কেন পার্কে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুরা যেতে পারবে না?
একটি পার্কে যদি একজন শিশু ঢুকতে না পারে, তাহলে সেই পার্ক বন্ধ করে দেয়া উচিত। সেখানে রংপুরের চিকলি পার্কে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু আল আয়মান ইয়ানাতকে ঢুকতে দেয়া হয়নি। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান ১১ বছরের এই শিশুটি সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত।
কন্যা ইয়ানাতকে নিয়ে মা রিজা রহমান সব প্রতিকূলতাকে জয় করে পথ চলেছেন এতগুলো বছর। কিন্তু এবার পার্কে প্রবেশ করতে না পেরে থমকে গেছেন তারা। থমকানোরই তো কথা, কারণ চিকলি ওয়াটার পার্কে গিয়ে ইয়ানাত ও তার মা রিজা রহমানকে শত শত মানুষের সামনে পার্ক কর্তৃপক্ষ অপমান করেছে, হেনস্তা করেছে। আর এর প্রতিবাদ হিসেবে শিশুটির মা রংপুরে সংবাদ সম্মেলন করেছেন। তার দাবি, দেশের আর কোনো বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুকে যেন এমন হেনস্তার শিকার হতে না হয়।
বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর প্রতি এই আচরণ যেমন অমানবিক, মানবাধিকার পরিপন্থী ও ঘৃণ্য, তেমনি স্পষ্টত দেশের সংবিধান ও আইনের পরিপন্থি। চিকলি পার্ক কর্তৃপক্ষ নিষেধ করেছে যে হুইলচেয়ার পার্কের ভেতরে নেয়া যাবে না। অদ্ভুত এক যুক্তি। যারা হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী, বিশ্বের সব দেশে, সবখানে তারা আলাদা সুবিধা পান। এমনকি বাংলাদেশেও অনেক জায়গায় হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী, সাদা ছড়ি ব্যবহারকারীদের জন্য সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলো বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা করছে। সেখানে রংপুরের চিকলি পার্ক কর্তৃপক্ষ এতটা উদ্ধত আচরণ করার সাহস পায় কীভাবে ইয়ানাত ও তার মায়ের সাথে? পার্ক কর্তৃপক্ষের কোনো অধিকার নেই বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পার্কে ঢুকতে না দেয়ার। আমরা এর বিচার দাবি করছি।
'রেইন ম্যান' 'আ বিউটিফুল মাইন্ড', 'মাই লেফট ফুট' এবং 'তারে জামিন পার' এমন কিছু সিনেমা, যা অনেককেই নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছিল ভিন্নভাবে সক্ষম মানুষদের নিয়ে। সিনেমাগুলো যেমন চমৎকার, জীবনঘনিষ্ঠ, তথ্যসমৃদ্ধ, তেমনি ছিল হৃদয়ের ছোঁয়া। সিনেমাগুলো দেখে ঝরঝর করে কেঁদেছি। সেইসাথে সিজোফ্রেনিয়া, সেরিব্রাল পালসি, সেভান্ট সিন্ড্রম ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে এমন ধারণা হলো যা আমার চোখ খুলে দিল এবং অনেক ভুল ধারণা ভেঙে দিল।
বুঝতে পেরেছি সেভান্ট সিন্ড্রমে আক্রান্ত একজন মানুষ, যাকে আমরা খানিকটা অস্বাভাবিক বলে মনে করি, কিন্তু সেই মানুষটাই কতটা বেশি জ্ঞান তার মাথায় ধারণ করতে ও দ্রুত সেই তথ্যগুলো স্মরণ করতে পারেন। দেখলাম শিশুকাল থেকে যে মানুষটি শুধু তার বাম পায়ের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারলেও একসময় তিনি বিশ্বের সেরা একজন লেখক ও আঁকিয়ে হয়ে উঠেছিলেন। কীভাবে সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত একজন মানুষও হতে পারেন দারুণ গণিতবিদ, যার হাতে তৈরি হয় গাণিতিক থিওরি।
আমরা যারা নিজেদের 'সক্ষম' বলে মনেকরি, প্রকৃতপক্ষে আমরাই সবচেয়ে 'অক্ষম'। মানুষকে বুঝতে না পারাটাই এক ধরনের অক্ষমতা। 'অটিজম' স্নায়ুবিকাশজনিত একটি ডিসঅর্ডার, যা জীবন ধরে চলে। আগে মানুষ এই বিষয়টি বুঝত না। এখনও যে খুব একটা বোঝে, তা নয়। শহরের শিক্ষিত লোকেরা কিছুটা জানলেও, গ্রামের অগণিত মানুষ কিছুই জানে না। তারা মনে করে হয় এরা 'পাগল', 'অভিশাপের শিকার' অথবা এদের 'জিনে ধরেছে', 'বাতাস লেগেছে'।
একবার নড়াইলের এক গ্রামে গিয়ে একটি শিশুর সাথে পরিচয় হলো, যে ঠিকমতো কথা বলতে পারতো না এবং অন্যান্য শিশুদের সাথে বিশেষ মিশত না। গ্রামের লোকের ধারণা, ওর দাদা মানুষ ঠকানোর ব্যবসা করত বলে ছেলেটির ওপর এই অভিশাপ পড়েছে। বাচ্চার মা কাঁদতে কাদঁতে আমাদের এই তথ্য দিল।
মানিকগঞ্জের শহরতলীর কিশোরী সুমনা। সুমনা অসম্ভব ভালো ছবি আঁকতে পারে। যাকে দেখত, তাকেই হুবহু এঁকে ফেলতে পারত। কিন্ত ওর এই গুণটাকে কেউ কদর করেনি, এমনকি ওর বাবা-মাও নয়। বরং তারাও মানুষজন, পাড়া-প্রতিবেশীকে এড়িয়ে চলতেন। কারণ সুমনা তাদের মানসিক প্রতিবন্ধী সন্তান। ওর বাবা মা জানালেন, 'সুমনার এই অবস্থার জন্য পাড়া-প্রতিবেশীরা আমাদের বিভিন্নভাবে দায়ী করেন, আমাদের এড়িয়ে চলেন।'
দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে এই কুসংস্কারগুলোর ওপর নির্ভর করে এখনো আমাদের সমাজ চলছে। আমাদের উচিত নাটক, গান, নাচ, সিনেমা ও লেখালেখির মাধ্যমে অটিজম বা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের নিয়ে জনগণকে সঠিক বিষয়টি জানানো ও বোঝানো। এইসব কুসংস্কার ও স্টিগমা ভেঙে দিতে হবে, তাদের নিয়ে কাজ করার ব্যাপারে উৎসাহ জোগাতে হবে।
যে বাবা-মায়ের একটি শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধী বাচ্চা আছে, তারা জানেন কতটা কষ্টের মধ্যে দিয়ে তাদের যেতে হয়; কী ভয়াবহ প্রতিকূলতাকে তারা মেনে নিয়ে প্রতিবন্ধী সন্তানকে প্রতিপালন করেন। যেখানে একজন সুস্থ শিশুকেই ঠিকমতো বড় করে তোলা অভিভাবকের জন্য কঠিনতম কাজ, সেখানে একজন শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধী বাচ্চার অবস্থা কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। এখনও এদেশের আর্থসামাজিক অবস্থায় সংসারে ও সমাজে এই বাচ্চাগুলো ভীষণভাবে অযাচিত।
সেদিন সকালে ভূমিকম্পের পর কে কী করছিল, এই আলোচনার সময় একজন বললেন, 'আমি তো আমার অসুস্থ ছেলেটিকে রেখে কখনও কোথাও বেড়াতেও যাই না, আর ভূমিকম্পের সময় ওকে রেখে কোথায় যাব? আমার ছেলেটি তো চলাফেরা করতে পারে না। সত্যি কথা বলতে আমি ওর সাথে থাকতে থাকতে এখন নিজেও প্রতিবন্ধী হয়ে গেছি।' আমাদের একটু ভালবাসা, সমর্থন ও দৃষ্টিভঙ্গির বদল, একটু হাত বাড়িয়ে দেয়া—এদের বেঁচে থাকার শক্তি জোগাতে পারে। বাবা-মায়ের কাজের পাপ-পুণ্যের নিরিখে নয়, যে-কারও ঘরে এমন একটি চাহিদাসম্পন্ন শিশুর জন্ম হতে পারে।
সেই ৪৫-৫০ বছর আগে আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন শুধু শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষ সম্পর্কেই জেনেছি। বাসায় ও পৌরনীতি বইতে শেখানো হয়েছিল, 'খোঁড়াকে খোঁড়া বলিও না, কানাকে কানা বলিও না, বোবাকে বোবা বলিও না, বলিলে উহারা কষ্ট পায়'—ব্যস, এই পর্যন্তই। মানসিক প্রতিবন্ধিতা বলে যে কিছু আছে, তা জানতেও পারিনি। এ নিয়ে তেমন কিছু জানানো বা শেখানো হয়নি।
একইভাবে আমাদের কোনোদিনই শেখানো হয়নি ভিন্নভাবে সক্ষম এই মানুষগুলো, অন্য জগতের কেউ নয়, ভিনগ্রহের প্রাণী নয়। এরা আমাদের পাশে থাকা মানুষ, যাদের মধ্যে রয়েছে অমিত শক্তি। যারা আচার-আচরণে খানিকটা বা অনেকটাই অন্যরকম হলেও, এদের ভেতর লুকিয়ে রয়েছে মেধা। এদের ভালোবাসতে হবে, যত্ন নিতে হবে, উৎসাহ দিতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, সন্তান ভেবে তাদের বুকে টেনে নিতে হবে। আমরা সবাই সবসময় এদের এড়িয়ে চলেছি, এড়িয়ে চলিও।
কোনো প্রতিবন্ধী বা ভিন্নভাবে সক্ষম মানুষকে আমরা আমাদের মতো করে ভাবতে পারি না। তাদের কষ্ট, চাওয়া-পাওয়াকে গুরুত্ব দেই না। তাদের প্রান্তিক করে রাখি, লুকিয়ে রাখি, বঞ্চিত করি সব অধিকার থেকে। কিন্তু এখন তো দিন বদলেছে। মানুষ অনেক কিছু জানতে পারছে এই রোগগুলো নিয়ে। সরকার নানারকম উদ্যোগ নিয়েছে এদের চিকিৎসা ও বিভিন্ন সুবিধা দেওয়ার ব্যাপারে। তবে মানসিকতার পরিবর্তন কতটা হয়েছে, তা তো বোঝাই যাচ্ছে চিকলি পার্ক কর্তৃপক্ষের ঘটনা থেকে।
প্রতিবন্ধিতা ও অটিজম নিয়ে আমাদের খুব করে প্রচারণা চালাতে হবে, জনগণকে সচেতন করতে হবে। বাবা-মাকে সচেতন করতে হবে যেন তারা তাদের শিশুর আচরণ ছোটবেলা থেকেই লক্ষ করেন। প্রতিবন্ধী বাচ্চা এখনও আমাদের সমাজে অবহেলিত, অনাদৃত। শহরে, মধ্যবিত্ত বা ধনী পরিবারে যদিও এই মানুষগুলোর কিছুটা মূল্য রয়েছে, তাদের কথা তাদের পরিবার কিছুটা হলেও ভাবে, কিন্তু দরিদ্র পরিবারে এরা শুধুই বোঝা। অনেককেই ব্যবহার করা হয় ভিক্ষাবৃ্ত্তিতে।
তবে যেকোনো পরিবারেই এই অসহায় মানুষগুলো যতদিন বাঁচে, ততদিনই থেকে যায় সংসারের বোঝা হিসেবে। শুধু তাদের মা বা বাবাই তাদের কথা ভাবেন, তাদের ভালোবাসেন। তবে রাষ্ট্র যদি সত্যিকারভাবেই এদের পাশে এসে দাঁড়ায়, তাহলে পরিবারের কষ্ট অনেকটাই লাঘব হতে পারে, যেমনটা হয়েছে উন্নত বিশ্বে।
আমাদের বিল্ডিংয়ের একটি কাহিনি দিয়ে লেখাটি শেষ করব। ৬ তলায় একজন বয়স্ক শিশু ছিল, যার কথা আমি আগেও একবার লিখেছিলাম। চিকলি পার্কের ঘটনার পর মনে হলো শিশুটি আর ওর মায়ের কথা। আসা-যাওয়ার পথে মা ও ছেলের সাথে মাঝেমধ্যে দেখা হয়ে যেত। বাচ্চাটিকে নিয়ে ওর মা যখন চলাফেরা করতেন, তখন তাকে দেখলেই বোঝা যেত খুব কষ্ট বুকে চেপে আছেন। উনি খুব সন্তর্পণে, চোখ আড়াল করে বাচ্চাটিকে নিয়ে ঘরে ঢুকে যেতেন।
তা-ও মাঝে মাঝে তাদের শেষরক্ষা হতো না। হঠাৎ করে বাচ্চাটি লিফটের ভেতরেই পেশাব করে ফেলত। এ নিয়ে আমরাই বিরক্ত হয়েছি, ক্ষোভ প্রকাশ করেছি। তাই হয়তো লজ্জায় ১৭ বছরের ওই ছেলেটির মা মুখ লুকিয়ে চলতেন। প্রতিবন্ধী শিশুটির মা ছিলেন অসহায়, কারণ ডাক্তার বলেছিলেন প্রতিদিন বাচ্চাটিকে বাইরে হাঁটতে নিয়ে যেতে, নতুবা ও আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে। তাই মাকেই এই অপ্রিয় কাজটি করতে হতো।
সেই অবুঝ শিশুটি তার মায়ের সব যন্ত্রণার অবসান ঘটিয়ে একদিন চলে গেল। জানি মায়ের একার পক্ষে কঠিন দায়িত্ব ছিল এই প্রতিবন্ধী সন্তানকে মানুষ করা। ছেলেটির বাবা মারা গেছেন। কিন্ত তা-ও তো একমাত্র সন্তানটি ছিল তার কোলজুড়ে।
তবে কোনো কর্তৃপক্ষ বা কেউ যদি প্রতিবন্ধী মানুষের সাথে অমানবিক ও অভব্য আচরণ করে, তখন সবার পক্ষ থেকে প্রতিবাদ করা উচিত। ভদ্রতার খাতিরে চুপ করে থাকা আর নয়। কাউকে না কাউকে এ নিয়ে বলতে হবে, মানুষকে জানাতে হবে। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের নিয়ে সরকারের অনেক পরিকল্পনা রয়েছে, সরকার এসব শিশুকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে, তাদের জন্য সবকিছু সহজ করার জন্য কাজ করছে। তাহলে একটা পার্কে কেন এই বাচ্চারা যেতে পারবে না? যেসব শিশু বা বয়স্ক মানুষ হুইলচেয়ারে চলাফেরা করেন, সাদা ছড়ি ব্যবহার করেন, তারা কি জীবনে কোনো বিনোদন পাবেন না? বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু হওয়ার কারণে কি রাষ্ট্র তাদের স্বাধীনভাবে সব জায়গায় যাওয়ার অনুমতি দেয়নি?
- লেখক: যোগাযোগকর্মী
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফল। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।