এআই সভ্যতা ধ্বংসকারী হয়ে উঠবে এ প্রচারণা কি শুধু ‘ধোঁকা’!
চলতি মাসের শুরুতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বেপারীরা আরো একবার তাদের পণ্যের অস্তিত্ব বিপন্নকারী শক্তি সম্পর্কে হুঁশিয়ারি দেন। ওপেনএআই কোম্পানির প্রধান নির্বাহী স্যাম অল্টম্যান ও বিল গেটসসহ শত শত এআই খাতের নির্বাহী, গবেষক এবং প্রযুক্তি খাতের অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যবসায়ী সেন্টার ফর এআই সেফটির এক লাইনের বিবৃতিটিতে স্বাক্ষর করেন। এতে আহ্বান জানানো হয়, "মহামারি ও পারমাণবিক যুদ্ধের পাশাপাশি এআই- এর মাধ্যমে মানব সভ্যতার অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার যে ঝুঁকি রয়েছে – তা কমিয়ে আনাকে বৈশ্বিকভাবে অগ্রাধিকার দিতে হবে।"
ওপেনএআই, মাইক্রোসফট, গুগল ও অন্যান্য প্রযুক্তি কোম্পানির নির্বাহীরা সম্প্রতি দুই সপ্তাহব্যাপী এক সফর শেষ করেছেন। তারপরেই দেওয়া হয় এই হুঁশিয়ারি। এই সফরে তারা মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদ (কংগ্রেস) থেকে শুরু করে ইউরোপীয় ইউনিয়নে বক্তব্য রেখেছেন। অন্যান্য কিছু আয়োজনে যোগ দিয়েও তারা নিজেদের এআই পণ্যের ক্ষতি কমানোর বিষয়ে গুরুত্ব-সহকারে আলোচনা করেন। এবিষয়ে সংশ্লিষ্ট শিল্পের সাথে সরকারের সম্পৃক্ত হওয়ার দিকেও গুরুত্ব দেন তারা। যদিও একই সময়ে তারা এআই উন্নয়নে শত শত কোটি ডলার বিনিয়োগ করেই চলেছেন।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা খাতের গণ্যমান্য কয়েকজন গবেষক ও সমালোচক আমাকে বলেন, এসব বক্তব্যকে তারা 'ফাঁপা বুলি' বলেই মনে করেন। বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো যেসব বিধিমালার প্রস্তাব করেছে – সেসবও আসলে নখদন্তহীন এবং তাদের স্বার্থ হাসিলের অনুকূলে।
গণ-নজরদারির বিপক্ষে প্রচারণাকারী অলাভজনক সংস্থা – সার্ভেইলেন্স টেকনোলজি ওভারসাইট প্রজেক্ট- এর নির্বাহী পরিচালক অ্যালবার্ট ফক্স কানের মতে, "এআই- এর ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে অনেক গবেষণার মাধ্যমে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তার কোনো পরোয়া করেনি সিলিকন ভ্যালি। এখন ওপেনএআই যখন চ্যাটজিপিটি বাজারে এনেছে, আর এখাতে বিনিয়োগের বন্যা বইছে, তখন তারা নিরাপত্তার বিষয়ে মেকি আগ্রহ দেখাচ্ছে।যেসব কোম্পানি বিপুল উদ্যমে এই প্রযুক্তি উন্নয়নের চেষ্টা করছে, তাদের অনেক কর্মকর্তাই আবার মানবজাতির জন্য এর বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করছেন। সব মিলিয়ে, এটা তাদের অতি-উন্নত জনসংযোগ (পিআর) প্রচারণা বলেই মনে হয়।"
এআই মানব সভ্যতাকে 'বিলুপ্ত' করবে, এমন ভয়ের পেছনে কাজ করছে কিছু সম্ভাবনা। যেমন আশঙ্কা করা হচ্ছে, তারা ভয়ঙ্কর সক্ষমতা অর্জন করবে। এ ভীতিকে উস্কে দেওয়ার মাধ্যমে পরোক্ষভাবে ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে, এআই কোম্পানিগুলোর হাতেই এখন মানবসভ্যতার অস্তিত্ব রক্ষা বা বিনাশের চাবিকাঠি। যেন তারাই বিধাতার মতো চূড়ান্ত বিচারকের আসনে।
ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটেশনাল লিঙ্গুইস্ট এমিলি বেন্ডার আমায় বলেন, "এমন ধারণা দেওয়ার ফলে তাদের তৈরি পণ্যকে আরো শক্তিশালী বলে মনে করে মানুষ। এতই শক্তিশালী যা এমনকী মানব সভ্যতাকে নিশ্চিহ্ন করতে পারে।" এই ধারণা দেওয়াই হলো এক ধরনের ছদ্ম-বিজ্ঞাপন। সে অনুযায়ী, প্রযুক্তি কোম্পানির প্রধান নির্বাহীরা যেন একেক জন 'অতিমানব' – যাদের কাছে আগুন, বিদ্যুৎ, পারমাণবিক ফিউশন, মহামারি সৃষ্টিকারী ভাইরাস থেকে শুরু করে সব ধরনের পরিবর্তনকারী প্রযুক্তির চাবিকাঠি আছে। অর্থাৎ, তাদের কোম্পানিতে বিনিয়োগ না করলে আপনিই বোকামি করবেন। এটা তাদের সমালোচনা এড়ানোর চালও। যা তারা ফেসবুকসহ তামাক, তেল ব্যবসার অতীত অভিজ্ঞতা থেকে শিখেছে। তারা আগে থেকেই যুক্তি তৈরি করতে চাইছে, যাতে ভবিষ্যতে এআই কোনো বিপদের সৃষ্টি করলে, কেউ তাদের সরাসরি দোষারোপ করতে না পারে। যেন তারা বলছে, "আমরা তো অনেক আগে থেকেই এআই বিষয়ে নিয়ন্ত্রক বিধিমালা কার্যকরের জন্য অনুনয় করে আসছি।"
কিন্তু, এআই সভ্যতার অন্ত ডেকে আনবে এ বিষয়টা আজো কল্পবিজ্ঞান কাহিনির মতোই দূরঅস্ত। এআই নাউ ইনস্টিটিউটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা মেরেডিথ হুইটেকার বলেন, "এই মুহূর্তে নিয়ন্ত্রক বিধিমালার আওতায় যেসব বিষয়ের সমাধান করা দরকার, সেদিক থেকে মনোযোগ অন্যখাতে সরাতে মনগড়া, রোমাঞ্চকর এই গল্প ফাঁদা হয়েছে।"
তার মতে, যদিও জিপিটি-৪ এর মতো এআই প্রোগ্রাম তাদের আগের সংস্করণগুলোর চেয়ে বেশ উন্নত, কিন্তু এ উন্নতি বৃদ্ধিঘটিত। চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতি, কর্মসংস্থান বাজার দখলসহ দৈনন্দিন জীবনের অনেক কিছুতেই নাটকীয় রুপান্তর হয়তো সূচনাও করবে এআই – কিন্তু মাইক্রোসফট ও গুগলের মতো কোম্পানি এই মুহূর্তে যেসব এআই বাজারে আনছে – সেগুলো মানবসভ্যন্তার অন্ত ডেকে আনবে এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। "এআই-গুলোর আরো তথ্য বিশ্লেষণ ও তা পরিবেশনের মাপকাঠিতে আমরা উন্নতি লক্ষ করছি; কিন্তু এসব সিস্টেম যে কার্যপদ্ধতি চলে, তার আমূল পরিবর্তনের মতো মূল বিষয়টা কিন্তু ঘটছে না"- যোগ করেন মেরেডিথ।
যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় 'ম্যানহাটন প্রজেক্ট' এর আওতায় পারমাণবিক বোমা তৈরি করে। প্রকল্পে নেতৃত্ব দেন বিজ্ঞানী রবার্ট ওপেনহাইমার। স্যাম অল্টম্যান তার কোম্পানিকে ম্যানহাটন প্রকল্পের সঙ্গে তুলনা করেছেন, নিজেকেও আখ্যা দেন এ যুগের ওপেনহাইমার হিসেবে। তার মতে, ওপেন এআই এর তৈরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাগুলোর দ্রুত উন্নতি হবে, ফলে তাদের বিপজ্জনক হয়ে ওঠার ঝুঁকি রয়েছে।
এআই নিয়ে সাম্প্রতিক বিবৃতিতে সই করার হপ্তা দুই আগে অল্টম্যান মার্কিন কংগ্রেসে বক্তব্য দেন স্যাম। সেখানে এই প্রযুক্তি মানব অস্তিত্বের হুমকি এমন বক্তব্যে কিছুটা লাগাম দেন। তিনি একটি সিনেট প্যানেলকে বলেন, "শক্তিশালী (এআই) মডেলগুলোর ঝুঁকি হ্রাসে সরকারের নিয়ন্ত্রক বিধিমালা আরোপ অপরিহার্য অবদান রাখবে।" যদিও শুনানি চলাকালে, স্যাম অল্টম্যান-সহ উপস্থিত সিনেটররা ধরেই নেন এআই এর শক্তিবৃদ্ধি অবশ্যসম্ভাবী; আর এর সাথে সাথে যে ঝুঁকিগুলো দেখা দেবে, সেগুলোই প্রযুক্তিটির 'সম্ভাব্য নেতিবাচক দিক'।
কিন্তু, আমি অনেক বিশেষজ্ঞের সাথেই কথা বলেছি যারা বর্তমান সক্ষমতা থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অগ্রগতি কতোটা হবে সেবিষয়ে সন্দিহান। তার প্রায় জোর দিয়েই বলেন, এই অগ্রগতি শুধু মানুষের ক্ষতিই করবে এমনটা নয়। তবে এটাও ঠিক, এরমধ্যেই এআই এর কিছু ব্যবহার মানুষের ক্ষতি করছে। যেমন যুদ্ধবিগ্রহ, নাগরিকদের ওপর নজরদারিতে ব্যবহৃত হচ্ছে। এজন্য তাদের মধ্যে মতভেদ আছে ক্ষতির ক্ষেত্রগুলো নিয়ে এবং এসবের মধ্যে কোনটি বেশি গুরুতর তা নিয়ে। কিছু ক্ষতিকর দিক এরমধ্যেই জনজীবনে প্রভাব ফেলেছে, আর মানুষ তার বিরুদ্ধে সোচ্চারও হয়েছে বহুদিন ধরেই।
যেমন বিদ্যমান কিছু এআই চেহারা শনাক্ত করার ক্ষেত্রে বর্ণবাদী বৈষম্য করেছে; চেহারা থেকে লিঙ্গ শনাক্তেও করেছে ভুল। স্বাস্থ্য পরীক্ষার বিতর্কিত ফলাফল দিয়েও সমালোচিত হয়েছে। কিছু কোম্পানির কর্মী নিয়োগে ব্যবহৃত এআই লিঙ্গবৈষম্যের মতো আচরণ করেছে। অ্যালবার্ট ফক্স কান মনে করেন, যতদিন না এর ব্যতিক্রম হয়, ততোদিন ধরেই নিতে হবে এআই প্রোগ্রাম পক্ষপাতদুষ্ট। এরমধ্যেই তারা ভঙ্গ করছে তথ্যের কপিরাইট ও এবং তথ্য পরিবেশক কর্মীদের শ্রম অধিকার। এআই-চালিত সিন্থেটিক মিডিয়া আর্থিক জালিয়াতি এবং অনুমোদনহীন পর্নোগ্রাফিতে ইন্টারনেট ভরিয়ে তুলছে।
মোজিলা ফেলো এবং অ্যালগরিদম পক্ষপাতদুষ্টতা বিষয়ে গবেষণাকারী ডেবোরা রাজী বলেন, 'মানবসভ্যতার জন্য হুমকি' এমন সব কাল্পনিক গল্প ফেঁদে বর্তমান এসব সমস্যা থেকে সাধারণ মানুষ ও সরকারের দৃষ্টি অন্যদিকে সরানোর চেষ্টা করছে টেক জায়ান্টরা। "আজকেই আমরা যেসব সমস্যাকে উপলদ্ধি করতে পারি, যেটা সমাধানের চেষ্টা করতে পারি – সেখান থেকে আমাদের অন্যমনস্ক করা হচ্ছে।"
তার মতে, বর্তমানে পক্ষপাতদুষ্টভাবে তৈরি (এআই) অ্যালগরিদম সংখ্যালঘু ও পিছিয়ে থাকা অনেক জনগোষ্ঠীকেই বেশি বঞ্চিত করে। ফলে সহজেই বেশিরভাগ মানুষ এসব ক্ষতির দিকে মনোযোগ দেয় না। কিন্তু, সভ্যতার পতন হলে তাতে সমাজের সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণিও ধবংস হবে। এজন্যই এনিয়ে এত শোরগোল। রাজী ব্যাখ্যা করেন, "বাস্তব যে ক্ষতি হয়, স্যাম অল্টম্যান যদি তার সাথে সংশ্লিষ্ট নয় এমন বক্তব্যও দেন, তবু মানুষ (সিংহভাগ) তাতে গুরুত্ব দেয় ঠিক একারণেই।"
মানুষ যতই মনোযোগ দিক, অনেক কথাই যে অসার তার প্রমাণও আছে। যেমন মার্কিন সিনেটে শুনানি দেওয়ার দিনকয়েক বাদেই লন্ডনে অল্টম্যান সাংবাদিকদের জানান, ইউরোপীয় ইউনিয়নের এআই বিধিমালা বেশি কঠোর হলে, এই মহাদেশে আর ব্যবসাই করবে না তার কোম্পানি। এই বক্তব্যে ওঠে সমালোচনার ঝড়। তখন বাধ্য হয়ে এক টুইট বার্তায় তিনি লেখেন, ইউরোপ ছাড়ার কোনো পরিকল্পনা নেই ওপেনএআই- এর।
ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিলি বেন্ডার বলেন, একটি যৌক্তিক বিধিমালা যে ওপেনএআই- এর বর্তমান ব্যবসার মডেলের জন্য হুমকি স্যাম অল্টম্যানের সাম্প্রতিক বক্তব্যগুলো সেটাই প্রমাণ করে।