যে কারণে বিশ্বের আর্থিক খাতে ডলারের ওপর আস্থা কমছে
বৈদেশিক মুদ্রা মজুতে মার্কিন ডলারের অংশ কমিয়ে চলেছে চীন। রাশিয়ার সাথে বাণিজ্যেও রমরমা বাড়ছে চীনা মুদ্রা ইউয়ানের। এই বাস্তবতায়, ডলারের ক্রমাগত পতনের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে কিনা তেমন প্রশ্ন তোলা অর্থনীতিবিদদের সংখ্যাও বাড়ছে।
অবশ্য, মহামহিম ডলারে বিশ্বাস সকলে হারাচ্ছেন এমনও তো নয়; অনেকেই আছেন যারা এখনো হুমকির কিছু দেখছেন না। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাতজন সম্ভবত নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ পল ক্রুগম্যান। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের এই কলামিস্ট মনে করছেন, 'ডলারের আধিপত্য কোনো হুমকির মধ্যে নেই'।
সন্দেহ নেই পল তার সময়ের অর্থনীতিবিদদের মধ্যে অন্যতম প্রভাবশালী একজন। তবু সবাই কিন্তু এতোটা নিশ্চিত হতে পারছেন না। হবেনই বা কীভাবে– যখন এশিয়ার সবচেয়ে বড় অর্থনীতি (চীন) তার সম্পদের ভাণ্ডারে মার্কিন ট্রেজারি সিকিউরিটির পরিমাণও কমাচ্ছে। গত জানুয়ারিতে যা টানা ছয় মাসের ন্যায় কমায় বেইজিং। অবশ্য, এই তথ্য শুধু জানুয়ারি পর্যন্তই প্রকাশ করা হয়েছে। পরের দুই মাসের তথ্য এখনো অপ্রকাশিত। সেখানেও একই চিত্রের প্রতিচ্ছবি দেখা যাওয়ার ধারণা করা হচ্ছে।
চলতি সপ্তাহেই খবর জানা গেল যে, গেল ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার সাথে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে প্রথমবারের ইউয়ানের আধিপত্য লক্ষ করা গেছে। অর্থাৎ, সিংহভাগ লেনদেন ডলার বা ইউরোতে হয়নি, সেই সোনালী সিংহাসনে বসেছে ইউয়ান। অর্থনীতি ও ভূরাজনীতি দুদিক থেকেই এটি অনেক বড় ঘটনা। এতে প্রথমত ইউয়ানের ওপর রাশিয়ানদের আস্থা উঠে এসেছে; আর দ্বিতীয়ত- বিশ্বের বৃহৎ দুটি দেশের এই সিদ্ধান্ত মুদ্রা বাজারের গতিপ্রকৃতিই বদলে দিতে চলেছে। এতে বিশ্ববাণিজ্যে প্রধান মুদ্রা হওয়ার পথে আরেকধাপ এগোলো গেল ইউয়ান। ফলত; মার্চ মাসে মস্কো এক্সচেঞ্জে ইউয়ান লেনদেন উল্লেখযোগ্য হারে বেশি হয়েছে বলেও জানা গেছে।
ইউয়ানের এই সুহাল কেন, এবং ডলারের কেন দুর্দিন – তা নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনার অন্ত নেই। এরমধ্যে সবচেয়ে যেটা বেশি বলা হচ্ছে, তা হলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সংকটকালে 'ডলারকে আর্থিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা এবং বৈশ্বিক মূল্য পরিশোধ ব্যবস্থাকে (রাজনৈতিক) ইচ্ছানুসারে নিয়ন্ত্রিত করার উদ্যোগ'। যেমনটা উল্লেখ করেন আর্থিক খাতের বৃহৎ বিনিয়োগ সংস্থা– মিলেনিয়াম ওয়েভ অ্যাডভাইজরস এর কৌশলবিদ জন মলডিন। তার মতে, 'এর ফলে অমার্কিন বিনিয়োগকারী ও সরকারগুলো তাদের সম্পদ ভাণ্ডারকে বহুমুখীকরণের উদ্যোগ নেবে, সরে আসবে মার্কিন ডলার থেকে, যা এতদিন সম্পদের নিরাপদ আশ্রয় হিসেবেই পরিচিত ছিল'।
অন্যরা বলছেন, খোদ যুক্তরাষ্ট্রই ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি ঘটতে দিয়েছে। তার সঙ্গে ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারির পর থেকে আমেরিকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিশৃঙ্খলা এবং জাতীয় দেনার সীমা অতিক্রমের ঘটনাগুলো– আমেরিকার ঋণমানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
আরেক প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ মোহাম্মদ এল-এরিয়ান অবশ্য মনে করছেন, প্রধান সমস্যা হলো মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা ফেডারেল রিজার্ভে। ফেড এক্ষেত্রে শুধু অর্থনৈতিক পটভূমিতে ব্যর্থ তাই-ই নয়; একইসঙ্গে বিশ্বের অন্যান্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আস্থাও হারাচ্ছে, যে ভরসাকে ফেড তার চিরন্তন অধিকার বলে বিবেচনা করেছে। ফলে ধরেই নিয়েছিল, ডলার অনন্তকাল বিকল্প অন্যান্য মুদ্রার চেয়ে আকর্ষণীয় থাকবে।
আলিয়াঞ্জের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এল-এরিয়ান বলেছেন, 'ফেডের সমস্যা সবার জন্য উদ্বেগেরই হওয়ার কথা। বিশ্বাসযোগ্যতা হারানোর ফলে আর্থিক স্থিতিশীলতা এবং বাজার পরিচালনার ক্ষেত্রে ফেডের সক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে একইসঙ্গে মূল্য স্থিতিশীলতা রক্ষা এবং যথাসম্ভব সর্বোচ্চ কর্মসংস্থান সৃষ্টির যে ম্যান্ডেট তাদের রয়েছে সেখানেও এই প্রভাব পড়বে'।
২০২১ সালেই রেখাচিত্রে মূল্যস্ফীতির উত্থান ঠেকানোর দিক থেকে পিছিয়ে পড়ে ফেড। অবশ্য তারপর থেকে মুদ্রা প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণের আগ্রাসী পদক্ষেপ নিয়েছে। ১৯৯০ এর দশকের পর এবারই এতটা চড়াভাবে সুদহার বাড়াচ্ছে ফেড, এতে অনেক ব্যাংক সংকটের খাঁদের কিনারে পৌঁছে গেছে।
'আমেরিকার ব্যাংকিং খাতের সাম্প্রতিক ব্যর্থতাগুলো – যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা নিয়ে সংশয়ের জন্ম দিয়েছে' বলে উল্লেখ করেছেন ইনোডো ইকোনমিক্স সংস্থার অর্থনীতিবিদ ডায়ানা চয়লেভা। ইনোডো ইকোনমিক্স চীনের অর্থনীতি এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে তার প্রভাব নিয়ে গবেষণায় গুরুত্ব দেয়। ডায়ানা বলেছেন, 'বৈশ্বিক আস্থাকে দৃঢ় করার উদ্যোগ এখন ওয়াশিংটনের ওপরই বর্তাচ্ছে; এশিয়ার বেশকিছু দেশের জন্য এখন মার্কিন ডলারে উল্লেখযোগ্য ঋণের বন্দোবস্তো করতে হবে'।
'ফেড সুদহার বাড়ানোয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর হাতে থাকা বন্ডের মূল্য কমে যায়। যেমন গত এক বছর ধরে সুদহার বাড়ানোর পর এ বছরে দেউলিয়াত্তের শিকার হওয়া সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকও (এসভিবি) একই অবস্থার শিকার। ফলে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ব্যাংকগুলোকে ঘিরেও এখন দেউলিয়াত্তের উদ্বেগ দেখা দিচ্ছে' তিনি আরো উল্লেখ করেন।
বিশ্বের অন্যতম ব্যাংকিং সংস্থা ক্রেডিট সুইস এর নাটকীয় পতন বৈশ্বিক আর্থিক খাতের অস্থিতিশীলতার এক প্রতিচ্ছবি হয়ে সামনে আসে, বরং এতে যেন তা নৈরাজ্যের উৎসাহই পেয়েছে। চলিয়েভা বলেন, 'চারিদিকে ভাঙ্গন সৃষ্টির যে শক্তিকে ফেড আগল খুলে মুক্তি পাওয়ার সুযোগ দিয়েছে, তার সুদূরবিস্তারী দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব অনেকটা সময় ধরে অনুভব করা যাবে'।
'এশিয়ার ক্ষেত্রে' তিনি মনে করেন, 'বৈশ্বিক আর্থিক খাতে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যকে তীব্র চ্যালেঞ্জ এর মুখে ফেলবে চীন'।
তার অর্থ অবশ্য এই নয় যে, ইউয়ান ডলারের আসন দখল করবে বা এই মুদ্রা সহজে ভাঙ্গানোও যাবে। তেমনটা হতে হলে পিপলস ব্যাংক অব চায়নাকে আগে সম্পূর্ণরূপে কম্যুনিস্ট পার্টির নিয়ন্ত্রণমুক্ত হতে হবে। অথচ ফেডের চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েলের ভুল পদক্ষেপগুলো আর্থিক খাত আগলানোর এই পরিবর্তনকে দ্রুততর করছে। অর্থাৎ, চীন ইউয়ানকে একটি অধিক বিনিময়যোগ্য মুদ্রায় রুপান্তরের পদক্ষেপগুলো নিতে শুরু করেছে।
ফেডের মুদ্রানীতির কারণে মার্কিন অর্থনীতি-ও ভুগছে, যেমন- উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিকারী প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ ব্যাহত হচ্ছে। আর্থিক খাতের ভার সামলাতে ফেড-ই যথেষ্ট– বাইডেন প্রশাসনের এমন ধারণা হয়তো – মুদ্রার সরবরাহ দিকের কার্যকারিতাকে ঘিরে দেখা দেওয়া সংকটকে ঘনীভূত করছে।
ফেডের মুদ্রার সরবরাহ হ্রাসের কৃচ্ছতা নীতি আরো আরো বাণিজ্যিক ব্যাংককে পতনের মুখে ঠেলে দেবে, আর জেরোম পাওয়েলের টিম বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যতই সুদহার বাড়াবেন এটা ততো দ্রুত ঘটবে। একইসঙ্গে, এশিয়াসহ আমেরিকার শীর্ষ ব্যাংকাররাও বিকল্প মুদ্রার বিষয়ে উৎসাহী হতে থাকবেন।
এশীয় দেশগুলোর কাছে মার্কিন সরকারের অনেক দেনা । অর্থাৎ, দেশগুলো বিপুল পরিমাণ ট্রেজারি বন্ড কিনেছে। দেনার এই অংক প্রায় সাড়ে ৩ লাখ কোটি ডলার। এভাবে সবচেয়ে বেশি ঋণ দাতা জাপান, আর তারপরেই চীন। উভয় দেশই অতি-মাত্রায় বৈদেশিক বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল; ফলে সংকটকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলা এবং বাণিজ্যকে সহায়তা দিতে ডলারের পাহাড় জমানোই ছিল এতদিনে তাদের একমাত্র উপায়।
এর আগে ২০০৭-০৮ সালের আর্থিক সংকটকালে– এশিয়া মার্কিন সম্পদে তার বিনিয়োগ করা নিরাপদ কিনা তা নিয়ে সংশয়ে পড়েছিল লেহম্যান ব্রাদার্সের মতো শীর্ষ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিলুপ্তিকালে। ঠিক তার ১৫ বছর পর আবার একই ধরনের এক শঙ্কার মধ্যে পড়েছে দেশগুলো। পার্থক্য এটাই যে, এবার তাদের কাছে বিকল্পের দিকে ছোটার সুযোগ আছে।
সেই বিকল্পের রাস্তা দেখাচ্ছে চীন। ওপেক প্লাস জোটে রাশিয়ার প্রভাব বেড়েছে, সৌদি আরবের সাথে সহযোগিতার সম্পর্ক গভীর হয়েছে মস্কোর। অন্যদিকে, ইরানের সাথে চীনের সম্পর্ক এখন দৃঢ়তর। জ্বালানি বাণিজ্যে ইউয়ান-ভিত্তিক লেনদেন পেতে পারে নতুন মাত্রা। তেল উৎপাদক প্রধান প্রধান দেশগুলো ইউয়ানকে মান্যতা দিলে ডলারের শক্তিহানিই ঘটবে।
তাইওয়ান নিয়েও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের উত্তেজনা চরমে। কট্টর পশ্চিমাপন্থী তাইওয়ানিজ প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েন এর সাথে শীর্ষ মার্কিন কর্মকর্তারা দেখা করছেন, আমেরিকা দিচ্ছে চীনের বিরুদ্ধে একের পর এক প্রযুক্তি নিষেধাজ্ঞা। ফলে সামরিক সংঘাতকে বাদ দিলে একমাত্র আর্থিক যুদ্ধের রাস্তাই খোলা চীনের সামনে, ডলারকে দুর্বল করার উদ্যোগ নিয়ে বেইজিং এক মোক্ষম জবাব দিতে পারবে।
গত ৫ এপ্রিল চীন সরকারের মুখপত্র গ্লোবাল টাইমসের এক উপ-সম্পাদকীয় কলামে বলা হয়, "চীনের পাল্টা ব্যবস্থা হবে প্রত্যয়ী ও শক্তিশালী, উস্কানিদাতারা ছাড় পাবে না।"
কী হবে সেই পাল্টা ব্যবস্থা? চীন কী তার হাতে থাকা বিপুল ট্রেজারি বিল বিক্রি করে দেবে? ২০১১ সালে যখন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তাইওয়ানের সাথে সম্পর্কের উষ্ণতা বাড়াচ্ছিলেন, তখন সে বছরের আগস্টে ট্রেজারি বিল বিক্রির হুমকি দেয় চীন। অর্থাৎ, এই চিন্তা তাদের দীর্ঘদিনের। ওই সময়ে পিপলস ডেইলির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, তাইওয়ানে অস্ত্র বিক্রি অব্যাহত রাখলে, ওয়াশিংটনের বিরুদ্ধে তারই আর্থিক অস্ত্রকে ব্যবহারের এটাই মোক্ষম সময় চীনের জন্য।
মোক্ষম সময় সেটা ছিল না। কিন্তু, এখনকার চেয়ে ভালো সময় আর কখনোই ছিল না ইউয়ানের জন্য। বিশ্ব মুদ্রাবাজারও ইঙ্গিত দিচ্ছে মার্কিন অর্থনীতির ওপর আস্থার ঘাটতি।
২০১১ সালের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় দেনা বাড়তে বাড়তে ছাড়িয়ে গেছে ৩১ লাখ কোটি ডলার। নতুন করে আরো দেনার বোঝা বাড়ানোর বিরোধী রিপাবলিকানরাই এখন কংগ্রস বা প্রতিনিধি পরিষদকে নিয়ন্ত্রণ করছে। মার্কিন জনতার মধ্যে বাইডেনের জনপ্রিয়তা নেমে এসেছে ৪০ শতাংশে। ফলে অর্থনীতির এই খেলায় নামার রাজনৈতিক পুঁজি-ও তার নেই।