গাঁজা কি আদতেই ব্যথার উপশম ঘটাতে পারে, নাকি এর পেছনে কলকাঠি নাড়ছে অন্যকিছু?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক মানুষই ক্রনিক ব্যথা কমানোর জন্য মেডিকেল ক্যানাবিসের (মারিজুয়ানা) আশ্রয় নেন। ক্যানাবিনয়েড থাকা দ্রব্য সেবনকারীরা মূলত ব্যথা প্রশমনের উপায় হিসেবেই এটি ব্যবহার করেন। ক্যানাবিনয়েড মারিজুয়ানার প্রধান সক্রিয় উপাদান। কিন্তু সত্যিই গাঁজা-মারিজুয়ানাজাতীয় দ্রব্যের ব্যথা কমানোর ক্ষমতা আছে, নাকি এর পেছনে অন্য কারণ রয়েছে—জানিয়েছে হার্ভার্ড হেলথ পাবলিশিং।
গাঁজার বিকল্প হিসেবে ক্যানাবিস প্লাসিবো নামক এক ধরনের বস্তু ব্যবহার করা হয়। এগুলোতে কোনো মাদকদ্রব্য থাকে না—কিন্তু দর্শন, স্বাদ, গন্ধ, ও অনুভূতিতে এগুলো পুরোপুরি গাঁজার মতো। গাঁজার কোনো উপাদান না থেকেও ক্যানাবিস প্লাসিবো গাঁজার মতোই ব্যথা উপশম করতে পারে বলে অনেক প্রমাণ রয়েছে। কিন্তু কেন?
গবেষণা যা পেল
একাধিক গবেষণায় ১,৪৫৯ জন মানুষের ওপর অনুসন্ধান চালান বিজ্ঞানীরা। এদের বেশিরভাগই নিউরোপ্যাথিক বেদনায় আক্রান্ত ছিলেন।
গবেষণার অংশ হিসেবে এসব ব্যক্তিদের একদলকে মারিজুয়ানার প্রধান দুটি উপাদান দিয়ে বেদনার চিকিৎসা করা হয়। একইসঙ্গে আরেকদলকে মারিজুয়ানার প্লাসিবো উপাদানগুলোও দেওয়া হয়।
দেখা যায়, যেসব অংশগ্রহণকারী বেদনানাশক হিসেবে মারিজুয়ানার প্রকৃত উপাদান গ্রহণ করেছিলেন, এবং যাদরকে স্রেফ ক্যানাবিস প্লাসিবো দেওয়া হয়েছিল—উভয়পক্ষই সমপরিমাণ বেদনা উপশমের কথা জানিয়েছেন।
হার্ভার্ডের বেথ ইসরায়েল ডিকনেস মেডিকেল সেন্টারের গবেষক টেড জে. ক্যাপচাক বলেন, কেবল অপিয়েড ছাড়া আর বেশিরভাগ ব্যথা উপশমকারী ঔষধই প্লাসিবোর চেয়ে আহামরি ভালো কাজের নয়।
বস্তুতপক্ষে, অ্যাসপিরিন ও ইবিউপ্রোফেনের মতো সাধারণ ব্যথার ঔষধের ওপর গবেষণা করে দেখা গেছে, এগুলোর প্লাসিবো সংস্করণও মূল ঔষধের মতো একই পরিমাণ ব্যথা উপশম করে।
প্লাসিবো যেভাবে মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলে
'সেই ১৯৭০'র দশক থেকেই আমরা জানি যে, কাউকে প্লাসিবো দেওয়া হলে ব্যক্তির মস্তিষ্কে একাধিক নিউরোট্রান্সমিটার মুক্ত হয় এবং মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চল সক্রিয় হয়ে ওঠে, বলেন ক্যাপচাক।
এ নিউরোট্রান্সমিটারগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে এনাডোক্যানাবিনয়েড, যেটি গঠনের দিক থেকে গাঁজার সক্রিয় উপাদানের মতো। তবে প্লাসিবো গ্রহণ করলে ঠিক কেন এ রাসায়নিক উপাদানগুলো মস্তিষ্কে তৈরি হয়, তা এখনো রহস্যময়।
প্লাসিবো প্রভাব মূলত রোগীর মনোভাবের ওপর নির্ভরশীল। প্লাসিবো প্রত্যাশ্যার মাধ্যমে কাজ করে: রোগী বিশ্বাস করেন, তিনি যে ঔষধ খাচ্ছেন, তা খেলে সুস্থ হয়ে যাবেন। এবং রোগীর ধারণা সত্য হয়।
গণমাধ্যম ও মেডিকেল ক্যানাবিসে প্রত্যাশা
গণমাধ্যমে গাঁজা সম্পর্কিত গবেষণা বেশি প্রকাশ পায় বলে আরেকটি অনুসন্ধানে জানতে পেরেছেন গবেষকেরা।
১৩৬টি সংবাদ বিশ্লেষণ করে গবেষকেরা দেখেছেন, অন্য যেকোনে প্রকাশিত গবেষণার চেয়ে গাঁজা বিষয়ক গবেষণার খবরই গণমাধ্যমে বেশি স্থান পায়।
তার মানে কি ব্যাপারটা এমনও হতে পারে যে, গণমাধ্যমের এত খবর প্রকাশের ফলে মানুষের মধ্যে গাঁজার ব্যথা উপশমের মতো ক্ষমতার বিষয়ে প্রত্যাশা বেড়ে যায়?
আর গাঁজার ক্ষমতার ওপর এ বিশ্বাসের কারণে প্লাসিবো গাঁজা খেলেও সমান ফল পাওয়ার সম্ভবনা আরও বেড়ে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
যদিও এ ব্যাপারে স্পষ্ট কোনে প্রমাণ বা গবেষণাজাত ফলাফল এখনো তৈরি হয়নি। তবে বিজ্ঞানীরা আইবিউপ্রোফেনের মতো গণমাধ্যমে উহ্য থাকা ঔষধগুলোর প্লাসিবো সংস্করণের শক্তিশালী কার্যক্ষমতার কথাও মাথায় রাখতে পরামর্শ দিয়েছেন।
ডাক্তার যদি রোগী দেখার সময় স্নেহ ও যত্নের ভাব প্রকাশ করেন, তাহলেও প্লাসিবো প্রভাব তৈরি হয় রোগীর মধ্যে। তখন রোগী মনে করতে থাকেন, এ ডাক্তারের চিকিৎসায় তিনি সুস্থ হয়ে যাবেন।
একটু ঘটা করে চিকিৎসা করলেও প্লাসিবো প্রভাব বেড়ে যায়। যেমন ডাক্তার যদি স্রেফ কয়েকটা ঔষধ দিয়ে চলে যান, তখন রোগী যেরকম অনুভব করবেন; তার চেয়ে বেশি ভালো বোধ করবেন যদি তিনি দেখেন তার চিকিৎসক অনেক আয়োজন কর, অনেকগুলো শিশি খুলে তার জন্য ইঞ্জেকশনের ব্যবস্থা করছেন।
এসব থেকে যা বোঝা যায়
পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশে গাঁজা অবৈধ। কয়েকটি দেশে ক্যানাবিসকে বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। চিকিৎসাজনিত কারণে গাঁজা-মারিজুয়ানার ব্যবহার যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি রাজ্যে বৈধতা পেয়েছে। কেউ যদি গাঁজা বা গাঁজার উপাদান ব্যথানাশক হিসেবে ব্যবহার করতে চান, তাহলে এসব গবেষণা বা প্লাসিবো প্রভাবের কথা জেনে তার কী করা উচিত?
'আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৃঢ় বিশ্বাসের সাপেক্ষে একজন চিকিৎসক বলবেন, গাঁজাজাতীয় মাদক কাজ করে না; এগুলো প্লাসিবোর চেয়ে কোনো অংশে শ্রেয়তর কিছু নয়,' বলেন ক্যাপচাক।
কিন্ত এটা একটা প্রহেলিকা। কারণ বাস্তব জীবন আর ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের মধ্যে বিস্তর ফারাক। যেকোনো ক্রনিক বেদনার চিকিৎসা করানো ভীষণ কঠিন।
আর কোনো ড্রাগের যদি বেদনা কমানোর ক্ষমতা বেশি হয়, তাহলে তার সঙ্গে এর ওপর নির্ভরশীলতা বা আসক্তির মতো প্রভাবগুলোও তৈরি হয়।
'যদি কোনো মাদক উপাদান আপনার ব্যথা কমাতে সাহায্য করে, অথচ শরীরের মারাত্মক কোনো ক্ষতি করে না, তাহলে আমি বলব সে উপাদান ব্যবহার করতে,' ক্যাপচাক বলেন। তবে এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।