কেন অঞ্চলভেদে মার্কিনীদের ভিন্ন ভিন্ন নীতি?
বিশ্বমোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অবশেষে ভারতের মণিপুরের ঘটনা নিয়ে মুখ খুলেছে। মণিপুরের ঘটনায় তারা তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। কয়েক সপ্তাহ আগে মণিপুরে দুজন নারীকে বিবস্ত্র করে প্রকাশ্যে ঘুরিয়ে বেড়ানোর একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তা-ই নিয়ে ব্যাপক প্রতিবাদ চলছে।
ভারতীয় সংসদে ভারতের বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা দাবি তুলেছেন, সংসদ বিধিমালা ২৮৬ অনুসারে সংসদে বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে আলোচনা করতে হবে। ক্ষমতাসীন বিজেপি সংসদ কার্যক্রম স্থগিত করে এই আলোচনা অনুষ্ঠান করতে চাচ্ছেনা। তারা চাচ্ছে নিয়ম মোতাবেক আলোচ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করে পরবর্তীসময়ে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে। এই বিতর্কে ভারতের সংসদ প্রায় অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে।
অন্যদিকে প্রতিদিন যখন ফিলিস্তিনে নানা ধরনের ঘটনা ও হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী, নির্মমতার শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ — তখন ইসরায়েলের পার্লামেন্ট এক অদ্ভুত আইন পাস করেছে। সে আইন হচ্ছে পার্লামেন্টের গৃহীত কোনো সিদ্ধান্তের বিষয়ে বিচার বিভাগের হস্তক্ষেপ করার অধিকারকে সীমিত করা। অর্থাৎ পার্লামেন্ট যে আইন পাস করবে তা নিয়ে বিচার বিভাগ কোনো কথা বলতে পারবে না।
পার্লামেন্ট পদ্ধতির সংসদীয় গণতন্ত্রে বিচার বিভাগ একটি স্বতন্ত্র বিভাগ, যার স্বাধীনতা নিশ্চিত হওয়ার মাধ্যমেই গণতন্ত্রের মাপকাঠি নির্ধারণ করা হয়। ইসরায়েল সেই বিষয়টিকে পাল্টে দিতে চাচ্ছে। নিজেদের সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতাকে সীমিত করার চেষ্টা করছে দেশটি। ইসরায়েলের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু একজন চরম দক্ষিণপন্থী নেতা। ইতোপূর্বে ফিলিস্তিনিদের বিষয়ে বেশ কিছু আইনি পদক্ষেপকে ইসরায়েলের সুপ্রিম কোর্ট আটকে দিয়েছিলেন, যা ইসরায়েলের দক্ষিণপন্থী রাজনীতিবিদদের পছন্দ হয়নি। এই আইন পাশের মূল উদ্দেশ্য তার সঙ্গেই জড়িত।
পৃথিবীর ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংখ্যার দিক থেকে ইহুদিরা অন্যতম ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী। অর্থনৈতিক শক্তিমত্তার কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য নিয়ন্ত্রণ রয়েছে এই ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর। যুক্তরাষ্ট্রের দ্বি-দলীয় রাজনীতির উভয় দলের কাছেই এদের গুরুত্ব অপরিসীম। ফিলিস্তিন কিংবা গাজায় নিয়মিতভাবে হত্যাকাণ্ডের মতো বিভিন্ন যেসব ঘটনা ঘটাচ্ছে ইসরায়েল, সে বিষয়ে কখনো তেমন সুস্পষ্টভাবে মুখ খোলেন না মার্কিন রাজনীতিবিদেরা, বরং প্রকারান্তে তাদেরকে অনেক সময় এসবের সমর্থন দিতেই দেখা যায়।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক বিভিন্ন বিষয়ে মার্কিন এবং ইউরোপের ওপর নির্ভরশীল। আমাদের তৈরি পোশাকশিল্পের প্রধান ক্রেতারা সবাই প্রায় এই দুটি অঞ্চলের। আমাদের ওপর তাদের কর্তৃত্ববাদিতা দেখানোর সুযোগ অনেক বেশি। এ কারণেই বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণের লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় দেশগুলো একত্র হয়ে নেমেছে মাঠে।
যদিও অতীতের বহু নির্বাচন রাষ্ট্রের, সমাজের বিশেষ কোনো সংস্কার করতে পারেনি। বাংলাদেশে জবাবদিহিমূলক সমাজ গড়ে তুলতে পারেনি। ব্যক্তিস্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পারেনি। আজকে যারা বিরোধী দলে এই নির্বাচন সংক্রান্ত আন্দোলন করছেন, তারা বিভিন্ন দফা প্রকাশ করেন। কিন্তু তাদের সুনির্দিষ্ট কোনো প্রস্তাবনা রক্ষা করা হয় না।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করা, নির্বাহী বিভাগকে নিরপেক্ষ রাখা — এ বিষয়গুলো নিয়ে কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই। বক্তব্য নেই কীভাবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সুনির্দিষ্ট করতে হবে তা নিয়েও। ভারতীয় উপমহাদেশের অন্য দুটি দেশের বিচার বিভাগ কীভাবে চলছে, কোন কোন ক্ষেত্রে ওইসব বিচার বিভাগের সঙ্গে বাংলাদেশের পার্থক্য — তা নিয়ে কখনো আলোচনা হতে দেখি না। ভারত ও পাকিস্তানের বিচারবিভাগের শক্তি তাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখেছে। সাম্প্রতিককালের ইমরান খানের বিরুদ্ধে যে অবস্থান গ্রহণ করতে যাচ্ছিল পাকিস্তানের সেনাবাহিনী, তা আটকে দিয়েছে পাকিস্তানের বিচার বিভাগ।
ভারতীয় রাজনীতিবিদেরা বিচার বিভাগকে তাদের অধীনস্থ করতে বিচারক নিয়োগের জন্য নতুন আইন প্রণয়নের চেষ্টা করেছিলেন সংবিধানের ৯৯তম সংশোধনী এনে। কিন্তু ভারতের বিচার বিভাগ তা আটকে দিয়েছে সংবিধানের মৌলিক পরিপন্থী সংশোধনী হিসেবে গ্রহণ করে।
কিন্তু ইসরায়েলের পার্লামেন্টের পাশকৃত আইন এখন ইসরায়েলের বিচার বিভাগ কীভাবে গ্রহণ করবে সেটি হলো প্রশ্ন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প ও বর্তমান রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন — উভয়ের পরিবার দেশটির বিচার বিভাগের কাছে দায়বদ্ধ। মাদক সেবন ও কর ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগে জো বাইডেনের ছেলের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে এখন।
মার্কিন এই প্রতিনিধিরা কখনো অনুন্নত দেশগুলোর বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে সুনিশ্চিত করার বিষয়টিকে সামনে আনেন না। কিংবা দেশগুলোর নির্বাহী বিভাগ কীভাবে তাদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতে পারবে, সে ব্যাপারে কোনো আলোচনা আমরা দেখি না। কেবল আমাদের অর্থনীতির এক ধরনের নির্ভরশীলতা আছে বলেই রাজনীতিতে এমন অনধিকার প্রবেশ করতে পারেন তারা।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।