‘আমাদের’ নয় ‘আমি’!
কয়েকদিন আগে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচক প্রকাশিত হয়েছে। এখানে ভারতকে কয়েক দফা নামিয়ে ১৫০, পাকিস্তান ১৫৭ এবং বাংলাদেশকে ১৬২তম অবস্থানে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। ১৮২ টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ১৫০। এমনি একটি পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে বিশ্ব গণমাধ্যমের স্বাধীনতার দিকটিও তুলে ধরা হয়। আনন্দবাজার অনলাইন পত্রিকা একটি সংবাদ তুলে ধরেছে; সংবাদ বিশ্লেষণটি প্রকাশ হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে।
আনন্দবাজার অনলাইন পত্রিকায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির যে বিষয়বস্তু তুলে ধরেছে, তা মূলত একটি মেয়ের সুইসাইড নোটকে নিয়ে রঙ্গ রসিকতা। সেই সুইসাইড নোটে হিন্দি ভাষার বানান ভুলের বিষয়টিকে নিয়ে তিনি রসিকতা করলে উপস্থিত দর্শকবৃন্দের মধ্যে হাস্যরোল পড়ে যায়। এ বিষয় নিয়েই লিখেছে আনন্দবাজার পত্রিকা। তাতে একটি তথ্যপ্রকাশ করা হয়েছে, ভারতে প্রতি বছর কত জন আত্মহত্যা করছে। হিসেব মতে দেখা যায়, ২০২১ সালে প্রায় প্রতিদিন ৪৫০ জনের বেশি মানুষ আত্মহত্যা করেছে। বছরে সব মিলিয়ে এনসিআরবির তথ্যমতে, ১ লাখ ৬৪ হাজার ৩৩ জন। আর এ সংখ্যার মধ্যে ৩০ শতাংশের বেশি হলো ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সী তরুণেরা। এখানে এক আত্মহত্যার নোটে হিন্দি ভাষার সঠিকতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর রসিকতা করাকে তীব্র সমালোচনা করেছে আনন্দবাজার পত্রিকা।
সমালোচনায় উপস্থিত দর্শকদের বিষয়টিও উঠে এসেছে। যারা প্রধানমন্ত্রীর এই হাস্য রসে অংশ নিয়েছেন, উল্লাস প্রকাশ করেছেন। সমালোচনায় পত্রিকাটি মহাভারতের উদাহরণ টেনে এনেছে, যেখানে রাজা ভীষ্মকে উপদেশ দেওয়া হয়েছে: শাসককে শব্দ চয়ন করতে বলা হয়েছে মানুষের প্রতি সংবেদনশীলতার জায়গা থেকে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে সরাসরি এই সমালোচনা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার আলোকে যেভাবেই পরিমাপ করা হোক না কেন, ভারতের অবস্থান যে জায়গায়াতেই থাকুক না কেন-- আনন্দবাজার পত্রিকার এই সংবাদ বিশ্লেষণ বা সমালোচনা প্রকাশ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেও ঠিক এরকম নানান বিষয় নিয়ে রঙ্গরসিকতা হতে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু দেশের গণমাধ্যমের সেসব রসিকতার সমালোচনা করার সাহস অথবা দুঃসাহস কোনোটাই নেই। সেদিক থেকে ভারতের গণমাধ্যমের প্রতি একটু হলেও শ্রদ্ধা বৃদ্ধি পেল ভারতের এই পত্রিকাটির এমন একটি বিষয় নিয়ে সমালোচনা প্রকাশ করায়, যে খবরের সঙ্গে সরাসরি প্রধানমন্ত্রী জড়িত।
আমাদের দেশে এই সমস্ত বিষয় নিয়ে যদি কোনো আলোচনা-সমালোচনা করা হয়, তা পত্রিকায় যেমন প্রকাশ হবে না, তেমনি অনলাইন মিডিয়ায় প্রকাশ হলেও তা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। দেশের আগামী প্রজন্মকে শেখানো হয় কেবল 'আমি'; এবং 'আমরা' শব্দটির অনুপস্থিতি। এই আমিত্ব প্রকাশই দেশের সামগ্রিক সামাজিক কাঠামোকেই প্রকাশ করে।
স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় সর্বস্তরেই 'আমি' শেখানো হয় 'আমাদের' পরিবর্তে। এছাড়া, গণমাধ্যমের মালিকানার চরিত্রের দিকেও যদি আমরা দেখি বর্তমানে প্রায় শতভাগ গণমাধ্যমের মালিকানা হচ্ছে দেশের শিল্পগোষ্ঠীর কাছে, রাজনৈতিক নেতাদের কাছে । যারা প্রকারান্তে সরকার ব্যবস্থার অঙ্গ বটে।
গণমাধ্যমের অবস্থান যেখানেই থাকুক না কেন, বাস্তব চিত্র যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা দৈনন্দিন গণমাধ্যমের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। এদেশে কয়েক শ সংবাদ কর্মীর জন্ম হয়েছে, বিভিন্ন ধরনের গণমাধ্যম হয়েছে, কিন্তু সংবাদমাধ্যমের অবস্থা কি দাঁড়িয়েছে তা হয়তো লিখে প্রকাশ করা সম্ভব না।
পাকিস্তানের তেইশ বছর আর পরবর্তীকালে বাংলাদেশের এই ৫০ বছর, এই সময়ে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, সক্ষমতা, গণমাধ্যম কর্মীদের ব্যক্তিত্ব এসব বিষয় নিয়ে যদি কোনো গবেষণা হতো তাহলে দেশের মানুষ বুঝতে পারতেন প্রকৃত অবস্থাটা কী? প্রয়াত বহু সংবাদকর্মীর নাম সমাজে ছড়িয়ে আছে, যাদেরকে এখনো শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়। বর্তমান প্রজন্মের সংবাদকর্মীরা কি সেই সম্মান অর্জন করতে পারছেন? এটাও আজকের বড় একটা প্রশ্ন। ভবিষ্যতের প্রজন্মের কাছে বর্তমানের সংবাদকর্মীদের ও সংবাদ প্রতিষ্ঠানের অবস্থানটা কোন পর্যায়ে হবে, তা মূল্যায়ন করাও কঠিন।
- বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফল। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।