সাপের ভয় যেভাবে হলো জয়!
শৈশবের ভয়াল স্মৃতি
বয়স তখন আমার সবে পাঁচ কী ছয়। ১৯৯২ সালের ঘটনা। বন্যার তোড়ে সেইবার মানিকগঞ্জের বেশ কিছু গ্রামাঞ্চল ডুবে গিয়েছিল। আমাদের গ্রামের অধিকাংশ এলাকা তখন পানির নিচে।
বাবা-মায়ের সাথে গ্রামে গিয়েছিলাম ওই সময়ে। বাবা- মা গিয়েছিলেন বন্যায় এলাকার মানুষের জন্য কিছু ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে। সেগুলোর কিছু অংশ পাশের পাড়ার কয়েকজনকে নেয়ার জন্য ডাক দিতে মা আমাকে কোলে নিয়ে একটি সাঁকো পার হচ্ছিল। সাধারণত গ্রামে কোথাও বৃষ্টি বা বন্যার পানি জমলে সেই স্থান পার হতে সোজাসুজি কোনো গাছ, ডাল বা বাঁশের মই পেতে রাখা হয়। একেই সাঁকো বলে।
আমি মায়ের কোলে, অবুঝ নয়নে দেখছি চারপাশের প্রকৃতি। সুপারি গাছ ফেলে সাঁকো বানানো, গত রাতের বৃষ্টিতে পিচ্ছিল হয়ে আছে। সাকোর চার-পাঁচ ফুট নিচে পানির স্রোত, বন্যার ঢল।
হঠাৎ পিচ্ছিল সেই গাছ পার হয়ে গিয়ে মা পা ফসকে পড়ে গেলেন পানিতে। ঘোলা-সবুজাভ পানিতে শিশু আমি মুহূর্তেই তলিয়ে গেলাম।
পানি মায়ের গলা অব্দি। কোনোমতে স্রোত ঠেলে পাড়ে তিনি উঠতে পারতেন, কিন্তু আমাকে খুঁজতে তিনি পানিতেই রয়ে গেলেন, চিৎকার করছেন ত্রাহি স্বরে। এদিকে কোনো অজ্ঞাত কারণে আমি টের পেলাম, কেবলই পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছি আমি। নিশ্বাস বন্ধ বয়ে আসছে, শরীরে কীসের যেন জোরালো চাপ লাগছে, শক্ত পাথর গায়ে চাপানোর মতো তীব্র সেই চাপ।
মায়ের আতঙ্কমাখা চিৎকারে আশপাশ থেকে কৃষক ও জেলেরা ছুটে এসে পানিতে নামে, ডুবন্ত আমাকে পানি থেকে তুলে নিতে সচেষ্ট হয় তারা। কিন্তু সেখানেই বাধে বিপত্তি। তিন-চারজন কৃষক মিলেও আমাকে টেনে তুলতে পারে না! ওদিকে আমার দম প্রায় শেষ, অবুঝের মতো হাত পা ছুড়ছি, চোখে নীলাভ অন্ধকার, আর সেই ঘোলাটে দৃষ্টিতে কেবল কালচে কিছু চোখে পড়ছে।
গলা দিয়ে পানি ঢুকে গেছে আমার, অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করছি। কৃষক আর জেলের দলও হার মানতে নারাজ, আমাকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে তুলল ডাঙায়। তখনই টের পেল সবাই, আমার পা দুটো হাঁটু থেকে পেঁচিয়ে ধরেছে এক মধ্যবয়সী অজগর সাপ। লম্বায় প্রায় এগারো ফুট। বন্যার পানিতে ভেসে এসেছিল সম্ভবত, ওত পেতে ছিল পানির গভীরে, শিকারের আশায়।
শৈশবের এই ভয়ংকর স্মৃতি আমাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে কয়েক বছর আগ অব্দি। ঘুমাতে গেলেই চোখে ভাসত সেই ঘোলা পানি, কালচে ভারী কিছুর আমাকে পানির গভীরে টেনে নেয়া…
গ্রামে বা শহরে যেখানেই ঘুমাতাম, পা গুটিয়ে শুয়ে থাকতাম চাদরমুড়ি দিয়ে।
বিষধরের সাথে প্রথম সাক্ষাৎ
তখন আমি চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ি। গ্রামে বেড়াতে গিয়েছিলাম গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে। সারাদিন দৌড়-ঝাঁপ, ঝরে পড়া আম কুড়ানো চলছে, সমানতালে চলছে চড়ুইভাতির দুরন্তপনা।
একদিন দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে যথারীতি মাঠের দিকে দৌড়ে যাচ্ছিলাম। রাস্তা সংক্ষিপ্ত করার ধান্ধায় ধানখেতের আইল ধরে ছুটে চলার বুদ্ধি করলাম। আগের সপ্তাহে ধান কেটে নেওয়ায় ফাঁকা খেতের আইল ধরে দৌড় দেয়া সহজ কাজ। তেমন ভেবেই ছুটছিলাম।
কিছুদূর আগানোর পর হঠাৎ ডান চোখের কোণে একটু নড়াচড়া ধরা পড়ল। কিছু টের পাবার আগেই প্রায় চার ফুট লম্বা-হলদে খয়েরি রঙের, মোটা দড়ির মতো কিছু একটা আমার দুই পায়ের ওপর দিয়ে ছুটে পালাল। খালি পায়ে ছিলাম বলে সেটার পিচ্ছিল, ঠাণ্ডা স্পর্শে ভয়টা আরও বেশি পেয়েছিলাম। জীবনে দ্বিতীয়বার সাপের সংস্পর্শে আসা হলো আমার।
সাপটা ততক্ষণে কিছুদূর গিয়ে থমকে ঘুরে তাকিয়েছে, উদ্ধত ফণা তুলে দেখছে আমাকেই। আসলে সে-ও দ্রুত ছুটে যাচ্ছিল আইলের এপার থেকে ওপারে, মাঝে আচমকা আমি এসে পড়েছি। সেই চলার গতির কারণেই আমাকে পার হয়ে গিয়েছে কিছু বোঝার আগেই, উপস্থিত কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেনি।
পাশের খেতের দুজন কৃষক আমার সাথে ঘটা দৃশ্যটা ঠিকই দেখেছে। তারা লাঠি নিয়ে ছুটে আসার আগে সাপটা কেবল ঘুরে নিজের ফণা তুলে আমাকে দেখছিল। যেন সাবধান করছিল তার চলার পথে আর না আসার জন্য। কৃষকেরা সাপটা মারতে উদ্যত হলেও আমার তখন আসলে ভয়ে অস্থির অবস্থা। বিষধর গোখরার (এখন চিনি, সেটা ছিল খৈয়া গোখরা) সাথে এমন ভয়ানক সংস্পর্শে এসে বেঁচে যাওয়া ওই বয়সে আসলে একদম মৃত্যুর মুখ থেকে ফেরার মতন।
সাপটা এত মানুষ দেখে মুখ ঘুরিয়ে ঝোপের দিকে চলে গেল। আমাকেও দ্রুত কৃষকেরা ধরে বাড়িতে নিয়ে আসে। কয়েক গ্লাস পানি গলায় ঢেলে তবে শান্ত হই। দুই পায়ে ভালোমতো চোখ বোলাই, কোনো দংশন ইত্যাদির দাগ আছে কি না দেখতে। এলাকার মানুষেরা বারংবার বলছিল, জাতি সাপে ছুঁয়েছে, আর রক্ষে নেই!
বিষধর সাপ নিয়ে সেই ছিল আমার প্রথম অভিজ্ঞতা।
রাজার সাথে দেখা
শৈশবের সেই অজগর আর পরে ওই গোখরার ভয়ংকর স্মৃতি আমার মনে জাগিয়েছিল সাপের প্রতি নিদারুণ ভয়। সাপ শব্দটা শুনলেই ভয়ে কেঁপে উঠতাম। রীতিমত মানসিক রোগে পরিণত হয় আমার সেই সর্পভীতি।
কলেজ পার করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। ভয় পেতে পেতে ক্লান্ত আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আর ভয় নিয়ে থাকা যাবে না। মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হলাম। তার বুদ্ধিতেই একসময় সাপ সম্পর্কে জানতে, শিখতে চেষ্টা করলাম। ভয়ের স্বরূপকে চিনে ফেললে, তার রহস্য জানলে ভয় নাকি কাবু হয়।
একসময় সেটাই সত্য হলো। একটু একটু করে সাপ চেনা-জানার ফলে ভয় কমতে লাগল।
সেই থেকে সাপেদের রহস্যময় দুনিয়া, তাদের অদ্ভুত আচরণ ইত্যাদির প্রতি আগ্রহ জন্মে। পরবর্তীতে বহুবার বিভিন্ন সাপ দেখেছি, তাদের সংস্পর্শে এসেছি, জেনেছি। এখনও জানছি। বুঝেছি, আতঙ্ক নয়—সতর্কতা আর সচেতনতাই পারে সাপের ভয় দূর করতে।
আর এভাবেই মোকাবেলা করেছিলাম জীবনে সাপের সাথে সবচেয়ে ভয়ংকর অভিজ্ঞতাটির।
২০১৪ সালের শেষ দিকের কথা। এক বিখ্যাত তরুণী কণ্ঠশিল্পীর সাথে কক্সবাজারের এক কনসার্টে বেইজ বাজাতে গিয়েছি। শো রাতেই শেষ, পরেরদিন সময় মিলিয়ে বান্দরবান গিয়েছিলাম ঘুরতে। সেই কণ্ঠশিল্পী (সঙ্গত কারণেই তার নাম উহ্য রাখছি) আর আমি ঘুরে দেখার ইচ্ছেতে সেখানকার স্বর্ণ মন্দিরের পেছনদিকের এক পাহাড়ের চাতালে উঠেছি কেবল। ইচ্ছে, প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যঘেরা বান্দরবানকে পাহাড়ের ওপর থেকে একটু ভালোমতো পর্যবেক্ষণ করা।
সবে স্বর্ণ মন্দিরের চূড়ার কয়েকটা ছবি তুলেছি ক্যামেরায়, অমনি পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা সেই গায়িকার মৃদু চিৎকারে ঘুরে তাকালাম। চক্ষু চড়কগাছ কাকে বলে, সেদিন টের পেয়েছিলাম প্রথমবার।
প্রায় বারো ফুট দৈর্ঘের এক রাজগোখরা, তার রাজসিক রূপ আর তেজ নিয়ে, প্রায় চারফুটের অধিক ফণা তুলে দাঁড়িয়ে আমাদের সামনে। তরুণী গায়িকা সেই দেখে ভয়ে অর্ধেক চিৎকার দিয়েই থেমে গেছে।
আমি ততক্ষণে চিন্তা করছি কী কী জানি রাজগোখরার সম্পর্কে।
পৃথিবীর বৃহত্তম বিষধর সাপ, মারাত্মক বিষধর, এসব জানা। পরক্ষণেই খেয়াল হলো, সহসা এই সাপ দংশন করে না। ফণা তুলে ভয় দেখায়, লেজে ভর দিয়ে দ্রুত এগিয়ে আসে তেড়ে, কিন্তু কিছুক্ষণ স্থির থাকতে পারলে, অনড় দাঁড়িয়ে থাকতে পারলে সাপটা নিজ থেকেই আগ্রহ হারিয়ে কিংবা বিপদের ঝুঁকি তার নেই ভেবে চলে যাবে বিপরীত পথে। নিজে স্থির থেকে, ফিসফিস করে গায়িকাকে সে কথা জানান দিলাম।
কিন্তু বললেই কি স্থির থাকা যায়? হিসহিস শব্দের সাথে রাজসিক চাহনি আর হিলহিলে জিভ বের করা সেই বুকসমান ফণাতোলা সাপের সামনে দাঁড়াতেই তো যত ভয়। দাঁতে দাঁত চেপে তবু দাঁড়িয়ে আছি। সাপ মহাশয় ইতিমধ্যে বার দুয়েক আরেকটু কাছে এসেছেন ফণা তেড়ে। প্রতিবার আগানোর মাত্রা বাড়ছে। আর বড়জোর তিন ফুট এগোলেই আমাকে দংশন করবে সে। তবু আমি স্থির।
একসময় সাপটাও থেমে গেল। আমাকে স্থির দেখে মিনিট দুয়েক ফণা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘ মুহূর্ত সম্ভবত সেটাই। তারপর, যেন নিতান্তই আগ্রহ হারিয়ে সাপটা ঘুরে যায়, লম্বা শরীরটা টেনে, ফণা নামিয়ে পেছনের পাহাড়ের ঘন পথে হারিয়ে গেল কালচে-মেটে রঙের সেই রাজ গোখরা।
আমরা দুজনেই হাফ ছেড়ে বাঁচলাম, নতুন জীবন প্রাপ্তির আনন্দ কম নাকি!
এমন নানাবিধ সাপবিষয়ক ঘটনা-দুর্ঘটনার সাক্ষী হয়েছি জীবনে, তবে ভয় আর বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতার কারণে এই তিনটি ঘটনা আমার মতে জীবনের সেরা সর্পবিষয়ক অভিজ্ঞতা আমার। বিষধর সাপ মুখোমুখি বা ছোঁয়ামাত্রই দংশন করে বা ইত্যাদি মিথ অন্তত আমার বেলায় খাটেনি। আমার লেখা থ্রিলার হিমঘুম-এর প্লট গড়ে উঠেছিল এসব অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই। সাপের প্রতি আগ্রহ বা ভালোবাসার সেটাও এক কারণ, এভাবেই একসময় জড়িয়ে পড়ি দেশের অন্যতম সাপ ও বন্যপ্রাণী রক্ষায় অন্যতম সংস্থা ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড কনজারভেশন ফাউন্ডেশন-এর সাথে। প্রকৃতিতে মানুষ ও সাপসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণীর প্রাকৃতিক সহাবস্থান নিশ্চিত করতে সচেষ্ট রয়েছে এ সংস্থা। সাপবিষয়ক সচেতনতা নিয়ে প্রচারণা ও প্রকৃতিতে সাপ রক্ষার বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়নে আরও সফল হোক প্রতিষ্ঠানটি, এ-ই প্রত্যাশা।
- বাপ্পী খান: লেখক, প্রাণীপ্রেমী