তারা নিজেদের গাঁজা নিজেরাই চুরি করতেন: স্মৃতিচারণায় নওগাঁ’র গাঁজাচাষিরা
ফসলি জমিতে সশস্ত্র রক্ষীদের পাহারা দিতে দেখেছেন কখনো?
অবাক শোনালেও, কোনো একসময় গাঁজা চুরি ঠেকাতে নওগাঁর গাঁজা খেতগুলোতে পালা করে পুলিশ, আনসার ও কৃষকেরা পাহারা দিত। সে সময় ধান চাষের মতো গাঁজাও বৈধভাবে চাষ করা যেত আর এটি চাষের জন্য নওগাঁ ছিল সারা বাংলাদেশের মধ্যে বিখ্যাত।
খোঁজখবর রাখলে আপনি হয়তো জেলার গাঁজা উৎপাদনকারী (অংশীদার) পুনর্বাসন সমবায় সমিতি'র (গাঁজা সোসাইটি) কথা শুনে থাকবেন। এ প্রতিষ্ঠানটি এখনো বিপুল অঙ্কের সম্পদের মালিক।
খড়ের তৈরি ঘরে অবস্থান করতেন, পাহারাদার পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যরা। মাঠের পাশেই কৃষকদের ছোট কুঁড়েঘর থাকত। কিন্তু এতকিছুর পরেও চুরি হয়ে যেত গাঁজা গাছ।
বক্তারপুর বাজারের সাবেক গাঁজাচাষি ইদ্রিস আলী আখন্দ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'যৌবনে যখন তিনি শক্তিশালী ছিলেন' তখন এক শীতের রাতে নিজেই এক গাঁজাচোরের সঙ্গে লড়াই করে তাকে পাকড়াও করেন।
'ব্যাটা সেদিন বড় শিক্ষা পেয়েছিল,' বলেন বর্ষীয়ান ইদ্রিস আলী। সম্প্রতি চোখের দৃষ্টিশক্তি কিছুটা হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। কিন্তু, নিজের স্মৃতিকাতর অতীতের কথা বলার সময় উত্তেজনা তার চোখমুখে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। বেশিরভাগ সাবেক গাঁজাচাষিরাই অতীতের গল্প বলার সময়, নিজেদের উত্তেজনা লুকাতে পারেন না।
তবে গাঁজা চুরির ক্ষেত্রে চোর বা দস্যু সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল না।
'চাষিরা নিজেরাই ছিলেন বড় সমস্যা,' বলেন আরেক সাবেক গাঁজাচাষি আনিসুর রহমান। বর্তমানে তিনি গাঁজা উৎপাদনকারী (অংশীদার) পুনর্বাসন সমবায় সমিতিতে অফিস সহকারী হিসেবে কাজ করছেন।
উৎপাদন থেকে শুরু করে বিক্রি; গাঁজা সোসাইটি'র মাধ্যমে গাঁজা চাষ আগাগোড়া দেখাশোনা করত সরকার। সরকারের পক্ষে গাঁজা কেনার জন্য এ সংস্থার একচ্ছত্র কর্তৃত্ব ছিল।
'সরকার গাঁজার জন্য যে দাম দিত তা বাজারের চেয়ে আলাদা ছিল। বাজারে অনেক বেশি দাম পাওয়া যেত। তাই, কৃষকেরা নিজেদের জমির গাঁজা নিজেরাই চুরি করত,' আনিসুর জানান।
গাঁজা চাষ, চুরি, আর চোর তাড়ানোর বীরত্বের এ গল্পগুলো কমপক্ষে ৩৫ বছর পুরনো। ১৯৭৪ সালে সরকার মাদকবিরোধী আন্তর্জাতিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। তারই ধারাবাহিকতায়, ১৯৮৭ সালে দেশে গাঁজার চাষ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
কিন্তু, নিষেধাজ্ঞার কয়েক যুগ পরেও নওগাঁর গ্রামগঞ্জের চা দোকানগুলোতে এখনও কান পাতলে গাঁজা-বিষয়ক আলাপ শোনা যায়। এসব গ্রামের অধিকাংশ কৃষক অতীতে গাঁজাচাষি ছিলেন।
ইদ্রিস আলী, আনিসুর রহমান বা শামসুল হক প্রামাণিকের মতো বয়স্ক চাষিদের আজো ম্যাজিকের মতো টানে গাঁজা'র আলাপ।
বক্তারপুর বাজারে ইদ্রিসের সঙ্গে যখন আমাদের কথা হচ্ছিল তখন বেলা গড়িয়ে দুপুর। ইদ্রিসের ছেলে আমাদের আলাপ শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। ছেলে বাপের সাথে খাবে বলে দাঁড়িয়ে আছে, মাঝেমধ্যে তাড়া দিচ্ছে। কিন্তু, ইদ্রিস তাকে এক ধমক দিয়ে থাময়ে দিলেন। তার সঙ্গে যোগ দিলেন, ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক মেম্বার প্রামাণিক।
আমাদের আড্ডা চলতে থাকল। 'ধরেন আমি ১৫ কাঠা জমিতে গাঁজা চাষ করলাম। পাঁচ কাঠা জমির গাঁজা চুরি করলে আমার জেল হয়ে যেতে পারে। কিন্তু, তারপরও, ওই চুরি করা গাঁজা বাইরের বাজারে বিক্রি করে যে দাম পাওয়া যেত, তা দিয়ে আমার পরের তিন বছর দিব্যি চলে যেত,' ইদ্রিস বলেন।
তার বন্ধু শামসুল হক তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, 'ধরেন আমি উৎপাদন করলাম ১৫ গাদা গাঁজা। সেখানে থেকে কেবল তিন গাদা চুরি করে বাইরের বাজারে বিক্রি করলে তার থেকে যে দাম পাওয়া যেত তা সরকারের কাছে বিক্রি করা বাকি ১২ গাদার চেয়ে অনেক বেশি হতো'।
'তাহলে তারা (কৃষক) কেন চুরি করবে না?'- ইদ্রিস বলেন। 'মানুষ পিয়ন ও গার্ডদের ঘুষ দিয়ে হাত করে নিত– যেন রাতের বেলায় নিজের জমি থেকে গাঁজা চুরি করতে পারে। পরদিন সরকারের বড়কর্তা জমি পরিদর্শনে এলে তারা বলতো, কোনো দস্যুদল রাতে হানা দিয়ে এ কাজ করেছে। অনেকে গাঁজা চুরির দায়ে জেলও খেটেছে'।
কৃষকেরা সরকারের কাছে গাঁজার দাম বাড়ানোর দাবি করেনি কেন?
'কেন করবে? চুরির পর চাষির হাতে পর্যাপ্ত লাভ থাকত'- অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন ইদ্রিস ও প্রামাণিক।
ইদ্রিস আরেকটা রসালো গল্প ফাঁদার আগেই প্রামাণিক তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, 'শোনো, বাবা, তখন মানুষ সৎ ছিল। তারা গাঁজা চুরি করলেও তাদের মধ্যে সততা আর সাহস ছিল। এমন না যে সব চাষি চুরি করত'।
'আমাদের গাঁজা ছিল অদ্বিতীয়'
গাঁজা চাষের জন্য মাটি হতে হয় দোআঁশলা। জমি একটু উঁচুতে, কিন্তু বেশি উঁচুও নয়, কারণ নিয়মিত সেচের প্রয়োজন পড়ে।
'সুনির্দিষ্ট জমিতে গাঁজার চাষ হতো। আমরা সরকারের কাছ থেকে লাইসেন্স নিয়ে চাষ করতাম,' জানান আনিসুর রহমান।
'তামাকের মতো গাঁজা কিন্তু পাতা থেকে আসে না। এটি জটা বা মঞ্জরি (ফুল) থেকে তৈরি হয়। আর মর্দা ও মার্দি গাছের জটাও হয় ভিন্ন ভিন্ন। মর্দা গাছে বীজ থাকে বেশি, আর মার্দি গাছগুলোতে মঞ্জরি ধরে।
'আলুর মতো গাঁজাও একসারিতে চাষ করা হয়। অভিজ্ঞ চাষিরা জটাগুলো পরীক্ষা করে দেখতেন। তাদেরকে বলা হতো পোদ্দার। তারা পুরুষ গাছগুলো উপড়ে ফেলত,' বলেন আনিসুর। 'এটা ছিল বড় একটা কাজ'।
'সবশেষে মান ও দাম অনুযায়ী, বিভিন্ন শ্রেণিতে গাঁজাগুলোকে ভাগ করা হতো। আমাদের গাঁজার মতো ভালো গাঁজা আর কোথাও পাওয়া যেত না,' যোগ করেন তিনি।
এখনকার মাদকসেবীদের নিয়ে হতাশ গাঁজা চাষিরা
'ইউ গনা স্মোক গাঞ্জা ইন মেনি ডিফরেন্ট ওয়েজ'- গেয়েছিলেন বব মার্লে তার 'গাঞ্জা গান' গানে। মার্লে ও তার গান; দুটোই গাঁজার সঙ্গে ভালোরকম জড়িয়ে আছে। কিন্তু মার্লে কি জানতেন, গাঁজার বীজ ভেজেও খাওয়া যায়?
গাঁজার বীজভাজা নওগাঁর তৎকালীন গাঁজাচাষিদের মধ্যে মোটামুটি জনপ্রিয় একটি খাবার ছিল। 'এ ভাজা খুবই সুস্বাদু আর মাদকতাময়,' প্রামাণিক জানালেন। 'সর্ষের তেল মিশিয়ে গাঁজার বীজ খেলে টের পাবেন, সারাজীবনে এরকম আশ্চর্যজনক আর কিছু কখনো খাননি'।
প্রামাণিক, ইদ্রিস, ও আনিসুর সবাই গাঁজার ঘোর সমর্থক। তারা বিশ্বাস করেন, গাঁজা চাষ ছিল বেশ উপকারী ও লাভজনক। বাংলাদেশকে যেন অর্থকরী এ ফসল থেকে বঞ্চিত করা যায়, সেজন্য 'আন্তর্জাতিক চক্রান্তের' মাধ্যমে গাঁজাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
গাঁজা নিষিদ্ধ করা না হলে, আমাদের তরুণদের ক্ষতি হতো বলে মনে করেন না আপনারা?
'দেখুন, আমাদের সময়ে গাঁজা খেত বুড়ো আর শক্তিশালী মানুষেরা... এখনকার মতো ভগ্নস্বাস্থ্য তরুণদের মতো নয়। এরা তো খায়- ভেজাল জিনিস। এ ছোঁড়াগুলো অধঃপাতে গেছে, একদম হতাশাজনক পরিস্থিতি'- প্রামাণিক বলেন।
'হিরোইন, ইয়াবা, ফেনসিডিল আমাদের সময় মহামারির মতো ছিল না। গাঁজা নিষিদ্ধ হওয়ার পরে এগুলো বেশি ছড়িয়েছে। গাঁজা তো এসবের মতো অত ক্ষতিকারক নয়'- আনিসুর জানান।
'গাঁজা অল্প সময়ের জন্য অল্প পরিমাণে নেশা ধরায়। তখনকার সময়ে গাঁজা খেত সাধু-সন্ন্যাসী, আর মাজারের শিল্পীরা। তাদের জীবনের একটা শৈল্পিকতা ছিল'- তিনি বলেন।
আনিসুর জানান, এখন যেমন মদপান করার জন্য সরকারের কাছ থেকে লাইসেন্স নিতে হয়, সে সময় গাঁজা খাওয়ার জন্যও লাইসেন্স দিত সরকার। 'অনেক নিয়মকানুন আর শৃঙ্খলা ছিল'- তিনি বলেন।
আবার যদি বৈধ হয় গাঁজা?
পশ্চিমাবিশ্বের কিছু দেশ গাঁজাকে বৈধ বলে অনুমোদন দিয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে। বাংলাদেশও এমন করলে কেমন হবে?
'ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি গাঁজা নিষিদ্ধ করা একটি ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। গাঁজা ছিল নওগাঁর জন্য আশীর্বাদ। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে, গাঁজার ব্যবসায় টিকিয়ে রাখা কঠিন হতো। এখনকার তরুণরা অবাধ্য। খুনখারাবি, অপরাধমূলক কাজ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ত'- আনিসুর বলেন।
কিন্তু, বিষয়টিকে অন্যভাবে দেখছেন শামসুল হক প্রামাণিক। গাঁজার চাষ আবার বৈধ হলে উৎসব মিছিল বের হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
কিন্তু বলা সহজ, করা কঠিন। ১৯৮০'র দশকের পর মাদক পরিস্থিতি তাৎপর্যপূর্ণভাবে বদলে গেছে। এখন অনেকে অন্য সব মাদকের মতো গাঁজাকেও জনস্বাস্থ্য ও সামাজিক শৃঙ্খলার জন্য হুমকি হিসেবে দেখেন। এছাড়া, গত ৩৫ বছরে অবৈধ গাঁজার ব্যবসাও চরমে উঠেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক কামাল চৌধুরী বলেন, 'যেসব দেশে মারিজুয়ানাকে বৈধ করা হয়েছে, সেখানে অবশ্যই তথ্য-প্রমাণের ওপর ভিত্তি ও অনেক ভাবনাচিন্তা করেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কিন্তু, বৈধ হলেও সেখানেও কিছু সীমাবদ্ধতার বিষয় রাখা হয়েছে। যেমন একজন মানুষ একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি মারিজুয়ানা গ্রহণ করতে পারবে না ইত্যাদি'।
'হ্যাঁ, গাঁজার চিকিৎসা-সংক্রান্ত ব্যবহার রয়েছে। এটা সচরাচর বেদনানাশক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। গাঁজার নিয়মতান্ত্রিক ব্যবহার হয়তো খুব একটা ক্ষতিকর নয়। কিন্তু সমস্যা হলো, যেকোনো মাদকদ্রব্যই আসক্তিতে রূপ নেয়। আর এ আসক্তির শারীরিক, মানসিক, ও সামাজিক প্রভাব রয়েছে'।
গাঁজা'র বৈধতার প্রসঙ্গে এ অধ্যাপক বলেন, 'যদি কোনো এক সময়ে এটাকে বৈধ করতে হয়, তাহলে জনগণের যেন কোনো ক্ষতি না হয় সে বিষয়ে আগে পর্যাপ্ত গবেষণা করতে হবে। যদি তা সম্ভব না হয়, তবে গাঁজা অবৈধই থাকুক। কারণ, এর অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণে আমাদের কোনো কৌশল জানা নেই। সেই কৌশল রপ্ত করা গেলেই কেবল গাঁজাকে বৈধ করা যেতে পারে'।
দেশের অন্য কোথাও গাঁজা চাষের কোনো প্রয়াস নেওয়া হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক আজিজুল ইসলাম বলেন, তাদের কাছে এ বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। তবে তিনি জানান, 'মাঝেমধ্যে মানুষ গোপনে অল্প কিছু গাঁজার চারা লাগায়। সেটাকে ঠিক চাষ বলা যাবে না। কিন্তু, যখনই এরকম কোনো খবর পাই, সাথে সাথে আমরা যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করি'।