গবেষণাবান্ধব কার্ডিওলজি ক্লিনিক কেন চাই?
প্রতিদিনকার অভ্যাস সকালবেলা পার্সোনাল ইমেইল দেখা আর বাংলাদেশের কয়েকটা জনপ্রিয় সংবাদপত্রের হেডলাইন গুলোর ওপর চোখ বুলানো। কোভিড-১৯ মহামারির শুরু থেকে নিকট আত্মীয় বা পরিচিত অগ্রজ-অনুজদের মৃত্যু সংবাদ যেন সাদামাটা খবরের মতো। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার এই দিনটিও কি অতি নিকটে?
সপ্তাহ দুই আগে, একটি খবর আমাকে খুব কষ্ট দিয়াছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিভাগের আমার এক অনুজ অ্যালামনাই, একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর হিসেবে সে কর্মরত ছিল, মাত্র ৪৯ বছর বয়সে বিনানোটিশ সকলকে কাঁদিয়ে অজানার দেশে চলে গেলো। মৃত্যুর কারণ ছিল হৃদপিন্ডে হঠাৎ আক্রমণ। গতবছর আমার আপন ছোটভাইও একই রোগের শিকার হয়। হৃদরোগে মারা যাওয়া সারা পৃথিবীতে এখন অতি পরিচিত এবং সাধারণ একটি কারণ। তার ওপরে আমরা যারা দক্ষিণ এশিয়ায় জন্মেছি, আমাদের এই ঝুঁকি অন্যান্যদের তুলনায় অনেক বেশি। অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে তুলনা করলে, দক্ষিণ এশীয়রা বিশেষ করে হৃদরোগ এবং ডায়াবেটিসের মতো গুরুতর চিকিৎসার ঝুঁকিতে রয়েছে।
হার্ট অ্যাটাক হয় যখন হার্টে রক্ত এবং অক্সিজেন পাঠায় এমন একটি ধমনী ব্লক বা বন্ধ হয়ে যায়। সময়ের সাথে সাথে আমাদের হৃদপিণ্ডের ধমনীতে কোলেস্টেরলযুক্ত চর্বি জমা হতে থাকে এবং সেটি এক সময় ধমনীকে ব্লক করতে সক্ষম হয়। এর পিছনে অনেক ফ্যাক্টর কাজ করে, যেমন- পুরুষদের ৪৫ বছর বয়সে এবং নারীদের ৫০ বছর বয়সে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়; হৃদরোগের পারিবারিক ইতিহাস- যদি আপনার বাবা-মা বা ভাইবোনের হৃদরোগ বা হার্ট অ্যাটাকের ইতিহাস থাকে— বিশেষ করে অল্প বয়সে— তাহলে আপনার ঝুঁকি আরও বেশি, কারণ আপনার জেনেটিক্স তাদের মতোই; জীবনধারা, যেমন- আমরা তেলে, ঝালে, ঝোলে বাঙালি এবং বড় আরাম প্রিয়। তারউপর যদি ডায়াবেটিস, ওজন বেড়ে যাওয়া, উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ কোলেস্টেরল (হাইপারলিপিডেমিয়া) থাকে তাহলে তো কথাই নেই। এই সব ফ্যাক্টরগুলো ধমনীতে কোলেস্টেরলযুক্ত চর্বি জমানোর অন্যতম কারণ। ধূমপান এবং মানসিক চাপ এসব রোগকে আরও ত্বরান্বিত করে। গবেষণা এটিও প্রমাণ করেছে, দক্ষিণ এশীয়দের ককেশীয়দের তুলনায় ছোট করোনারি ধমনীর লুমিনাল ব্যাস রয়েছে এবং দক্ষিণ এশীয়দের মধ্যে করোনারি ধমনী রোগের ঝুঁকি এবং মৃত্যুর হারকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে করোনারি ধমনীর আকারের সম্ভাব্য ভূমিকা আছে।
গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্য মতে, দক্ষিণ এশীয়দের বেশিরভাগ হার্ট অ্যাটাক উপরোক্ত ঝুঁকির কারণগুলোর মধ্যে এক বা একাধিকের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী প্রায় ২০ মিলিয়ন মানুষ কার্ডিওভাসকুলার রোগে মারা যায়, যা বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর প্রায় ৩২ শতাংশের জন্য দায়ী। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ রোগী মারা যায় হার্ট অ্যাটাকে। বাংলাদেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে করোনারি হৃদরোগের মৃত্যুর হার তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে হৃদরোগের কারণে মৃত্যুর ঝুঁকি প্রায় ১৫ শতাংশ। গত ১০ বছরে হৃদরোগে মৃত্যুর হার বেড়েছে পুরুষদের মাঝে ৩৫ গুণ এবং নারীদের ক্ষেত্রে ৪৮ গুণ। নারীদের ক্ষেত্রে বেশির কারণ প্রথমত, ধরে নেওয়া হয় মেয়েদের হৃদরোগের মাত্রা কম; আর দ্বিতীয়ত, গুরুত্ব দেওয়া হয় কম।
আমি নিজেও একজন হার্টের রোগী। এর খেসারত দিতে ২০০৮ সালে আমাকে বাইপাস সার্জারির আশ্রয় নিতে হয়েছিল। আল্লাহ তালার অপার করুণা এবং সেইসঙ্গে নিয়মিত ল্যাবরেটরি টেস্ট, নিয়মিত ওষুধ খাওয়া ও চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলার কারণে এখনো ভালো আছি।
উন্নত বিশ্বে গবেষণালব্ধ ফলাফলের মাধ্যমে কার্ডিওলজি ক্লিনিকগুলোকে নতুনভাবে সাজানো হচ্ছে। এই ক্লিনিকগুলো একদিকে যেমন রোগীর জন্য আশীর্বাদ আবার, অপরদিকে ব্যবসাবান্ধব। এই ক্লিনিকগুলো বিভিন্ন নামে পরিচিত, যেমন- হার্ট ফিট ক্লিনিক, কার্ডিয়াক রিহ্যাবিলিটেশন প্রোগ্রাম, কার্ডিয়াক সেন্টার ইত্যাদি। সহজভাবে বললে ওয়ান স্টপ শপিং। এ ধরনের ক্লিনিকগুলো একজন হার্টের রোগীর সকল সমস্যা একসঙ্গে দেখে এবং তা মনিটরিং ও সমাধানের চেষ্টা করে। আজ আমি একজন উদ্বিগ্ন হৃদরোগী এবং দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে এ সম্পর্কেই কিছু লিখতে চাই এবং আশা করবো বাংলাদেশের কিছু কার্ডিওলজিস্ট এ ধরনের প্রোগ্রাম চালু করার বিষিয়ে চিন্তাভাবনা করবেন। তাতে করে মনে হয়, আমার মতো রোগীরা অনেক লাভবান হবেন, আর কার্ডিওলজি বিশেষজ্ঞরা পাবেন প্রফেশনাল ও মনিটরি স্যাটিস্ফেকশন। বলে রাখা ভালো, এই ক্লিনিক শুধু চিহ্নিত হার্টের রোগীর জন্য।
এ ধরনের কার্ডিওলজিস্টস ক্লিনিক গুলোতে থাকে ৫-৬ টি কক্ষ এবং একটি বড় জিমনেসিয়াম, যেখানে জায়গা হিসেবে এক ঘণ্টার সেশনে একসাথে ৪-৬ জন ব্যায়াম করতে পারে। বাকি ৫টি কক্ষ হল; একটি রিসেপশনিস্টের জন্য, একটি কার্ডিওলজিস্টের নিজের জন্য, একটি পুষ্টিবিদের জন্য, একটি ট্রেডমিল টেস্ট, ইসিজি ইত্যাদির জন্য এবং আরেকটি শরীরের চর্বি এবং পেশী পরিমাপের জন্য। এছাড়াও, সাধারণ জায়গা যেমন ওয়াশরুম, কফিশপ ইত্যাদি তো আছেই। জিমনেসিয়ামের জন্য, সার্টিফাইড ট্রেইনার/ প্রশিক্ষকও থাকে। তবে কানাডাতে সাস্থসেবা সরকার বহন করলেও এক্সারসাইজের খরচ নিজেদেরকে বহন করতে হয়। আমি মনে করি, এটি খুবই যুক্তিসঙ্গত। আমি জানি, বাংলাদেশে রোগীদের সব খরচ নিজেকেই করতে হয়। তারপরেও তারা যে খরচ করবে, তার তুলনায় লাভ অনেক বেশি। সঠিক কারণে অর্থ হারানোর তুলনায় অল্প বয়সের কোনো আপনজন কে হারানোর বেদনা অনেক বেশি কষ্টের।
এই ক্লিনিকে যারা রোগী, তাদেরকে সপ্তাহে তিনদিন একঘণ্টা করে সার্টিফাইড ট্রেইনারের উপস্থিতিতে কার্ডিয়াক এবং মাংসপেশির এক্সারসাইজ করতে হয়। প্রতি তিন মাস অন্তর অন্তর রক্ত পরীক্ষা ও শরীরের চর্বি এবং মাংসপেশির পরিমাণ মাপা; প্রতি ৬ মাস অন্তর অন্তর নিউট্রিশনিস্ট ও কার্ডিওলজিস্টের ভিজিট এবং প্রতি বছর ট্রেডমিল টেস্ট করতে হয়। প্রতিদিন এক্সারসাইজ করার আগে এবং এক্সারসাইজ করার শেষে নিজে ব্লাড প্রেসার এবং পালস মেপে তা রেকর্ড করে রাখতে হয়। এক্সারসাইজ করার সময় কোনো রোগীর মধ্যে ভিন্নতা, যেমন- অতিরিক্ত হাঁপানি বা অতিরিক্ত ঘামানি দেখলে পার্সোনাল ট্রেইনার সাথে সাথে সেটি কার্ডিওলজিস্টকে অবহিত করেন এবং তড়িৎ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এই সমস্ত সার্ভিসের ফলাফল গুলো কার্ডিওলজিস্ট নিয়মিত মনিটর করে। এতে করে রোগীর সমন্ধে কার্ডিওলজিস্টের সবসময় একটি স্বচ্ছ ধারণা থাকে। রোগীরাও একইভাবে স্বাচ্ছন্দ অনুভব করেন।
আমরা জানি, হৃদরোগ কোনো সংক্রামক রোগের মতো রাতারাতি ঘটে না। মাস থেকে বছর লাগে। তাই যদি আমরা একটি রুটিন ফলো-আপ করতে পারি, তবে অবশ্যই একজন রোগী তাদের নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা, নিয়মিত ব্যায়াম, রক্ত পরীক্ষা, ট্রেডমিল পরীক্ষার পাশাপাশি ব্যায়াম প্রশিক্ষক, পুষ্টিবিদদের পরামর্শের মাধ্যমে একটি সঠিক নির্দেশনা পাবেন এবং এই প্রচেষ্টাগুলো থেকে যে ডেটা তৈরি হবে, তা কার্ডিওলজিস্টকে রোগীর জন্য সঠিক সময় সঠিক পরামর্শ দিতে সাহায্য করবে।
আমরা সবাই জানি, হার্টের রোগীদের হাঁটাচলা করা, কম চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়া, নিয়মিত মেডিসিন খাওয়া ইত্যাদি আবশ্যক। কিন্তু বাস্তবে তা আমরা কতটুকু মেনে চলি? আমার মতো অলস রোগীর সংখ্যাই সমাজে বেশি। একটু ফাক ফোকর পেলেই ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করি। যে মন্ত্রটা বেশি মেনে চলি সেটা হলো, "ঠিক আছে, একদিন একটু বেশি খেলে কিছু হবেনা, মিষ্টি রাসুলের সুন্নত বা আজ আবহাওয়া টা খারাপ, আজ অর হাটতে হবেনা ইত্যাদি ইত্যাদি"। এছাড়া ,দেরি করে রাতের খাবার খাওয়া, রাত জেগে টিভি দেখা তো নৈমিত্তিক ব্যাপার। আর সাপ্তাহিক ছুটির দিনের হিসাব তো একেবারেই আলাদা। ছুটির দিনে অনিয়ম না করলে আমরা বাঙালি কীসের? এতে করে ফলটা কি হয়? মনের অজান্তেই নিজের অনেক ক্ষতি করে ফেলি। তবে এই ধরনের ক্লিনিকের সন্ধান পাওয়ায়, মনে না চাইলেও সবকিছু নিয়ম মেনেই চলতে হয়। আর এতে করে লাভ কিন্তু রোগীরই বেশি।
তবে একটা কথা মনে রাখা দরকার, হৃদরোগ প্রতিরোধযোগ্য এবং ব্লকেজ বা ধমনী প্লেক ধীরে ধীরে কমিয়ে আনা সম্ভব এই ব্লক কিন্তু রাতারাতি তৈরি হয়না। বছরের পর বছর অথবা কয়েক দশকও লাগতে পারে। কাজেই এটা হতেও যেমন সময় লাগে, আবার যেতেও তেমনই সময় লাগে। তবে অসম্ভব কিছু নয়। এরজন্য প্রয়োজন স্বাস্থ্য সচেতনতা। স্বাস্থ্য সচেতনতা কোনো রকেট বিজ্ঞান নয়। আমরা সকলেই এ সম্পর্কে জানি, কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের কোনো দৃশ্যমান উপসর্গ না থাকে, আমরা কেবল এটি উপেক্ষা করে যাই এবং প্রায়শই এরজন্য উচ্চ মূল্য দিতে হয়। আমি মনে করি, আমার মতো একজন অলস এবং বসে থাকা লাইফ স্টাইলযুক্ত হার্টের রোগীর জন্য ওপরে উল্লিখিত ওয়ান স্টপ শপ একান্ত প্রয়োজন, যা আমাদেরকে সঠিক জিনিসগুলো যেমন- প্রতিদিন হাঁটা, খাবারের জন্য ভাল পরামর্শ, রক্তচাপ পর্যবেক্ষণ, রুটিন করে চলার জন্য তাগিদ দেয়। ল্যাবরেটরি পরীক্ষা এবং হার্ট সংক্রান্ত পরীক্ষা ইত্যাদি করতে সাহায্য করবে এ ধরনের ক্লিনিক। এতে করে আমরা এই গবেষণা বান্ধব কার্ডিওলজি ক্লিনিকের সাহায্য নিয়ে বড় যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটার পূর্বেই তা ঠিক করতে সক্ষম হবো।
- ড. মুহাম্মদ মোর্শেদ- একজন ক্লিনিকাল মাইক্রোবায়োলজিস্ট এবং প্রধান, জুনোটিক রোগ এবং উদীয়মান প্যাথোজেন, বিসি সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল, ভ্যাঙ্কুভার এবং ক্লিনিকাল অধ্যাপক, প্যাথলজি অ্যান্ড ল্যাবরেটরি মেডিসিন বিভাগ, ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়।