ইমরান খানের গ্রেপ্তার পাকিস্তানকে কোন পথে নিয়ে যাচ্ছে
পাকিস্তানে সামরিক বাহিনী পর্দার অন্তরালে থেকে বিচার বিভাগের কর্তৃত্ব ব্যবহার করে বেসামরিক রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছে। মুসলিম লীগ নামক রাজনৈতিক দলটি বর্তমানে ক্ষমতায়। এই রাজনৈতিক দলটির প্রধান নওয়াজ শরীফ প্রবাসী জীবন যাপন করছেন দুর্নীতির অভিযোগে সাজাপ্রাপ্ত হয়ে। তার ভাই এখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। পরিবারতন্ত্রের উত্তরাধিকার হিসাবে। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির জন্মের ইতিহাস আজও স্পষ্ট হয়নি।
১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্রের প্রস্তাব করা হয়েছিল কি না, তা-ও ইতিহাসের পাতায় সুনিশ্চিত নয়। নাকি পাকিস্তান জন্মের সাথে ১৯৪৬ সালের অবিভক্ত ভারতবর্ষের জন্য যে সাংবিধানিক পরিষদ ও স্বাধীন ভারতের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নির্বাচন হয়েছিল, সেই নির্বাচনে মুসলিম লীগের নিদারুণ পরাজয় বরণের ফলেই কি পাকিস্তান রাষ্ট্রের দাবিটি সামনে নিয়ে এসেছিল? নাকি সেই ১৯৪৬-এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা পাকিস্তান রাষ্ট্রটির জন্মকে অবধারিত করেছিল?
১৯৪৭ সালে পাকিস্তানেরর জন্ম হলো বটে, কিন্তু রাষ্ট্রটি তার নিজস্ব সংবিধান তৈরি করতে সময় নিয়েছিল ২৬ বছর। বর্তমানে পাকিস্তান যে সংবিধানের আওতায় শাসিত হচ্ছে, তা ১৯৭৩ সনে জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বে রচিত হয়েছিল। যদিও জন্মের পরে ১৯৫৬ সনে এক বছরের জন্য তাদের একটি সংবিধান কার্যকর ছিল। অথবা সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুব খান তার নিজস্ব একটি সংবিধান রচনা করে সেই সংবিধানের আওতায় পাকিস্তানকে ১০ বছর শাসন করেছিলেন।
দেশটিতে জন্মের পর থেকেই রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছে। প্রথমে ছিল ভূখণ্ডের পশ্চিম অংশে। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলোর মধ্যে সমঝোতার অভাবে বেলুচিস্তান ও সীমান্ত প্রদেশ পরিপূর্ণভাবে পাকিস্তানের অস্তিত্ব মেনে নিতে চায়নি।
রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থার মৌলিকত্ব হলো সংবিধান। সংবিধানের অভাবে পাকিস্তান দীর্ঘকাল স্বৈরশাসনের খপ্পরে পড়েছে। তবে সংবিধানের নিরিখে পাকিস্তানের বিচারবিভাগ একটি স্বাধীন বিচার বিভাগ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পাকিস্তানের উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে একটি সাংবিধানিক ধারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এরপরও দেশটিতে সামরিক বাহিনী, বিচার বিভাগ এবং রাজনৈতিক দলের মধ্যে আস্থার অভাব সুস্পষ্ট।
ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন সরকার ইউক্রেন যুদ্ধে সরাসরি রাশিয়ার পক্ষাবলম্বন করার ফলে তাকে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উপর মার্কিনিদের ব্যাপক প্রভাব আছে। পাকিস্তানের বিমান বাহিনীর মূল চালিকাশক্তি এফ-১৬ যুদ্ধবিমান। এই যুদ্ধবিমানের খুচরা যন্ত্রাংশ সরবরাহ ও রক্ষণাবেক্ষণ মার্কিনীদের হাতে। এছাড়াও আছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ওপর মার্কিনীদের প্রভাব। ফলে মার্কিন সমর্থিত পররাষ্ট্রনীতিই অনুসরণ করেছে পাকিস্তানের বর্তমান সরকার। ইমরানকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখার জন্য তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে আসা হয়েছে এবং তার ফলে ইমরানকে গ্রেফতার করার পর পাকিস্তানে একটি অগ্নিগর্ভ রাজনৈতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। যা পাকিস্তানের ইতিহাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত ।
গত ৭০ বছর পাকিস্তান এমন ইতিহাসের ভিতর দিয়েই যাচ্ছে। যতই সাংবিধানিক ধারা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা তারা করুক না কেন. পর্দার অন্তরাল সামরিক বাহিনীর ভূমিকা অত্যন্ত প্রবলভাবেই রয়ে যাচ্ছে। সামরিক বাহিনী গত ৭০ বছর পাকিস্তানের জাতীয় আয়ের কত শতাংশ নিজেদের স্বপ্নবিলাসে ব্যয় করেছে, তার সঠিক ইতিহাস দেশটির জনগণ জানে না। ইমরান খানকে আপাতত ক্ষমতা থেকে দূরে রাখার লক্ষ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। এবং ইমরান খানের গ্রেফতার একটি ট্রাস্ট বিষয়ক দুর্নীতির মামলা। ট্রাস্ট বিষয়ক দুর্নীতি মামলার ইতিহাস পৃথিবীর আরো অনেক দেশের রাজনীতির অঙ্গনে দেখতে পাওয়া যায়।
গতকাল পাকিস্তানের রাজনীতিতে আরো একটি মাত্রা যোগ হয়েছে। গণবিস্ফোরণ। কোথাও কোথাও সেনা স্থাপনার উপর আক্রমণ হয়েছে। যে বাহিনী ইমরানকে গ্রেফতার করেছে তারা সেনাবাহিনীর অধীনস্থ একটি বাহিনী। গতকাল দিনব্যাপী সহিংসায় ইতিমধ্যে আটজন প্রাণ হারিয়েছে। সহস্র মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পাঞ্জাব, করাচি, ইসলামাবাদে সেনাবাহিনী নামানো হয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য।
অন্যদিকে ইমরান খানের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলার শুনানি নিয়ে এক নাটক হয়েছে ইসলামাবাদ হাইকোর্টে। ইমরান বিগত নির্বাচনে তার এক কন্যার বিষয়ে ঘোষণা না দেওয়াতে, তা নিয়ে মামলা চলছে। রিট আবেদনে বলা হয়েছে ইমরান খান তার এই কন্যার অস্তিত্ব লুকিয়ে নির্বাচনের আইন ভঙ্গ করেছেন। তিনি বিগত নির্বাচনের সময় নির্বাচনী প্রার্থী হিসেবে ঘোষণাপত্রে তার এই কন্যার নাম উল্লেখ করেননি। এমনকি ইসলামী আইন অনুসারে এই কন্যার ভরণপোষণের দায়িত্ব ইমরান খানেরই, এ কারণে ইমরান খান নির্বাচনের জন্য অযোগ্য। ইমরানের এই কন্যার জন্ম তার প্রাক্তন স্ত্রী জেমিমার গর্ভের নয়। কন্যার মা ইতিমধ্যেই মৃত্যুবরণ করেছেন।
আদালতের শুনানি নিয়ে যে নাটক করতে হয়েছে, তা কোন দিকে যায় এখন দেখার বিষয়। মামলার বেঞ্চ ভেঙে দিয়ে প্রধান বিচারপতি আবার নতুন বেঞ্চ গঠন করেছেন ইমরান খানের কন্যা বিষয়ক মামলার শুনানির জন্য । ইমরান খান নিজেও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ উত্থাপন করেছেন, যা সেনাবাহিনী এবং দেশের জনগণকে মুখোমুখি করিয়ে দিচ্ছে। ইমরান খানের এই গ্রেপ্তার পাকিস্তানকে কোন দিকে নিয়ে যায়, তা-ই দেখার অপেক্ষায় বিশ্ব। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতিতে উপদেশের ঝুড়ি নিয়ে হাজির হয়েছে। সরকারকে এবং ইমরান খানের দলকে দায়িত্বশীল হতে বলেছে উভয় রাষ্ট্র। তা ছাড়া আর একটি কথা বলা যায়, দীর্ঘকাল চীনের যে কর্তৃত্ব পাকিস্তান রাজনীতি এবং সেনাবাহিনীর উপর ছিল তা সম্ভবত এখন দুর্বল অবস্থায় পৌঁছেছে,।নাহলে ইমরান খানের বিরুদ্ধে সরাসরি এরকম আক্রমণাত্মক ভূমিকা পাকিস্তানের রাজনীতিতে হওয়ার কথা না।