সমরেশ মজুমদার: স্মৃতিতর্পণসূত্রে
আমাদের শৈশবের প্রথমদিকের গোয়েন্দা ফেলুদা নন, অর্জুন—অমল সোমের শিষ্য। কেননা আনন্দমেলার শারদ আয়োজনের ত্রিশ বছর আগের সংখ্যায় অর্জুন ছিল। সদ্যপ্রয়াত লেখক সমরেশ মজুমদারের কিশোরদের জন্যে ভাবা গোয়েন্দাচরিত্র। তিনি একাধিক সায়েন্স ফিকশনও লিখেছিলেন চরিত্রটিকে কেন্দ্র করে।
কিশোর বয়সে অর্জুন আনন্দ দিয়েছিল। পরে, আস্তে আস্তে তাঁর লেখাপত্র পড়তে পড়তে, পড়াশোনার শুরুর দিনগুলোতে আগ্রহ জন্মাল। তখন পর্যন্ত দেবেশ রায়, দেবেশ বাবুর দাদা দীনেশ চন্দ্র রায় কিংবা অসীম রায়ের লেখাপত্র পড়িনি। তাছাড়া যখন সমরেশ লিখতে শুরু করেছিলেন, উত্তরবঙ্গ তথা জলপাইগুড়ি অঞ্চল তখন প্রায় অকর্ষিত ছিল বাংলা সাহিত্যে। স্বয়ং দেবেশ রায় গুটিকতক লেখা লিখেছিলেন মাত্র।
জন্মেছিলেন চা বাগানে, মদেসিয়া শ্রমিকদের বাচ্চাদের সাথে ফুটবল খেলে বড় হয়েছেন। তিস্তার একদম গা ঘেঁষে বাড়ি ছিল, তিস্তায় তখনো বাঁধ পড়েনি। পাড়ার কাছেই রাজবংশী পাড়া, বাহে সম্প্রদায় বলা হতো। তিস্তার চর সমরেশ মজুমদার নিজের হাতের তালুর মতোই চিনতেন। ঠাকুরদার কাছে থেকে পড়ায় তাঁর মানসগঠনে ঠাকুরদার প্রভাব ছিল।
পুজোর ছুটিতে বাবা মায়ের কাছে বাড়িতে গেলে, দুপুরে যে দীর্ঘ আড়াই-তিন ঘণ্টা ঘরে আটকে থাকা বালক সমরেশের, সেই আটকাদেশ তাঁকে লেখক হওয়ার দিকে খানিকটা ঠেলে দিল অগোচরেই। পারিবারিক পুস্তক সংগ্রহের আলমিরায় পেয়ে গেলেন আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পুজো সংখ্যা। তাতে মানিক বন্দোপাধ্যায়ের একটিমাত্র উপন্যাস। প্রবাসী, সচিত্র ভারত এইসব দুর্মূল্য পত্রিকা তাঁর সামনে বাংলা সাহিত্যের আকাশ সম্প্রসারিত করেছিল।
জলপাইগুড়ি জেলা স্কুলের ছাত্র ছিলেন। স্কুলের নাট্যদলের জন্যে নাটক লেখার চেষ্টায় ভাবলেন, প্রথমে গল্প লিখে নাট্যরূপ দেবেন। কিন্তু গল্পটি নাট্যরূপ দেয়া গেল না। বন্ধুদের পরামর্শে পাঠালেন দেশ পত্রিকায়। তখন প্রখ্যাত সাহিত্যিক বিমল কর সম্পাদক। ছাপাবার কথা দিয়ে ছাপা হলো না। টেলিফোন বুথ থেকে যথেচ্ছ গালাগাল দিলেন সমরেশ। সম্পাদক গল্প নিয়ে আরেকবার যেতে বলায়, জেলে দেবার আশঙ্কায় বন্ধুদের নিয়ে গেলেন৷ জানা গেল, পিয়নের ভুলে এই না ছাপাঘটিত বিপত্তি।
ছাপা হলো তারপর, প্রথম গল্প, ১৯৬৭ সালে। তখন বাংলা সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদকেরা মহানুভব ছিলেন। লেখার গুণগত মান বাদে অন্যদিকে মন দিতেন না। গল্পকার শিশির লাহিড়ী সস্নেহে বলেছিলেন, 'এ চায়ের পেটি মাথায় নিয়ে এসেছে। বিক্রি না করে যাবে না।'
২
সমরেশ মজুমদারের বন্ধুত্ব ছিল আমাদের জনপ্রিয়তম লেখক হুমায়ূন আহমেদের সাথে। একটা ছোট্ট মিথ্যাচার করেছিলেন, 'কইতে কথা বাধে' বইতে। লিখেছিলেন, তিনিই আহমেদ সাহেবকে দেশ পত্রিকার সম্পাদকের কাছে নিয়ে যান। এবং তাঁর কথাতেই শারদ সংখ্যায় হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস মুদ্রিত হয়।
প্রকৃত সত্য জানার উপায় আজ নেই। তবে তদন্ত করে দেখার জন্যে সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আনন্দবাজার গোষ্ঠীর পত্রিকাগুলোর একটা নির্ধারিত নিয়ম আছে। হাউজের লেখকেরা বাই রোটেশন একেকটা পত্রিকায় একেকবার লেখেন। পরপর দুইবারের শারদ সংখ্যায় কারও উপন্যাস থাকে না। একমাত্র ব্যতিক্রম হুমায়ূন আহমেদ, দেশ পত্রিকার সত্তর প্লাস বয়সের ইতিহাসে। টানা আটবার শারদীয়া দেশেই উপন্যাস মুদ্রিত হয়েছিল হুমায়ূন আহমেদের। অন্য লেখকের অনুগ্রহপ্রাপ্ত লেখককে কি হাউজের নিজস্ব নিয়ম ভঙ্গ করে এতখানি গুরুত্ব দেয়া হয়? আসলে হুমায়ূন আহমেদ নিজস্ব জনপ্রিয়তার জন্যেই, নিজের শর্তেই তাঁদের লেখা ছাপতে বাধ্য করেছিলেন।
এই ছোট্ট ঘটনাসহ বাংলাদেশি লেখকদের প্রতি কিছু উন্নাসিকতা বাদ দিলে গল্পকার সমরেশ মজুমদারের একাধিক গল্প এবং উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ ট্রিলজি বাঙালি মধ্যবিত্ত পাঠকের বইদুনিয়ায় প্রবেশের শুরুর বন্ধু হয়ে রইবে। এইভাবে আরো কিছুকাল তিনি স্মরণীয় থেকে যাবেন৷ মরণোত্তর শ্রদ্ধা জানাই।