অভিনব নামের কড়চা
এক বন্ধুর মামা মারা যাওয়ার পর সে পত্রিকায় শোকসংবাদ দেবে বলে মনস্থ করলো। শোকার্ত অবস্থায় যখন তার মামার নাম আমাদের জানালো, নাম শুনে সেই পরিবেশেও সবাই হেসে উঠেছিলাম; কারণ ভদ্রলোকের নাম রেডিও। উনি ওনার এলাকায় রেডিও নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। ওনার নাম কে, কেনো রেডিও রেখেছিলেন, তা জানা না গেলেও এটা জানা গেল যে, এই নামের জন্য জীবদ্দশায়ও তাকে বেশ হাসির মুখে পড়তে হয়েছিল।
একবার গ্রামের বাড়ি থেকে ফেরার পথে এক ছেলের সঙ্গে পরিচয় হলো, ওর নাম ফিনিস। নাম শুনে চমকে ওঠার পর জানলাম ফিনিসের আরো দুই ভাইয়ের নাম চারমিং এবং চয়েজ। ও যেহেতু বাবা-মায়ের শেষ সন্তান, তাই নাম ফিনিস। অবাক হয়ে গেলাম এই ভেবে যে, সন্তানের নাম ফিনিস রাখার পক্ষে এটা কোনো যুক্তি হতে পারে? বাবা-মা বা পরিবার যখন কারো নাম রাখেন, তখন নাম রাখার পেছনে অদ্ভুত কারণ ও যুক্তি কাজ করতেই পারে। কিন্তু এই নামগুলো নিয়ে সন্তান বড় হয়ে বা বড় হওয়ার সময় নানান ধরনের হাস্যরসের মধ্যে পড়তে পারে, এটা হয়তো তারা ভাবেনই না।
অবশ্য সবসময় যে বাবা-মায়েরা অদ্ভুত নাম রাখেন, তা কিন্তু নয়। মাঝেমধ্যে সন্তান নিজেও তার কাজের মাধ্যমে উপাধি ধারণ করে। আশি ও নব্বই দশকের সাড়া জাগানো মাস্তান ছিল 'মুরগি মিলন'। পকেটে রিভলভার নিয়ে ঘুরতে দেখেছি তাকে। এই যে তার নাম মুরগি মিলন হয়েছিল, তা কেনো? সে কথাই বলছি।
ভুতের গলিতে সত্তরের দশকের শুরুতে যে বাসায় আমরা থাকতাম, সেখানে উঠানে আম্মা হাঁস, মুরগি পালন করতেন। আমাদের বাসার পেছনে একটা বস্তিতে মিলন নামে ছোট একটি ছেলে থাকতো। ওর কাজই ছিল পাড়ার বিভিন্ন বাড়ি থেকে হাঁস মুরগি চুরি করা। এভাবেই মুরগি চুরি করতে করতে একসময় তার নাম হয়ে গিয়েছিল 'মুরগি মিলন'। পরবর্তীতে ডাকসাইটে মাস্তান হলেও নাম কিন্তু থেকে গিয়েছিল সেই মুরগি মিলন।
আমার ফুপাতো বোন জলি আপার আকিকা দেওয়া নামটি ছিল ৯ শব্দের। ১৯৬৩ সালে তার জন্মের পর বিভিন্ন তরফ থেকে ফুপু-ফুপা মেয়ের সম্ভাব্য নাম সংগ্রহ করলেন। প্রায় ২৫/৩০ টির মত নাম জমা পড়ল। তারপর শুরু হলো নাম যাচাই-বাছাইয়ের পালা। ফুপু তাঁর আত্মীয়দের দেওয়া নাম বাদ দেবেন না বলে জানিয়ে দিলেন, ওদিকে ফুপাও তার পরিবারের দিক থেকে দেওয়া নাম ফেলতে দেবেন না।
কাজেই ৯ শব্দের লম্বা নামের এই দায় বহন করতে হল জলি আপাকে। ফুপু-ফুপা সবার দেওয়া নামের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে জলি আপার যে কাগুজে নামটি রাখা হলো, তা রীতিমত আরবি সাহিত্যের অংশ বলা যায়, 'বেগম আওয়াবে মুয়াজ্জাদা ফেরদৌসি জাকিয়া কাঞ্জুন জাহান সুলতানা ফারুক'। অবশ্য এই নামের কোনো মানে কারো জানা ছিল না। শুধুমাত্র ওর বাবা-মা পাল্লা দিয়ে এই নাম রেখেছিলেন। বেচারা জলি আপা তার শিক্ষাজীবনে এই নামকে সংক্ষেপে লিখতো- 'এএমএফজেকেজে সুলতানা ফারুক', পেশাগত জীবনে হলো এডভোকেট সুলতানা।
এই বিচিত্র নামগুলোর কথা বহুদিন পরে মনে হলো বাংলাদেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি জনাব মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর নামটা মিডিয়াতে দেখার পর থেকে। ওনার এই ডাক নাম 'চুপ্পু' নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াসহ, অফিস, আদালত, শিক্ষাঙ্গনে বেশ আলোচনা চলেছে। যে সাংবাদিকগণ ওনাকে চেনেন তারা সরাসরি চুপ্পু ভাই নামেই অভিনন্দন জানাচ্ছেন। অনেকেই অবশ্য বলছেন ছোটবেলায় দেওয়া এই নামে কী আসে-যায়, কাজই একজন ব্যক্তির আসল পরিচয়।
তা অবশ্য ঠিক, কারণ সাংবাদিকতা বিভাগের দুজন অসাধারণ শিক্ষকের নাম অধ্যাপক ক আ ই ম নুরুদ্দীন এবং অধ্যাপক ড. আ আ ম শ আরেফিন সিদ্দিকী। স্যারদের এই দীর্ঘ নাম নিয়ে ছাত্রছাত্রীরা সবসময় মজা করতাম। প্রিয় নুরুদ্দীন স্যারকে ছোট করে বলতাম বর্ণমালা নুরুদ্দীন স্যার। স্যারদের নাম নিয়ে আমরা যতোই মজা করিনা কেনো, ওনারা খুব জনপ্রিয় শিক্ষক ছিলেন।
সে যাক, বাচ্চা নামে আমাদের এক ভাই ছিলেন। বাচ্চা ভাইয়ের বয়স যখন প্রায় ৩০ বছর, একদিন শুনলাম ওনার বিয়ে ঠিক হয়েছে। বিয়ের দুদিন আগে বাচ্চা ভাই এক প্যাকেট খাসির মাংস নিয়ে এলেন বাসায়। আম্মা চমকে উঠে জিজ্ঞাসা করলেন, কী রে? তোর কি বিয়ে হয়ে গেছে? এটা কি সেই মাংস? বাচ্চা ভাই লাজুক কন্ঠে উত্তর দিলেন, "না খালা, এটা আমার আকিকার মাংস। কোনো এক কারণে ছোটবেলায় আমার আকিকা হয় নাই। কিন্তু শুনলাম আকিকা ছাড়া শুধু বাচ্চা নামে বিয়ে হয় না। তাই এই আকিকা দেওয়া হয়েছে।"
আমাদের সেই জলি আপার একমাত্র ভাইটির নাম আইনুল ওয়াহাব মোহাম্মদ বদরুল মুলক খাঁন ওরফে দুলাল। নামের বরকতে দুলাল ভাই তার গোঁফটিও রেখেছিলেন বেশ খাসা; দুইপাশে যথেষ্ট বড় এবং প্যাঁচানো। কারণ বদরুল মুলক খাঁন সারাদিন তার গোঁফ পাকাতেন। মায়ের আদরের আতিশায্যে ওনার আচার আচরণও হয়ে উঠেছিল বেশ নবাবের মতোই।
এই বদরুল মুলক খাঁন সাহেবের আরেক বোনের নামও কম খানদানি নয়, তার নাম আনাবে জান্নাত হুরুম ইনুনা খানম ওরফে দুলি। এখানেই শেষ নয়, আমার ছোট ফুপুর নাম- গোলে হাইয়া ছাল-ছাবিলা খানম; ডাক নাম হিয়া। এরই সাথে ছন্দবদ্ধ নাম রাখা হল মেজ ফুপুর মেয়ের- আছালুন নাঈমা জান জাবিলা খানম, দিপ্তী। এদের প্রত্যেকের নাম একবারে বলা ও শেখার মতো ক্ষমতা প্রায় কারোই ছিল না, সবাইকেই সময় নিয়ে শিখতে হয়েছে। তাদের শিক্ষা ও কর্মস্থানে নানাধরনের মজার ঘটনাও ঘটেছে নামের এই অভিনবত্ব দেখে।
পিছিয়ে ছিলনা পরিবারের অন্য ভাইবোনদের নামও। হিলালী গুল ওয়াদুদ, হিলালী হুজ্জাত মোহাইমেন আর বেগম মাওজুদা মুলকান কাবিরা (মাজু)। আরেকটি প্রায় জটিল নাম ছিল শাহীদ আহমেদ লেওয়াজ হিল্লা এবং দৌলত দায়েন রাফে। তাঁরা অবশ্য পরে নিজেদের নামের কিছুটা কাটছাঁট করেছেন, যাতে নাম শুনে মানুষে ভিরমি না খায়।
এই নামগুলো যিনি রেখেছেন তিনি আর কেউ নন, আমাদের দাদা। কী কারণে নাতি নাতনিদের নাম রাখার ক্ষেত্রে এরকম জটিল শব্দাবলী বা বাক্য ব্যবহার করেছিলেন, তা অবশ্য বলতে পারবোনা। তবে শুনেছি এসব নামের খুব ভাল অর্থ আছে। উনি যেহেতু আরবি, ফারসি, সংস্কৃত ও ইংরেজির পণ্ডিত ছিলেন, কাজেই প্রতিটা নামই বিভিন্ন কিছু ঘেঁটে রেখেছেন। ওনার কাছে নামের অর্থটাই বড় ছিল, উচ্চারণটা নয় ।
স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং কাজের জায়গায় এই নামগুলো নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা ও ঝামেলার মুখে পড়লেও এই নামধারীদের কেউই নামগুলো নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেনি। মানুষ ছোটবেলা থেকেই নিজ নামের সাথে পরিচিত হয়, অভ্যস্ত হয়। তাই হয়তো আজব নামকেও পরিচিত ও সহজ মনে হয়। আর একথাও ঠিক যে, মানুষ অনেক বড় পদে অভিষিক্ত না হলে বা দেশজোড়া নাম ছড়িয়ে না পড়লে হয়, সেই নাম নিয়ে তেমন কোনো আলোচনাও হয়না।
পরিচিত মানুষের মধ্যে চকলেট, কাটলেট, বুলেট, রকেট, কলম, মলম- এমন নামও যেমন শুনেছি, তেমনি কেনেডি, রিগ্যান, নিক্সন, লিংকন নামের মানুষও দেখেছি। আত্মীয়দের মধ্যে ছিল বেদানা, কমলা, লেবু, লিচু, ডালিম এই নামগুলো। শুধু কি তাই? নাম ছিল ফিলিপাইন, ম্যানিলা, লাহোর, করাচি ও জাপান। হঠাৎ করে কেউ যদি শোনেন, যে কাউকে ফিলিপাইন সাহেব, লাহোর ভাই বা করাচি আপা নামে ডাকা হচ্ছে, অবাক না হয়ে পারা যায় না।
একজন গৃহকর্মীর সঙ্গে পরিচয় হলো, যার নাম পেশোয়ার। কেনো হঠাৎ ওর নাম পেশোয়ার রাখা হলো জানতে চাইলে বললো, ওর দাদা কোনো এক সময় পেশোয়ারে গিয়েছিলেন। তাই শখ করে নাম রেখেছেন 'পেশোয়ার'। কিন্ত এলাকার মানুষজনের পেশোয়ার সংক্রান্ত কোনো ধারণা নেই বলে ডাকেন 'হেসু'। আমাদের কলোনিতে ১১ ভাইবোনের যে পরিবার ছিল, তাদের চারজনের নাম ছিল নান্টু, ভুটিয়া, ইরান, বড় খোকা ও ছোট খোকা।
ছন্দবদ্ধ নাম নিয়ে আলোচনা করার সময় একজন মুরুব্বী দাবি করলেন, ওনার ভাইদের নামই সবচেয়ে ছোট ও ছদ্মবদ্ধ, যেমন: টুকু, টুনু, রুনু, জুনু, বুনু। এক বাসায় বেড়াতে গিয়ে ভাইবোনদের নাম দেখলাম তুলা, পাতা, ফুল ও ফল।
শুধু কি পরিবারের সদস্যদের নাম? আরো আজব নাম আছে পরিচিত বলয়ে, এদের প্রায় সবাই গ্রামে বসবাস করেন বা করতেন। যেমন- হ্যাদলা, গ্যাদলা, চেপ্টি, শিয়ালু, মঙ্গলু, দ্যালেদ্দ মুন্সী, হজো, দই এরকম সব নাম। একবার দুটি শিশুর সঙ্গে পরিচিত হলাম, যাদের নাম বালক ও বালিকা। এলাকাতেই দুইজন মামার নাম দেখলাম 'বলে' ও 'মশা'; সবাই ডাকছে মশা মামা ও বলে মামা।
দেশের বাড়ি রংপুর থেকে ৮৭/৮৮ সালের দিকে আমাদের বাসায় একটি ছোট ছেলে এলো আব্বার সহকারি হিসেবে। ওর মূল কাজ ছিল আব্বার সাথে বাজারে-দোকানে যাওয়া আর আমার ভাইয়ের সঙ্গে পড়াশোনা করা। বাড়িসুদ্ধ লোক ওকে অক্ষরজ্ঞান দিতে গিয়ে হয়রান হয়েছে মাত্র, একটি লাইনও শেখানো যায়নি। ওর নাম ছিল ঢ্যাড়া। ঢ্যাড়ার একটাই দোষ ছিল, চুরি করে খাওয়া।
ঢ্যাড়ার ভাষায়, "মোর বাপ মোক চুরি কারা শিখাইছে। মোর বাপও চোর ছিলে, নাম বড় ঢ্যাড়ামদ্দী। বাপের সাথোত থাকি মুইও শিখছি। ওমরালা মোক হাটোত ধরি যাইতো, মাছ চুরি কইরবার তানে। চুরি কইরবার পাইল্লে খাওয়ান পাইতাম, না পাইল্লে খায়োনও নাই।"
নামের এই অভিনবত্ব বিশ্বের অনেক ভাষাতেই আছে। কাজেই ব্যক্তির নাম যাই-হোক, কাজেই হোক তার পরিচয়।
- লেখক: যোগাযোগকর্মী