চাকরি নেই, কিন্তু জমানো কিছু টাকা আছে, কী করবেন?
সারাবছর অনেক মানুষ অনেক কারণে চাকরি হারান। আমার আলোচনা হচ্ছে, আপনারা যারা অনেক বছর চাকরি করেছেন, বিভিন্ন কারণে চাকরি থেকে বের হয়ে এসেছেন বা বের হয়ে আসতে হয়েছে- রিটয়ারমেন্টের আগে বা পরে, আপনাদের হাতে এখন বেশ কিছু টাকা আছে। আপনার কাছে হয়ত পেনশনের কিছু টাকা আছে, অফিস থেকে কিছু বেনেফিট পেয়েছেন অথবা ব্যাংকে আপনার কিছু জমা টাকা আছে। এই টাকা দিয়ে এখন কী করবেন, সেটা নিয়ে আপনি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন। আমি ঠিক এই বিষয়ে আপনাদেরকে কিছু পরামর্শ দেব, আপনি পছন্দ নাও করতে পারেন তবুও, কারণ এই পরামর্শগুলো আপনার খুবই দরকার।
আমি কয়েকজন মানুষকে চিনি, যারা চাকরি থেকে বের হয়ে আসার পরে তাদের সমস্ত টাকা একটি ব্যবসায় খাটিয়েছেন এবং পুরোটাই হারিয়েছেন। যদি চোখ-কান একটু খোলা রাখেন, আপনি অনেক উদাহরণ পাবেন আপনার চারপাশে, পরিচিতজনদের মাঝে।
সম্প্রতি এক ভদ্রলোক, একটি প্রাইভেট ব্যাংক থেকে রিটায়ারমেন্টের আগেই বের হয়ে এসেছেন। তারপর উনি ওনার হাতে যে টাকা ছিল, সে টাকা পুরোটাই একটা ব্যবসায় খাটালেন। অল্প দিন পরেই ব্যবসা থেকে ছিটকে পড়লেন। ওনার একটা অ্যাপার্টমেন্ট ছিল, সেই অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি করে দিলেন। বিক্রি করে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করলেন, কিছু টাকা নিজের প্রয়োজনে খরচ করলেন। অন্য আর একটা ব্যবসা দাঁড় করানোর চেষ্টা করলেন, কিন্তু সেখানেও লোকসান করলেন। আবার ব্যবসা থেকে ছিটকে পড়লেন। এখন ব্যবসাও নেই, টাকাও নেই কিন্তু সংসার আছে, খরচ আছে।
এই অবস্থায় আমার পরামর্শ তাহলে কী?
প্রথম কথা হচ্ছে, যারা চাকরীজীবী তারা অধিকাংশই কিন্তু বিজনেস ম্যাটেরিয়াল না। যদি তার মধ্যে বিজনেস করার সম্ভাবনা থাকে, চাকরি করতে করতে সেটা অনেকটাই কমে আসে। তাই যখন কোনো চাকরিজীবী ব্যবসা শুরু করবেন, তাকে হাজার বার চিন্তা করা দরকার। চিন্তা করার পরে যদি আপনি ডিসিশন নেনও, যে আপনি বিজনেস করবেন, তাহলে আপনি যেটা করবেন না, সেটা হচ্ছে-
১) আপনার সমস্ত টাকা বিজনেস এ ইনভেস্ট করবেন না। খুব বেশি হলে মাত্র ৪০% বিজনেস এ ইনভেস্ট করবেন। বাকি যে ৬০% টাকা থাকবে সেটা একটা নিরাপদ বিনিয়োগের মধ্যে রাখবেন। যদি আপনি মনে করেন যে, এই ব্যবসা আপনি করতে পারবেন তাহলে অল্প দিনেই বুঝে ফেলবেন। যদি সেখান থেকে আপনার লাভ হতে শুরু করে এবং আপনার মনে বিশ্বাস জন্মে যে, আপনি এই কাজটা করতে পারবেন, তখন আস্তে আস্তে আরো কিছু টাকা ইনভেস্ট করুন। সেক্ষেত্রেও আপনি পুরো টাকা ব্যবসায় বিনিয়োগ করবেন না। আর এই ক্ষেত্রে একটা জিনিস খুব বিবেচনা নেওয়া দরকার; সেগুলো হচ্ছে- আপনার বয়স, আপনি কত বছর বয়সে চাকরি থেকে বের হয়েছেন এবং সামনে কত বছর আপনি কাজ করতে পারবেন। বয়স বেশি হলে বেশি ঝুঁকির মধ্যে ঢোকা ভুল হবে।
২) আপনার কাছে যে ইনভেস্টিবল ফান্ড বা আপনার মোট জমানো টাকা আছে, এই টাকা আপনি অন্যের কোনো ব্যবসায় বিনিয়োগ করবেন না, তা সে যত ভালোই হোক না কেন। বিশেষ করে আপনার আত্মীয় স্বজনের কোনো ব্যবসায় আপনি অবশ্যই বিনিয়োগ করবেন না এই প্রত্যাশায় যে, সে আপনাকে প্রচুর মুনাফা করে দেবে এবং আপনি সেই মুনাফা ভোগ করবেন, সেই মুনাফা দিয়ে আপনি চলবেন। এটা হবে মারাত্মক একটা বোকামি। কারণ প্রথম কয়েক মাস আপনি দেখবেন যে, ভালো বেনেফিট পাচ্ছেন। তারপরে একসময় দেখবেন আর কিছুই পাবেন না। তবে যদি খুব বিশ্বাস করে, ভাল ভেবে অন্যের বাবসায় বিনিয়োগ করেনও, সেক্ষেত্রেও আপনার সমস্ত টাকা আপনি বিনিয়োগ করতে যাবেন না।
৩) নিজের আয়ত্তে থাকা সব টাকা আপনি আপনার আপনজনদের হাতে উঠিয়ে দেবেন না। কোনো চাপে পড়ে বা কোনো আলোচনায় মুগ্ধ হয়ে আপনি আপনার আপনজনদের হাতে সব টাকা উঠিয়ে দেবেন না। এটা হতে পারে, আপনার ছেলে, আপনার মেয়ে কিংবা ভাইবোন। কারও হাতে না। উঠিয়ে দিলে কী হবে? প্রথম কথা হচ্ছে, আপনি আপনার টাকার নিয়ন্ত্রণ হারাবেন। তখন দশ টাকার দরকার হলেও আপনার সে টাকা চেয়ে নিতে হবে। যদি ব্যবসা খুব ভালো হয় তাহলে আপনার পরিবারে টাকাটা থাকছে, আপনি চাইলেই হয়ত পাবেন যদিও সম্ভবনা খুব কম। আর যদি ব্যবসা খারাপ হয়, তখন আপনি আপনার টাকা হারালেন, তারা তাদের ব্যবসা হারালো এবং আপনি তাদের কাছে যে টাকা পাবেন, সেটা দেওয়ার মতন সামর্থ্য তাদের থাকবে না, সম্পর্ক তিক্ত হবে। তাই পরামর্শ হচ্ছে, আপনি আপনার সমস্ত টাকা কোনো আপনজনের হাতে উঠিয়ে দেবেন না।
যদি আপনার ছেলে বা মেয়ের বিজনেসে আপনাকে ইনভেস্ট করতেই হয়, তাহলে সেক্ষেত্রে যে ফর্মুলা মনে রাখতে হবে, সেটা হচ্ছে আপনার সব টাকা নয়। হতে পারে আপনার মোট টাকার ৩০ ভাগ বা সর্বোচ্চ ৪০ ভাগ।
প্রশ্ন হচ্ছে, যেহেতু মানুষ এখনো চাকরি থেকে বের হওয়ার পরে বা রিটায়ারমেন্টের পরে অনেকদিন কর্মক্ষমও থাকেন, তারা তাহলে কী করবেন?
প্রথম যে কাজটি করবেন সেটি হলো, আপনি যে কাজ সারাজীবন ধরে শিখেছেন, সেই কাজের কনসালটেন্সি করবেন যদি ভাল লাগে। অনেকে যারা ওই কাজটা বোঝেন না, তাদেরকে সেই কাজটা শেখাবেন। অনেকের প্রতিষ্ঠানে যদি আপনার ওই কাজের ভ্যালু থাকে তখন আপনি সেই প্রতিষ্ঠানে ভ্যালু অ্যাড করার চেষ্টা করবেন। ওখানে আপনার মেধা খাটবে, শরীর খাটবে, কিন্তু আপনার পকেটে যে টাকা ছিল সেটা নষ্ট হবে না। আপনি সেখান থেকে আরো টাকা উপার্জন করতে পারবেন। কনসালটেন্সি যদি আপনার পছন্দ না হয়, তাহলে আপনি ফুল টাইম জব করেন। আপনি ব্যাংকার হলে দেখবেন অনেক প্রতিষ্ঠানের অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার দরকার হয়, আপনি সেখানে চাকরি করতে পারেন। প্রত্যেকটা প্রতিষ্ঠানে তাদের অ্যাকাউন্টস দেখতে হয়, ব্যাংকিং কার্যক্রম সামলানো লাগে। আপনি সেসব ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোকে সাহায্য করতে পারেন।
আর একটি বিষয় হচ্ছে যে, জ্ঞান অর্জন করুন, পড়াশোনা করুন, ধর্মীয় বই পড়ুন, প্রার্থনা করুন। বর্তমান সময়ের সাথে খাপ খাইয়ে নিজেকে প্রতিমুহূর্তে আপডেট করুন। আর যে টাকা আপনার কাছে আছে, সেই টাকা আপনি নিরাপদে বিনিয়োগ করুন এবং টাকার নিয়ন্ত্রণটা নিজের কাছে রাখুন।
নিরাপদ বিনিয়োগটা কী রকম?
সবচেয়ে নিরাপদ হচ্ছে, আপনি যদি খুব ভালো ব্যাংকে টাকা রাখেন। আপনাকে তার একটা প্রফিট দেবে বা সুদ দেবে। কিন্তু ব্যাংকটি ভালো হতে হবে। কারণ বাংলাদেশে কিছু কিছু এরকম ঘটনা এরমধ্যে ঘটে গেছে যে, অনেক লিজিং কোম্পানি তারা তাদের গ্রাহকদের টাকা দিতে পারেনি। দুয়েকটি ব্যাংকও দিতে পারেনি। ফলে, আপনি যত্ন সহকারে ভালো ব্যাংক দেখে টাকা রাখুন। সবচাইতে ভালো, আপনি সরকারি সঞ্চয়পত্রে ইনভেস্ট করুন। তাছাড়া, আপনি শেয়ার বাজারেও ইনভেস্ট করতে পারেন। শেয়ার বাজারে কিছু কোম্পানি আছে যাদের ফান্ডামেন্টাল খুবই ভালো। আপনি নিজে একটু খোঁজ করলে পাবেন। সেই সব ক্ষেত্রে আপনি ওই সব শেয়ারে ইনভেস্ট করুন। কিন্তু শেয়ারে বেশি বিনিয়োগ করা ঠিক হবে না। এখানে ঝুঁকি জড়িত।
তারপর আপনি আইসিবি ইউনিটে বিনিয়োগ করতে পারেন। আপনার টাকা আপনি ল্যান্ডে ইনভেস্ট করতে পারেন; কিন্তু মনে রাখতে হবে, ল্যান্ডে আজ ইনভেস্ট করলে কালকে আপনি লিকুইডেট বা ক্যাশ করতে পারবেন না। এটা লিকুইডেট করতে সময় লাগবে। এজন্য পুরো টাকা ল্যান্ডে ইনভেস্ট করা ঠিক না। কারণ আপনার এখন ক্যাশ টাকার ফ্লো দরকার। সুতরাং, আপনার যে টাকা আছে এই টাকাটা আপনি কয়েকটা ভাগে ভাগ করতে পারেন। পোর্টফোলিও ম্যানেজমেন্ট যেভাবে করে, যে কিছু টাকা আপনি শেয়ারে রাখলেন, কিছু টাকা সঞ্চয়পত্রে রাখলেন, কিছু টাকা ব্যাংকে রাখলেন, কিছু টাকা ল্যান্ডে ইনভেস্ট করলেন এবং কিছু টাকা আইসিবি ইউনিটে ইনভেস্ট করলেন। অ্যামাউন্টের উপর নির্ভর করবে আপনি আসলে কী করবেন। আমার পরামর্শের সাথে নিজের কিছু আইডিয়া যোগ করলে আপনি পথ পেয়ে যাবেন।
৪) আরেকটা বিষয় হচ্ছে নিজেকে কাজ থেকে দূরে রাখবেন না। আমার এক ইউনিভার্সিটির বড় ভাইকে একটি কারণে বেশ কয়েক বছর আগে চাকরি থেকে বের হয়ে আসতে হয়। ধকল সামলাতে পারেননি তিনি। প্রথমে চেষ্টা করছিলেন টিকে থাকতে, পরে হতাশা পেয়ে বসেছিল তাকে। দুঃখের বিষয় হল, একসময় তিনি মারা যান। আমার পরামর্শ হল, যারা চাকরি থেকে বের হয়ে আসছেন তারা নিজেকে ব্যস্ত রাখবেন। সেটা প্রার্থনায় রাখেন, কাজে রাখেন বা পড়াশুনায় রাখেন। কাজ না করে টেনশন করবেন না। তাহলে আপনার মন, শরীর সব ভেঙে পড়বে। বেশি টেনশন করতে করতে এক সময় অসুস্থ হয়ে পড়বেন।
চাকরী থেকে বের হওয়ার পর আপনার সময়টা সাচ্ছন্দে কাটবে, আনন্দে কাটবে যদি আপনি কপর্দকশূন্য হয়ে না পড়েন, নিঃস্ব হয়ে না পড়েন। ভুলেও সবসময় ছেলে-মেয়ের কাছ থেকে সমান ফিডব্যাক আশা করবেন না। মনে রাখতে হবে তাদেরও সংসার আছে, তাদেরও সক্ষমতার ব্যাপার আছে।
সত্যি কথা হচ্ছে, আর্থিক ব্যবাস্থাপনা খুব বড় একটি বিষয়। যত আপনি প্রশিক্ষিত হবেন, তত আপনি আপনার ফান্ডের ব্যাবস্থাপনা করতে পারবেন। এখানে বয়স কোনো বিষয় নয়। যেকোন সময় আপনি এই জ্ঞান অর্জন করতে পারেন এবং আপনার জীবনে কাজে লাগাতে পারেন।
লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক, ফাইন্যান্স ও বিজনেস স্ট্রাটেজিস্ট; ইউটিউবার ও সিইও, ফিনপাওয়ার লিডারশীপ ইন্টারন্যাশনাল
ইমেইল: [email protected]
- বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফল। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।