প্লাস্টিকের বিস্তার চরমে: ৬০০ মিটার এলাকা থেকে আধঘণ্টায় পাওয়া গেল ৬৫ কেজি প্লাস্টিক
নীল বঙ্গোপসাগরের বুকে অপরূপ সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ দ্বীপ সেন্ট মার্টিন। কক্সবাজারের টেকনাফের মূল ভূখণ্ড শাহপরীর দ্বীপ থেকে ১৮ কিলোমিটার দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের মধ্যে প্রায় আট বর্গকিলোমিটার আয়তনের প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্ট মার্টিন। সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের ঐশ্বর্য্য, জীবনের বিচিত্র রংয়ের বর্ণচ্ছটায় দ্বীপটি হার মানাবে যেকোনো স্থানের সৌন্দর্যকে।
কিন্তু মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ হারিয়ে ফেলছে তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, মোহনীয়তা, এমনকি বর্ণিল জীববৈচিত্র্যও। মানুষের চাপে ক্রমশ ফিকে হচ্ছে প্রবালদ্বীপটির রূপ। আর বর্তমানে প্লাস্টিক দূষণ এই দ্বীপের অন্যতম প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অতিরিক্ত দর্শনার্থীদের চাপে ক্রমশ বাড়ছে এখানকার প্লাস্টিক দূষণের মাত্রা। অপচনশীল প্লাস্টিকের পরিত্যক্ত বোতল, একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক, চিপসের প্যাকেটসহ বিভিন্ন জিনিস ফেলা হচ্ছে এই দ্বীপে যত্রতত্র।
সেন্ট মার্টিনের প্লাস্টিক দূষণের মাত্রা যে কতটা ভয়াবহ তা নিরূপণ করতে গত ১৬ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ফিরোজ জামানের তত্ত্বাবধানে এবং একই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. আমিনুল ইসলাম ও প্রভাষক মো. ফজলে রাব্বীর তত্ত্বাবধানে বিভাগটির ৭৬ জন শিক্ষার্থী এস্ব পরিত্যাক্ত প্লাস্টিক সংগ্রহের কাজে অংশ নেন। সেন্ট মার্টিনের উত্তর-পশ্চিম অংশে আধঘণ্টায় ৬০০ মিটার এলাকায় পরিত্যক্ত প্লাস্টিক সংগ্রহ করা হয়। আর এই ৩০ মিনিটে ৬৫ কেজি প্লাস্টিক সংগ্রহ করা হয়।
সংগ্রহ করা প্লাস্টিকের মধ্যে একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক সামগ্রী, প্লাস্টিক বোতল, চিপসের প্যাকেট, বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য ও নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রীর প্যাকেট, পলিথিন ছিল অন্যতম। প্লাস্টিক বোতল ও একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক সামগ্রী ছিল শতকরা ৯০ শতাংশ। সংগৃহীত প্লাস্টিকগুলো সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান ও ইউএনডিপির সহযোগিতায় টেকনাফে পাঠানো হয় রিসাইকেল কাজে ব্যবহারের জন্য।
প্লাস্টিক আবিষ্কৃত হয় ১৮৮৫ সালে। এরপর থেকেই ক্রমাগত এর ব্যবহার বেড়েছে। এর খুব সামান্যই রিসাইকেল হয়েছে। আর বড় একটি অংশ গিয়ে মিশেছে সমুদ্রে। ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে বিজ্ঞান জার্নাল 'সায়েন্স অ্যাডভান্সেস'-এ প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, সমুদ্রে নদীবাহিত প্লাস্টিক দূষণে শীর্ষ দশ দেশের নয়টিই এশিয়ার। এবং বাংলাদেশের স্থান এখানে নবম।
ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা দিয়ে যেসব নদী প্রবাহিত হয়েছে, সেখানে এই প্রভাব আরও সুদূরপ্রসারী। বছরে ২৫ হাজার টন প্লাস্টিক বাংলাদেশের বিভিন্ন নদনদী হয়ে সমুদ্রে গিয়ে পড়ে, যা রীতিমতো উদ্বেগের বিষয়। আর এখানে ম্যাক্রো-প্লাস্টিকের চেয়েএ ভয়াবহ মাইক্রো-প্লাস্টিক ও ন্যানো-প্লাস্টিক। এগুলো খাদ্যের সঙ্গে প্রবেশ করছে জলজ প্রাণীর দেহে এবং শেষ পর্যন্ত ফিরে আসছে খাদ্যের মাধ্যমে মানব দেহে, অর্থাৎ খাদ্যশৃঙ্খলে এটি মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। ক্লোরিনযুক্ত প্লাস্টিক বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ ভূপৃষ্ঠীয় ও ভূগর্ভস্থ পানির সাথে মিশে যায়। এরপর এটি পানিচক্রের সঙ্গে আমাদের খাদ্যচক্রে ঢুকে পড়ে। আর এভাবেই পানি গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিনিয়ত আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, সেন্ট মার্টিন্স একসময় বিপুল জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ ছিল। এখনও তার কিছু অংশ টিকে আছে। এখানে ৪০ প্রজাতির প্রবাল, ১৫১ প্রজাতির শৈবাল, ১৯১ প্রজাতির মোলাস্ট বা কড়ি-জাতীয় প্রাণী, ৪০ প্রজাতির কাঁকড়া, ২৩৪ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, পাঁচ প্রজাতির ডলফিন, চার প্রজাতির উভচর প্রাণী, ২৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ১২০ প্রজাতির পাখি, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ১৭৫ প্রজাতির উদ্ভিদ, দুই প্রজাতির বাদুড়সহ নানা প্রজাতির প্রাণীর বসবাস ছিল এককালে। এছাড়া এই দ্বীপ বিপন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক কাছিমের প্রজননের স্থান। জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ১৯৯৯ সালে সেন্ট মার্টিন দ্বীপকে 'পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা' ঘোষণা করে সরকার।
কিন্তু বর্তমানে কী অবস্থা এই দ্বীপের? আন্তর্জাতিক 'ওশান সায়েন্স' জার্নালে প্রকাশিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষকের এক সমীক্ষা প্রতিবেদেন বলছে, ১৯৮০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সময়ে এ দ্বীপে প্রবালের আচ্ছাদন ১ দশমিক ৩২ বর্গকিলোমিটার থেকে কমে শূন্য দশমিক ৩৯ বর্গকিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে। প্রবাল প্রজাতি ১৪১টি থেকে কমে ৪০টিতে নেমেছে। আর এই বিপর্যয়ের একটি বড় কারণ অতিরিক্ত দর্শনার্থীদের সমাগম এবং তাদের ফেলা প্লাস্টিক-জাতীয় দ্রব্য।
প্লাস্টিক দূষণের কারণে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের প্রাকৃতিক পরিবেশ এখন ঝুঁকির মুখে। প্রতিদিন পর্যটকের পদচারণায় দ্বীপের পরিবেশ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থাপনার উপর পড়ছে চাপ। আর এদের ফেলে দেওয়া অপচনশীল সমস্ত প্লাস্টিক গিয়ে পড়ছে সাগরতীরে অথবা বঙ্গোপসাগরে। এছাড়া, অনেক সামুদ্রিক প্রাণীর খাবারের সঙ্গে মিশে এগুলো যাচ্ছে এদের পেটে, যা খাদ্যশৃঙ্খলসহ সমুদ্রিক পরিবেশ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থাপনায় ঝুঁকিপূর্ণ। এছাড়া সামুদ্রিক প্রাণীর বিকলাঙ্গতাসহ বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় প্রভাব ফেলে সামুদ্রিক প্রাণীর ওপর।
গত ১৬ নভেম্বর সংগৃহীত পরিত্যক্ত প্লাস্টিকগুলো এটাই নির্দেশ করে যে, জরুরিভাবে সেন্ট মার্টিনে ক্ষতিকর প্লাস্টিক দূষণ বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। সেন্ট মার্টিন রক্ষায় বিভিন্ন প্রকল্প চলমান। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও উদ্যোগ রয়েছে এই দ্বীপকে রক্ষায়। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের ১৩টি সুপারিশ রয়েছে সেন্ট মার্টিন রক্ষায়।
কিন্তু মানুষের সচেতনতা আরও বৃদ্ধি প্রয়োজন। জনসচেতনতা বৃদ্ধি, পর্যটক ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সদিচ্ছা ছাড়া এই কর্মকাণ্ড বন্ধ অসম্ভব। সাময়িক আনন্দ কিংবা লাভের উদ্দেশ্যে, পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড ক্রমশ দূষণ বাড়িয়েই চলছে। সম্ভব হলে একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করে বিকল্প ব্যবস্থা খোঁজা এবং প্রবর্তন করতে হবে।
আমাদের দেশীয় পণ্য বা পরিবেশবান্ধব তৈজসপত্রের ব্যবহার বৃদ্ধি এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এতে যেমন একদিকে আমাদের দেশীয় পণ্যর ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে, তেমনি পরিবেশও সুরক্ষিত হবে।
সেন্ট মার্টিন এবং এর ইকো ট্যুরিজম নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি ও সঠিক পরিকল্পনা দরকার। বিভিন্ন এনজিও ও সংগঠনের মধ্যে সমম্বয় বর্তমানে খুবই জরুরি। সবার সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া আমরা প্লাস্টিকের হাত থেকে সেন্ট মার্টিনকে রক্ষা করতে পারব না।
- লেখক: বন্যপ্রাণী পরিবেশবিদ, সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল এন্ড জিওগ্রাফিকাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস, সিইজিআইএস, বাংলাদেশ।