মার্কিন রাজনীতির দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্রেট ও রিপাবলিকান- দু'দলই মাঠে নেমেছে জোরেশোরে। গতকালকের খবর, এক রাজ্যেই প্রচারে তিন নেতা। পেনসিলভানিয়া রাজ্যে গতকাল প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, বারাক ওবামা এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দেখা গেছে ভিন্ন ভিন্ন জনসংযোগে। সিনেটের ১০০টি আসনের মধ্যে বর্তমানে রিপাবলিকানদের নিয়ন্ত্রণে আছে ৫০টি আসন, আর ডেমোক্রেটদের নিয়ন্ত্রণে আছে সরাসরি ৪৮টি, দুটি স্বতন্ত্র- তবে তারা মূলত ডেমোক্রেটিক পার্টিকেই সমর্থন করেন। সেই হিসেবে দুই দলই সমানে সমান।
আগামী ২৪ ঘণ্টা পরেই হয়তো ফলাফল জানা যাবে। মার্কিন সংবিধান অনুসারে প্রতি দুই বছর অন্তর তাদের কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, সঙ্গে থাকে সিনেটের এক-তৃতীয়াংশ সদস্যের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার ফলে নতুন নির্বাচন। সেই অনুযায়ী এবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিনিধি পরিষদের ৪৩৫টি আসন ও সিনেটের ৩৫টি আসনের নির্বাচন হতে যাচ্ছে।
প্রতিনিধি পরিষদের ৪৩৫টি আসনের মধ্যে ২২০টি ডেমোক্রেটিক ও ২১২টি আসন রিপাবলিকান পার্টির দখলে। ডোনাল্ড ট্রাম্পকে খুব অল্প ভোটে পরাজিত করে ডেমোক্রেট দলীয় জো বাইডেন জয়লাভ করে ক্ষমতায় এসেছিল। তারও আগের নির্বাচনে হিলারিকে পরাজিত করে যখন ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়লাভ করেছিল তখন ট্রাম্পের পক্ষে রাশিয়ার পুতিনের পরোক্ষ সমর্থন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারসাজির মাধ্যমে ভোটারদের প্রভাবিত করে হিলারিকে পরাজিত করা হয়েছে বলে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পরে আশঙ্কা ছিল যে, বাইডেন রাশিয়ার উপরে একটি প্রতিশোধ নেবে। সেই আশঙ্কাই বাস্তবে রূপ নিয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেনের সঙ্গে সংঘর্ষে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সমর্থনেই ইউক্রেনের মতো দেশের দীর্ঘস্থায়ী এই যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে।
ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের ফলে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ গভীর সংকটে পড়েছে। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন উচ্চ মুদ্রাস্ফীতিসহ নানা সংকটে জর্জরিত। এবারের নির্বাচনের আগে মার্কিন ফেডারেল সুপ্রিম কোর্টের এক রায়ের বিপক্ষে ব্যাপক জনমতের প্রতিফলন দেখা গিয়েছে। ৩৮ বছর আগে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ফলে নারীদের সন্তান ধারণের অধিকার নারীর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু রিপাবলিকান দলের নিয়ন্ত্রিত সুপ্রিম কোর্ট সেই সিদ্ধান্ত পাল্টে দিয়ে নারীর গর্ভপাত বিরোধী একটি রায় প্রদান করেন। এই আইনের ফলে নারীদের একটি বিরাট অংশ উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়ে।
বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নারীরা প্রায় সবাই কর্মজীবী। কর্মজীবী নারীদের পক্ষে সন্তান ধারণ করা, লালন পালন করা একটি কঠিন বিষয়। সেই কারণে নারীরা সবসময় সন্তান ধারণ করতে প্রস্তুত থাকে না। পৃথিবীর অনেক দেশে এখন জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধি নিম্নমুখী। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিষয়টি আলাদা। রিপাবলিকানরা বিশ্বাস করেন খ্রিস্টান ধর্ম অনুসারে গর্ভপাত একেবারেই নিষিদ্ধ, সেই কারণে গর্ভপাত নিষিদ্ধ করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রিপাবলিকানরা দীর্ঘদিন ধরেই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। তারা সর্বশেষ আদালতের সহায়তা পেয়েছে।
গর্ভপাতের বিষয়টিকে নিয়ে ডেমোক্রেটরা এবারের নির্বাচনে বড় ইস্যু করতে চায়। গত পরশু এক জনসংযোগে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ভোটারদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হলে মার্কিনিদের গর্ভপাতের অধিকার ও স্বাস্থ্যবীমার সুবিধা ক্ষুণ্ণ হতে পারে। যদিও মার্কিনিদের মনোযোগ এখন অনেক বেশি ইউক্রেন-রাশিয়ার চলমান যুদ্ধ, আর্থিক সংকট, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির দিকে।
এই নির্বাচনে আশঙ্কা করা হচ্ছে ডেমোক্রেটিক পার্টি হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টেটিভসে তাদের নিয়ন্ত্রণ হারাবে এমনকি সিনেটেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারাতে পারে। অতীত ইতিহাসে দেখা গেছে, প্রেসিডেন্টের বিরোধী দল হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভসও সিনেটের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে তেমনই হতে যাচ্ছে বলে অনেক পূর্বাভাস রয়েছে।
মার্কিন রাজনীতিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়। কিন্তু এই মধ্যবর্তী নির্বাচনের গুরুত্ব অন্যখানে। এই নির্বাচনের মাধ্যমে ভোটারদের মার্কিন প্রশাসনের চলমান বিভিন্ন নীতি-কৌশল, অর্থনৈতিক কর্মসূচী সমূহ, বিদেশনীতি, বৈশ্বিক বাণিজ্য ও সর্বোপরি প্রেসিডেন্টের প্রতি আস্থা ও অনাস্থার মতামতের চিত্র হিসেবে দেখা হয়।
সেদিক বিবেচনায় এই নির্বাচনের ফলাফলের উপর বাইডেন প্রশাসন যে কায়দায় ন্যাটোর সম্প্রসারণ নীতি অব্যাহত রেখে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ জিইয়ে রেখেছে তা অব্যাহত রাখবে নাকি সরে আসতে বাধ্য হবে- তা নির্ভর করছে। রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখন বিশ্বের নানান অংশে যে সমস্ত উত্তেজনা হয়েছে তা কখনো যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়নি, বরঞ্চ বলা যায়, ভিয়েতনামের মতই আফগানিস্তান থেকে মার্কিনীরা সরে এসেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প অনুধাবন করেছিলেন, আফগানিস্তানে তাদের আর কিছু করার নেই। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে আফগানিস্তান দখল করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগান মাটির নিচে লুকায়িত বিভিন্ন খনিজ পদার্থের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। যেখানে এখন ইরান একচেটিয়া কর্তৃত্ব করছে।
বিশ্বের তাবৎ মানুষ এই মুহূর্তে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ বন্ধের পক্ষে, কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এই যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার দুটো কারণ, একটি হচ্ছে, পৃথিবীর অন্য প্রান্তগুলোতেও অস্ত্র সরবরাহ বাড়িয়ে দেওয়া। যার মধ্যদিয়ে তাদের অর্থনীতিতে গতি আনার চেষ্টা করা এবং অন্যটি হলো, এই মুহূর্তে বহু টাকার অস্ত্র ইউক্রেনকে যোগান দেওয়া হয়েছে যা ইউক্রেনের ঋণ হিসেবেই গণ্য হবে। সে কারণেই বাইডেনের এই মধ্যবর্তী নির্বাচনে পরাজয় হলে হয়ত ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের একটি পরিসমাপ্তি হলে হতেও পারে।