মাদক: মানুষ আসক্ত হবেই?
মাদক নিয়ে একটা খবর দেখলাম দুই দিন আগে। পেটে ইয়াবা গলে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে একজনের। এটা মর্মান্তিক কারণ এই লোকটার উদ্দেশ্য নেশা ছিল না, ছিল কামাই করা। যেভাবেই হোক, যে কোনো পথেই হোক কামাই করতেই হবে এই দেশে টিকতে। বাংলাদেশ একটা কামাই করার দেশ। এখানে নৈতিক, অনৈতিকতা কোনো বিষয় নয়। মূল কথা টাকা কামাই। পচা মদ খেয়ে তিনজন মারা গেলো সেদিন। যার দামি মদ কেনার ক্ষমতা নাই সে কী করবে? অতএব মাদক কারবারিদের আলাদাভাবে 'শয়তান' বানানোর দরকার নাই। স্রেফ টিকে থাকা, খেয়ে খাইয়ে।
২
আমাদের সমাজে নেশার বসবাস দীর্ঘদিনের। ইংরেজ আসার পর এটা অনেক বেড়ে যায়। এতে বাঙালি সমাজের মহান মানুষজন জড়িত ছিলেন। ইংরেজ কোম্পানির অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, চীনে ওপিয়াম পাঠানো বিনা ঝামেলায়। উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলা এর কেন্দ্রস্থল ছিল এবং এতে যারা টাকা বানান তাদের মধ্যে ঠাকুর পরিবার প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেন অন্যতম। আজকের সুশীল বাঙালি ধারা- যার সূত্রপাত ১৯ শতকের বাঙালি বাবু সমাজ, তার বড় ফান্ডিং আসে মাদক ব্যবসা থেকে। অতএব এই মাদক ও সাংস্কৃতিক চর্চা এই সমাজে বহু দিন ধরে বসবাস করছে। একে মেনে নেয়া উচিত। মাদকের লাভের টাকা দিয়েই জমিদারি কেনা হয় যেটা একদিন কবিগুরু দেখভাল করেন, সংসার চালান। কিছুটা হলেও আমাদের মাদকের কাছে কৃতজ্ঞ থাকতে হবে। একবারও ভাবা যায়, রবীন্দ্রনাথ চাকরির সন্ধানে ঘুরছেন কলকাতার রাস্তায়? দাদার এস্টেট থেকেই তার সংসার চলে। অতএব, এই কপটতা ও শঠতা বাদ দিয়ে মাদকের দিকে বাস্তবতার চোখ দিয়ে তাকাতে হবে।
৩
বাংলাদেশ মাদক আসে বড় করে স্বাধীনতার পর। এটা ছিল প্রধানত: গাঁজা। গাঁজা আগেও ছিল তবে সীমিত আকারে। ভদ্রলোকের নেশা ছিল না, ছিল নিম্নবর্গের। আমার পৈত্রিক বাড়ির হিন্দু গৃহস্থ কর্মীবৃন্দ- মেথর, মালিরা সন্ধ্যায় বসে গাঁজা খেতো আসর করে। আমার তাকাতামও না। এমনকি আমার মা ওদের নাস্তা পাঠিয়ে দিতেন দুধ সহ কারণ সবাই জানতো 'গাঁজার ক্ষুধা' শরীরের কাজ করার ক্ষমতা খায়। কিন্তু এই চাঁড়াল নেশা দেশ স্বাধীনের পর, গলায় পৈতে বেঁধে ব্রাহ্মণ হলো। আমরা অনেকেই খেতে লাগলাম, কেউ বেশি কেউ কম। ১৯৭১ এর পর মাদকের গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে গেলো সমাজে।
৪
কিন্তু গাঁজা একা হাঁটে না। সাথে এলো মদ আর ট্যাবলেট। ট্যাবলেট ছিল 'হার্ডকোর' নেশাখোরদের। ম্যানড্রেক্স নামক একটা পিল খুব জনপ্রিয় ছিল। নির্মলেন্দু গুণের কবিতা ছিল। "আজ রোববার, আজ হলিডে আজ ম্যানড্রেক্স, আহা ম্যানড্রেক্স "...সাথে আরো অনেক পিল ছিল। স্পিড ছিল মানে "উঠাইন্না" পিল। খেলে ২ দিন ঘুম আসতো না। ডেক্সিড্রিন স্টুডেন্টদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল। রাত জেগে পরীক্ষার আগের দিন পড়ার জন্য মহৌষধ। অতএব, ইয়াবার পূর্বপুরুষের সাথে আমরা পরিচিত।
৫
তৎকালীন বিচিত্রায় একটা কার্টুন বের হয়। তখন ভেজাল আর মজুতদারির যুগ। দুই লোক বসে দামি বিদেশী মদ খাচ্ছে। একজন বলছে, "খাঁটি বিদেশী মদ খেতেই তো আমি দেশি জিনিসপত্রের ভেজাল কারবার শুরু করলাম।" অর্থাৎ বড়লোকি আর দামি মদ আর দুই নম্বরি ইনকাম এক সুতায় গাঁথা। তবে স্থানীয় মাল মানে কেরু অনেকে খেত। ভালো ও সস্তা মদ। মধ্যবিত্তের নেশা। আরো অনেক কিছু ছিল বিশেষ করে "বাংলা" যেটা কিনা নিম্নবিত্তের। তার নিচে রেক্টিফাইড স্পিরিট ও.....
৬
ইদানিং সরকার কেরুকে ছাড় ও উৎসাহ দিয়েছেন, যার ফলে অনেক বিক্রি বেড়েছে। অতএব, লাভ হচ্ছে সরকারের। যাদের খাবার তারা তো খাবেই, অতএব মাঝখান থেকে সরকারি আয় বাদ যাবে কেন? কিন্তু ইয়াবা অর্থনীতির কাছে এটা কিছুই না। ইয়াবা মানুষখেকো নেশা। লাভ অনেক- রাজনৈতিক কানেকশন যুক্ত বেশ কিছু মানুষ টাকা বানায়। এটা পাঠায় মিয়ানমার এবং এতে তাদের সেনাবাহিনী জড়িত। গত ২০ বছরে এটা বাংলাদেশের পুরো মাদক ইকোলজি দখল করে ফেলেছে। সহজে সরানো যাবে না। সরকারি হিসেবে দেশে মাদকখোর কম করে ৭৫ লাখ। অন্য হিসাব বলে ১.৫ কোটি।
৭
নেশা আমাদের সমাজের অতি গভীরে আছে ও আমরা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম 'সিগারেট খোর'। এমনকি আমাদের দেশের মেয়েরা আমেরিকান মেয়েদের সমান সিগারেট খায়। অতএব মেনে নেয়া ভালো- নেশা করবোই আমরা। কিন্তু ইয়াবার সাথে সাথে গাঁজা ও মদ থাকলে পিলের দাপট কমবে। গাঁজা বন্ধ করাটা ছিল বোকামি। এটা হারবাল নেশা। ঢাকার ঘৌড়দৌড় বন্ধ করেও জুয়া কমেনি। কেরুর কারণে পচা মদ কমবে। কম ক্ষতিকারক নেশা আমাদের প্রয়োজন। এতে দেশের লাভ, দশের লাভ। ইয়াবা কমবে।