যে কারণে ইউক্রেন চীনের শান্তি পরিকল্পনাকে গ্রহণ করতে পারে
রোনাল্ড রিগান থেকে শুরু করে ডোনাল্ড ট্রাম্প পর্যন্ত – যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্টদের প্রশাসনে শীর্ষ সেনানায়ক, গোয়েন্দা কর্মকর্তা যারা ছিলেন – সম্প্রতি তারা বেসরকারি এক চিন্তক সংস্থার আয়োজিত আলোচনা সভায় অংশ নেন। যেখানে সমর পণ্ডিতেরাও যোগ দেন। তারা ইউক্রেন যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করেন। বিশ্লেষণে কিয়েভের জয়ের সম্ভাবনা ম্লান বলেই জানান তারা।
একজন বক্তার মতে, যখন দক্ষ সেনা ও দরকারি গোলাবারুদের অভাব ইউক্রেনের যুদ্ধ প্রচেষ্টার পায়ে কুড়াল মারছে, তখন প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি চীনের প্রস্তাবিত শান্তি পরিকল্পনাটি বিবেচনায় নেওয়ার বিষয়ে আগ্রহী হতে পারেন। এই সম্ভাবনা অনেকটাই বেড়েছে চীনের আরেক কূটনৈতিক সাফল্য – সৌদি আরব-ইরানের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনস্থাপনের চুক্তির প্রেক্ষিতে। মধ্যপ্রাচ্যের চিরবৈরী দেশ দুটির মধ্যে এ চুক্তি সম্পাদনে দীর্ঘদিন পর্দার আড়ালে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা রাখে বেইজিং।
প্রভাবশালী চিন্তক সংস্থা চ্যাথাম হাউজ এ আলোচনার আয়োজক ছিল। আলোচনায় যারা যোগ দেন তাদের কেউ কেউ সাবেক প্রেসিডেন্টদের মন্ত্রিসভায় ছিলেন, কেউবা ছিলেন প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রী পর্যায়ে। চ্যাথাম হাউজের নিয়মানুসারে, অংশগ্রহণকারীদের পরিচয় স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখ না করেই – তারা যে বিষয়ে আলোচনা করেছেন তার সারবস্তু তুলে ধরা হয় (যে কারণে আমিও নিজের পুরো নাম-পরিচয় উহ্য রাখছি)। অন্তত কয়েক ডজন সাবেক কর্মকর্তা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
অংশগ্রহণকারীদের বেশিরভাগই আরও অস্ত্র সহায়তার মাধ্যমে সংঘাতকে আরও তীব্র করে তোলার পক্ষে মত দেন। তবে একজন বিশিষ্ট বিশ্লেষকের প্রস্তাব ছিল, বিভিন্ন দেশের বিদেশি যোদ্ধাদের একটি বাহিনী গঠন করে ইউক্রেনে পাঠানো, যাতে তাদের দক্ষ সেনা ঘাটতি পূরণ হয়।
অর্থাৎ, তাদের বেশিরভাগই রাশিয়ার ওপর চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের জন্য সব ধরনের ঝুঁকি নেওয়ার পক্ষে মত দেন। গত বছরের ১৭ মে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে রাশিয়া ইউক্রেনে পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার করতে পারে। এই উদ্বেগটি অনেকেরই। অথচ সে কথা আলোচনায় কেউ একবারও উচ্চারণ করেনি।
এক কথায় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ যে বৃহত্তর সংঘাতে রূপ নিতে পারে সেদিকটি গুরুত্বই পায়নি। বরং তাদের হতাশা ছিল, পশ্চিমারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি নিলেও – ইউক্রেনের পক্ষে যে রাশিয়াকে পরাজিত করার সম্ভাবনা খুবই কম – তা নিয়ে।
তবে সম্মেলনের শেষ পর্যায়ে একজন শীর্ষ উপস্থাপক বলেন, যদি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট চীনের শান্তি পরিকল্পনা গ্রহণ করেন তাতে আমাদের আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কারণ সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে চীন সফলভাবে মধ্যস্ততা করবে – এটাও পশ্চিমা দুনিয়ায় আমরা কেউ ধারণা করতে পারিনি।
ওয়াশিংটন চীনের পরিকল্পনাকে নাকচ করে দিলেও, জেলেনস্কি করেননি। চীনের প্রস্তাব অনুসারে, রাশিয়া আজভ সাগর এবং সমগ্র ডনবাস অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ পাবে। ইউক্রেন যখন জনবল ও গোলাবারুদের স্বল্পতায় ভুগছে তখন এই প্রস্তাব গ্রহণে বাধ্যই হতে পারে। ওই বিশেষজ্ঞ বলেন, চীন সম্পর্কে 'আদিম' ধারণা রয়েছে আমেরিকার, এজন্য চীনের দক্ষতাকে খাটো করে দেখে।
ইউক্রেনের যেসব এলাকা রাশিয়া ইতোমধ্যে দখল করেছে, তার ওপর মস্কোর নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকবে এমন প্রস্তাব দিয়ে চীনা উদ্যোগে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানো হয়, যা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের একজন মুখপাত্র নাকচ করে দেন।
অথচ পশ্চিমা হিসাবেই, যুদ্ধে এ পর্যন্ত রাশিয়ার যতজন সেনা হতাহত হয়েছে, তার দুই-তৃতীয়াংশ সমপরিমাণ ইউক্রেনেরও হয়েছে। যদিও দেশটির জনসংখ্যা রাশিয়ার এক-তৃতীয়াংশ মাত্র। ফলে দীর্ঘমেয়াদে বিপুল হতাহতের ভার বহন করতেও পারবে না দেশটি। বহু বছর ইউক্রেনে কাটিয়েছেন এমন একজন পশ্চিমা বিশেষজ্ঞই এ মতপ্রকাশ করেন।
২০১৪ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত রুশ আগ্রাসনের আন্দাজ করে যে সেনাবাহিনীকে ন্যাটো প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রস্তুত করেছিল তা এখন মৃত। মাত্র তিন সপ্তাহের সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে সদ্য ভর্তি হওয়া সেনাদের যুদ্ধের মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
ব্যাপারটা এমন নয় যে ইউক্রেনের জনসংখ্যায় ঘাটতি হচ্ছে, বিষয়টা হচ্ছে যুদ্ধের কাজে কোন ধরনের জনশক্তিকে ব্যবহার করতে হচ্ছে। এতে সেনাবাহিনীর মানের ভীষণ অবনতি হয়েছে। তাছাড়া, কর্মক্ষম জনসংখ্যাকে এভাবে লড়াইয়ে পাঠালে দেশটির বেসামরিক অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলো ধসে পড়বে।
ওই বিশেষজ্ঞ জানান, রাশিয়ার দেড় থেকে দুই লাখের বিপরীতে ইউক্রেনের এক লাখ ২০ হাজার সেনা নিহত বা গুরুতর আহত হয়েছে; এই ক্ষতি তাদের পক্ষে 'অপূরণীয়'।
যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য সমর বিশ্লেষকেরা ইউক্রেনের হতাহতের সংখ্যা আরও উচ্চ বলে ধারণা করেন; সর্বোপরি কৌশলগতভাবে তারা একই উপসংহার টেনেছেন, আর তা হলো – শক্তিক্ষয়ের এই যুদ্ধে রাশিয়ারই জয় হবে।
যেমন ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর একটি ব্যাটালিয়ন গত জানুয়ারিতে ৬০০ সেনা হারায়। এর পরিবর্তে ৭০০ নতুন সেনা পায় তারা। আবার ফেব্রুয়ারিতে তাদের ৮০০ সেনা হতাহত হয়, অর্থাৎ দুই মাসে হতাহতের হার প্রায় ৬০ শতাংশ।
যুদ্ধের সম্মুখভাগে ইউক্রেনীয়রা শত্রুর প্রতিরোধ ব্যুহ ভেঙে এই অচলাবস্থার অবসান ঘটাবে – এমন সম্ভাবনা কম। তাছাড়া, ইউক্রেনের বসন্তকালীন আক্রমণ অভিযানের আশা করা হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে, যার জন্য প্রতিরোধ তৈরির যথেষ্ট সময় পেয়েছে রাশিয়া। এসব ব্যুহ ভেঙে এগোতে হলে ইউক্রেনের অন্তত ৬৫০টি সর্বাধুনিক মেইন ব্যাটেল ট্যাংকের পাশাপাশি এক হাজার সাঁজোয়া যান দরকার।
চ্যাথাম হাউজের আলোচনায় জ্যেষ্ঠ আরেক মার্কিন সেনানায়ক মতপ্রকাশ করেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত ইউক্রেনে ১,০০০ আব্রামস ট্যাংক পাঠানো। দেশটিকে এমন অস্ত্র দিতে হবে যা রাশিয়ার অভ্যন্তরে আঘাত হেনে লক্ষ্যবস্তু ধবংস করতে পারবে। 'রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলা করা যাবে না বলে যুক্তরাষ্ট্র যে কৃত্রিম সীমারেখা নির্ধারণ করেছে, সেটা বাতিল করতে হবে। কারণ, রাশিয়াও রণাঙ্গনের অংশ,' যোগ করেন তিনি।
এই মন্তব্যের প্রতিবাদ করে পেন্টাগনের সাবেক এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, ইউক্রেনকে ত্রাণ দেওয়ার বিষয়ে আমেরিকার রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতা আছে। আজ থেকে দুই বছর পর্যন্ত যদি আমরা দেশটিকে বিপুল পরিমাণ ত্রাণ না দিতে পারি, তাহলে এখনই তা বন্ধ করে নিজেদের ক্ষতিটাকে সীমিত রাখা উচিত।
পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষক এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক একজন জ্যেষ্ঠ পরামর্শক উল্লেখ করেন যে, বাধ্য হলে পুতিন ১৭ লাখ রিজার্ভ সেনা তলব করতে পারবেন। 'কৃষ্ণসাগরে রাশিয়ান যুদ্ধজাহাজ ডোবানো বা রাশিয়ার অভ্যন্তরে টার্গেট ধবংস করাটা বেশ উপভোগ্য মনে হতে পারে; কিন্তু তাতে ইউক্রেনের ওপর চাপ কোনো অংশেই কমবে না।
এটা অনেকটাই আমেরিকার গৃহযুদ্ধের মতো এক সংঘাত। যেখানে দক্ষিণের কনফেডারেট রাজ্যগুলো বেশ কার্যকরভাবে লড়লেও, দিনশেষে উত্তরের বিপুল পরিমাণ জনবল ও গোলাবারুদের শক্তির কাছে তাদের হারতে হয়েছে। এমনকি ১৮৬৫ সাল নাগাদ দক্ষিণের কাছে তাদের রাজধানী রিচমন্ডকে রক্ষা করার মতো যথেষ্ট সেনাও ছিল না।' এই বাস্তবতায়, তিনি আন্তর্জাতিক সামরিক স্বেচ্ছাসেবকদের একটি বাহিনী গঠন করে ইউক্রেনে পাঠানোর পরামর্শ দেন।
সাবেক আরেক উচ্চপদস্থ পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারক কর্মকর্তা চীনের পক্ষ থেকে রাশিয়াকে দেওয়া সহায়তা সীমিত করতে দেশটিকে নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দেওয়ার প্রস্তাব করেন। তার মতে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরোপিত নিষেধাজ্ঞাগুলো সেভাবে কার্যকর না হলেও, চীনের ক্ষেত্রে তা ভিন্ন হবে। কারণ, দেশটি বিশ্ব অর্থনীতিতে অনেক বেশি সম্পৃক্ত।
তিনি বলেন, চীনেও অনেকের মধ্যে রাশিয়া-বিরোধী মনোভাব রয়েছে। রাশিয়াকে সাহায্য করার বিনিময়ে কষ্ট পেতে চাইবে না চীনের জনতা। তাছাড়া, চীন ও ইউক্রেনের মধ্যে অংশীদারত্বের সম্পর্ক আছে।
এর বিপরীতে আমি যা বলেছি তা হলো – বিশ্ব এক নতুন মেরুকরণের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, যার সূচনা করেছে ইউক্রেন যুদ্ধ। দেশগুলো নতুন জোট গড়ছে, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এক মেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা দুর্বল হচ্ছে। চীন-ইরান-সৌদি আরবের চুক্তি তারই উদাহরণ। ইউক্রেনে আমেরিকা যে ভুলগুলো করেছে, তাতে সৌদি আরব উপলদ্ধি করেছে যে, তাদের রক্ষায় মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক হস্তক্ষেপ করবে না আমেরিকা। এজন্য তারা নতুন মিত্রের সন্ধান করছে।
চীন ও রাশিয়ার বাণিজ্যের মাধ্যম হয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে তুরস্ক। উপসাগরীয় দেশগুলোর পাশাপাশি ইসরায়েলের সাথেও সম্পর্কের উন্নতি করেছে আঙ্কারা। অন্যদিকে, ভারতকে আমরা চীনের বিরুদ্ধে মিত্র হিসেবে ভাবলেও, দেশটি রাশিয়ার তেলের বৃহৎ ক্রেতায় পরিণত হয়েছে। একইসঙ্গে, চীনের সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধি করছে। এখন দেশটির তেল-বহির্ভূত আমদানির ৩০ শতাংশ চীন থেকে আসছে।
অন্যদিকে, রাশিয়াকে সঠিকভাবে আমলে নিতে না পারার কারণেই বিশ্বব্যাপী আমেরিকা ব্যাপকভাবে প্রভাব-প্রতিপত্তি হারাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, ইউক্রেনকে যথেষ্ট পরিমাণ কামানের গোলা সরবরাহের শিল্প সক্ষমতাও আমাদের নেই। এই বাস্তবতায়, অনতিবিলম্বে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করাই হবে সঠিক নীতি।
যুদ্ধবিরতি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অপমানজনক হলেও তা প্রশংসনীয় পদক্ষেপ হবে। রাশিয়ার আগেই ১৯৭০-এর দশকে আমরা ভিয়েতনামের কাছে অপদস্থ হয়েছি। ভিয়েতনামে পরাজয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা নীতিকে আমূল ঢেলে সাজানোর সুযোগ করে দেয়, যার ফলে স্নায়ুযুদ্ধে বিজয়ী হয় আমেরিকা। তাই হয়তো পুতিন আমাদের অপদস্থ করে আসলে উপকারই করছেন।