প্রয়াণলেখ: হেলাল হাফিজ
১
যতদূর মনে পড়ে, ২০১৩ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বাতিঘরে একটি অনুষ্ঠানসূত্রে সদ্য প্রয়াত কবি হেলাল হাফিজের সাথে প্রথমবারের মতো দেখা করবার সুযোগ ঘটে। কিন্তু তখন তৎকালীন গণজাগরণ মঞ্চের একের পর এক কর্মসূচিতে উপস্থিত থাকা, প্রথমা প্রকাশনার চট্টগ্রামের বারো ঘণ্টা প্লাস একটা পূর্ণ সময়ের চাকরি, ব্যক্তিগত জীবনে প্রেমের অভিঘাত ইত্যাদি নিয়ে এতো মগ্ন ছিলাম সুযোগটি তীব্র ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নিতে পারিনি। আরেকবার ২০২২ সালের ২১শে জানুয়ারি কবি মোহাম্মদ রফিক যখন একটা সাহিত্য পুরস্কার আনতে যান আমি সাথে থাকার দরুন অনুষ্ঠানস্থলে হেলাল হাফিজকে দেখি। তিনিও সেবার পুরস্কৃত হন এবং পুরস্কার পরবর্তী সংক্ষিপ্ত বক্তব্য শোনার দুলর্ভ অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমার। কিন্তু, সেবারও কথা বলা হয়নি। এরপর এমনকি কিংবদন্তি অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর পুরস্কৃত বইটি সংগ্রহ করেও দু'হাত সামনে থাকা তাঁর কাছ থেকে স্বাক্ষর নিতে পারিনি নিজস্ব জড়তা বা দ্বিধার কারণে। অর্থাৎ এখন বিস্ময় নিয়ে উপলব্ধি করছি: কবি হেলাল হাফিজের সাথে যোগাযোগের বা সখ্য তৈরির সকল ধরনের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমি কেন যেন গ্রহণ করিনি। এখন, শাহবাগস্থ একটি হোটেলের ওয়াশরুমে তাঁর পরিত্যক্ত দশায় মৃত পড়ে থাকার খবরটা পড়ে কেন আমার মন খারাপ হচ্ছে এবং কেন এই শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবসের দিবাগত রাত প্রায় একটায় গদ্যটি লিখছি- সত্য বলতে, আমি জানি না।
২
তবে, যা অনুভব করতে পারি সে সব কথা টুকে রাখা দায়িত্ব মনে করে এই গদ্যের চলন কিছু সময় অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এখন যেমন মনে হচ্ছে, আসলে কবিতা ভাবনার দিক থেকে কবি হেলাল হাফিজের সাথে এক ধরনের দূরত্ব অন্তত দেড় দশক আগেই কি আমার সূচিত হয়নি! উচ্চকণ্ঠ আবেগাক্রান্ত কবিতা, দেশের মুক্তি কিংবা ব্যক্তিগত বাসনার দ্বিধাহীন উচ্চারণ যে সকল কবিতায় আছে তা আমার আর অনেক দিন ধরেই ভালো লাগছিলো না৷ লাগে না এখনও। আমি বিশ্বাস করি, বছরের পর বছর বাংলাদেশের আবৃত্তি শিল্পীরা এই গোত্রের কবিতাগুলো বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করে করে বাংলা কবিতার এক ধরনের ক্ষতি করেছেন। কেন না, কবিতা পাঠকদের মধ্যে অধিকাংশতই ধারণা জন্মে গেছে, কবিতাকে হতে হবে আবৃত্তি উপযোগী। যে কবিতা কবির নিভৃত গহন থেকে উঠে আসে, অস্ফুট শব্দে বাক্যে বাংলার মানুষকে দুটো-চারটে কথা বলতে চায় যা কি না অন্তর খোলা না রাখলে উপলব্ধি স্পর্শ করে না অথবা বাংলার প্রকৃতি মন্থন করে এক ধরনের দার্শনিক ভাব সৃজনসক্ষম - সেই কবিতা প্রকৃত অর্থে অনেক মানুষের মনোযোগ পায়নি।
আমরা আমাদের আরামের সুনির্দিষ্ট অঞ্চল থেকে বেরিয়ে বাংলা কবিতার অনাঘ্রাত অঞ্চলের দিকে পা বাড়াতে চাইনি। দৈনিকের আয়োজন, গোষ্ঠীবদ্ধ তৎপরতা আর আবৃত্তিশিল্পীদের নিবেদন- এই তিন উপায়েই আমাদের যাকে বলে আমজনতার মধ্যে কবিতা আগ্রহী মানুষেরা কবিতা আস্বাদন করেন।
আমি, একটু অন্যভাবে যে কবিতা কেউ আজকাল পড়ে না, যাকে কেউ চেনে না, সেসব কবিতা আর কবিতাযাপনের দিকে ঝুঁকেছি বেশ কিছু বছর হলো। তাহলে প্রশ্ন হতে পারে, হেলাল হাফিজ 'স্মরণ' রচনায় প্রবৃত্ত হলাম কেন?
যেমন এই মুহূর্ত মনে হচ্ছে একজন দারুণরকম প্রিয় বাংলা ভাষার এ কবির সম্পূর্ণ একা একটি হোটেলের ওয়াশরুমে মরে পড়ে থাকা মেনে নেয়া যায় না। তার অসুস্থতার কথা তো কারো অজানা ছিল না। তার একটু চিকিৎসা হলো না কোনো বড় পৃষ্ঠপোষকতায়!
তিনি কি কোনো কারণে বিতাড়িত ব্যবস্থার সুবিধা পেয়েছিলেন বলে এই পরিত্যক্ত? এমন কোনো বিষয় কি আছে? তিনি কি সুবিধাই বা পেয়েছেন? রাষ্ট্রীয় পুরস্কার তো তিনি প্রথম বইয়ের জন্য প্রাপ্যই ছিলেন, আর বাকি থাকে চোখের চিকিৎসার জন্য সরকারি অর্থসাহায্য। অন্য কোনও বিলাস বা বাহুল্যের কথা তো শুনিনি। মনে হচ্ছে, এই 'নতুন সময়ের' রাষ্ট্রীয় যত্ন যদি একটু পেতেন হয়তো আরও কিছুদিন তাঁকে আমাদের মধ্যে পেতাম৷
৩
রাষ্ট্র কর্তৃক কবি লেখকদের সেলিব্রেট করার একাধিক দিক আছে। বিশেষত, আবারও বলি, যে রাষ্ট্র ঘোষিতভাবে কারও উপর চেপে বসতে চায় না তবে রাষ্ট্রের কবি লেখকদের সম্মানিত করবার একটা প্রধান দিক হলো, সমগ্র জনপদে যে গুটিকতক মানুষ অক্ষরের সাধনা বেছে নিয়েছেন তাঁরা অনুপ্রাণিত হন। ভাষা আন্দোলনের চেতনা থেকে আমাদের যে জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি, তার পুরস্কারের প্রধান বিবেচ্যই তো ছিলো - উক্ত গ্রন্থ জনপদে ব্যাপকভাবে গ্রাহ্য প্রভাব রাখছে কি না। সেদিক থেকে, আমাদের দেশের কবিতা ভালোবাসা আম মানুষদের কাছে 'যে জলে আগুন জ্বলে' বইয়ের চেয়ে বেশি প্রভাব তো খুব কম বইয়ের আছে। অন্তত, সময়ের প্রয়োজনে সাহসী উচ্চারণের ক্ষেত্রে৷ যে কোনও কবির দিক থেকে এটি বুদ্ধিজীবিতাও। সুস্পষ্ট করেই তিনি বলতে পেরেছিলেন, যুদ্ধ যাবার সঠিক ও সুনিশ্চিত সময়কাল নিশ্চিত করেছিলেন।
তাঁর জীবৎকালে পারমাণবিক যুদ্ধের ভয়াবহতা তিনি দেখেছিলেন, অনুভব করেছিলেন। যেমন, ১৯৫৫ সালে আকিরা কুরোসাওয়া প্রণীত চলচ্চিত্র - আই লিভ ইন ফিয়ার। দশ বছর পর, ১৯৬৫ সালে আমাদের ভাষার চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটক কাছাকাছি থিমে নির্মাণ করলেন স্বল্পদৈর্ঘ্য - ফিয়ার। দুটোই, তৃতীয় বিশ্বের মানুষের জীবনে পারমাণবিক যুদ্ধের অভিঘাত, আশঙ্কা নিয়ে নির্মিত। আর হেলাল হাফিজ লিখলেন, মাত্র দুটো লাইন- 'নিউট্রন বোমা বোঝ, মানুষ বোঝো না'। মাত্র দুই বাক্যে, হাইকুপ্রতিম যুদ্ধবিরোধী কবিতা খুব সুলভ তো নয়।
ব্যক্তিজীবনের ব্যর্থ প্রেম। প্রথম বইয়ের প্রথম কবিতা হেলেনের প্রতি বাসনা থরথর, প্রতিশ্রুতি সঞ্চারিত করা একটি কবিতা, রচনাকাল মুক্তিযুদ্ধের পর পর।
বাংলাদেশের মানুষ সদ্যস্বাধীন দেশের আনন্দ বুঝে ওঠার আগেই রক্ষী বাহিনীর উৎপাত শুরু হয়ে গেলো। স্বাধীনতা পর্যবসিত হলো একনায়ক স্বেচ্ছাচারে। এই টালমাটাল ঐতিহাসিক দশার মধ্যে তাঁকে যেতে হয়েছে সমকালীন সহনাগরিকদের মতো। হেলেনের অন্যত্র বিবাহ তিনি গ্রহণ করতে পারেননি৷ প্রথম বই প্রকাশের পর হেলেন যখন হাফিজের কবিতায় তাঁর মৃদুনামের জিকির দেখলেন মানসিক স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে পারলেন না। হেলেনকে হারানোর মাস কয়েক আগেই তাঁর বাবা প্রয়াত হন। তিন বছর বয়সে মা চলে যাওয়ার পর, বাবা ছিলেন একাধারে বাবা আর মা। এই দুটি ধাক্কা মানসিকভাবে তাঁকে চির যাযাবর করে তোলে। যাকে বলে ঘর, তার অনুসন্ধানে লিপ্ত হননি তিনি। প্রথম বইয়ের পর আরেকটি বই, বেদনাকে বলি কেঁদো না আর একটি মাত্র কার্ড কবিতার সংগ্রহ - এইমাত্র তাঁর কবিজীবনের নির্যাস।
বাংলাদেশের কবিতায় তিনি দীর্ঘজীবী হবেন কী না আমি সুনিশ্চিত বলতে পারি না। তবে, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে মিছিল এবং যুদ্ধের সত্য সময়টি ঘোষণা করে তিনি আমাদের যৌথস্মৃতির অংশী হয়েই থাকবেন। তাঁর কবিপ্রাণতাকে শেষ প্রণাম জানাই।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।