কৌশল নাকি মানসিকতা? আর্থিক স্বাধীনতার জন্য কোনটি গুরুত্বপূর্ণ
আর্থিক স্বাধীনতা অর্জন প্রত্যেকটা মানুষের কাঙ্ক্ষিত বিষয়। প্রত্যেকেই চায় আর্থিকভাবে স্বাধীন হতে। ধরুন, কোনো ব্যক্তি তার প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ছাড়া টাকা আয়ের মাধ্যমে একটি পরোক্ষ আয়ের প্রবাহ তৈরি করেছেন। এ প্রবাহ দিয়ে তিনি তার জীবন যথারীতি নির্বাহ করতে পারবেন। এমন হলে ঐ ব্যক্তিকে যেমন সম্পদশালী বলা যায় তেমনি তিনি একইসঙ্গে আর্থিকভাবে স্বাধীনও।
আর যাদের প্রতি মাসেই ভাবতে হয় যে তিনি এ মাসে কীভাবে চলবেন — যদি আয় করতে না পারি, তাহলে আমি এ মাস চলতে পারব না — তারা মূলত একটা ইঁদুর দৌড়ের মধ্যে থাকেন। তাদেরকে আর্থিকভাবে স্বাধীন বলা যায় না। মোটাদাগে আমাদের সমাজের বেশিরভাগ মানুষ এ দলের অন্তর্ভুক্ত।
আর্থিক স্বাধীনতা অর্জনের জন্য অনেক কৌশল রয়েছে। আপনি আপনার অর্জিত অর্থের ব্যবস্থাপনা কীভাবে করবেন, কোথায় কোন খাতে কীভাবে-কতটুকু বিনিয়োগ করবেন — এসব বিষয়ে বেশকিছু ফর্মুলা আছে।
আর্থিক স্বাধীনতা অর্জনের জন্য প্রথমে প্রয়োজন নিজেকে প্রশিক্ষিত করা। দরকার অর্থনৈতিক সাক্ষরতা সম্পর্কে জ্ঞান রাখা। আপনাকে ভাবতে হবে, আপনার গৃহীত আর্থিক কৌশল আপনার লক্ষ্যার্জনকে সম্ভব করেছে কি না।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আর্থিক স্বাধীনতা অর্জনের যে রোডম্যাপ আপনি তৈরি করেছেন, সেটার বাস্তবায়ন করবে কে? বাস্তবায়নের কাজটা মূলত আপনাকেই করতে হবে। তবে এক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে আপনার মানসিকতা।
বলা হয়, কৌশলের তুলনায় মানসিকতা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর্থিক স্বয়ম্ভরতার যাত্রায় মানসিকতার অবদান ৮০ শতাংশ। আর কৌশল বা স্ট্র্যাটেজির অবদান হচ্ছে মাত্র ২০ শতাংশ। তবে দুটোর মধ্যে একটা সংঘর্ষ তৈরি হতে পারে।
কারণ, আপনি যদি আপনার মনকে তৈরি করতে না পারেন, এবং মন যদি আপনার পরিকল্পনার বিরুদ্ধে কাজ করে, তাহলে সেই পরিকল্পনা আপনি বাস্তবায়ন করতে পারবেন না। মানসিকতা যেকোনো সাফল্যের জন্য সবচাইতে প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটকের কাজ করে।
মানসিকতা বলতে কী বোঝায়? মানসিকতা বা মাইন্ডসেট হচ্ছে মূলত আপনার মেন্টাল অ্যাটিটিউড, যেটা বছরের পর বছর ধরে বিভিন্নভাবে তৈরি হয়েছে। এই অ্যাটিটিউড বা মনোভাব নির্ধারণ করে আপনি যে যাত্রা শুরু করেছেন, তা সফলভাবে শেষ করতে পারবেন কি না।
আপনার যদি ধৈর্যক্ষমতা খুব কম থাকে, আপনি যদি কোনো একটা পরিস্থিতিতে খুব মুষড়ে পড়েন বা দ্রুত ভেঙে পড়েন, যদি অল্প কিছু লোভনীয় জিনিস দেখে অনেক বেশি লোভাতুর হয়ে পড়েন, আপনি যদি সামান্য বিপদে বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন, তাহলে আপনার জন্য যেকোনো সাফল্যে পৌঁছানো কঠিন হবে বইকি।
এজন্য সবার আগে যেটা দরকার, তা হলো কৌশল সুনির্দিষ্ট করা। কোনো একটা কৌশল ঠিক করার পর আপনার মানসিক পরিস্থিতি সামলানো খুব দরকার। কারণ, এখানে অন্য কেউ কৌশল বাস্তবায়নে আপনাকে সাহায্য করবে না, আপনার নিজেই নিজেকে সাহায্য করতে হবে।
ধরুন, কেউ ১০ বছর মেয়াদি একটি (ডিপোজিট পেনশন স্কিম) করেছেন। কিন্তু পাঁচ বছর পর কোনো সমস্যায় পড়ে সেটা ভেঙে ফেললেন। এভাবে মাঝপথে ভেঙে ফেললে সুদ পাওয়া যায় না, কেবল মূলধনই ফেরত দেওয়া হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। আর্থিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এর ক্ষতির পরিমাণটা বেশ বড়। কিন্তু এখানেই রয়েছে লড়াকু মনোভাবের প্রশ্ন। কারণ অনেকে আছেন, জীবন গেলেও ঐ টাকায় তিনি হাত দেবেন না, বরং বিকল্প কোনো উপায় দেখবেন।
আপনি যদি আর্থিকভাবে স্বাধীন হতে চান, তাহলে জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত, ছোটখাটো বিপদআপদ দেখা দিলে আপনাকে সতর্ক থাকতে হবে যেন এগুলো আপনার আর্থিক কৌশলকে উলটপালট করে না দেয়। সেরকম কিছু হলে আবার শূন্য থেকে শুরু করতে হয়। কিন্তু দেখা যায়, নতুন করে শুরু করতে অনেকের মানসিক শক্তিও থাকে না।
আর্থিক স্বাধীনতা একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। ধনী হওয়ার প্রক্রিয়াটি কিন্তু খুব স্বল্প সময়ের নয়। এ জন্যই মনে রাখতে হবে, কৌশল নির্ধারণই সবকিছু নয়। কৌশলের উপযুক্ত বাস্তবায়নই হচ্ছে সাফল্যের চাবিকাঠি। আর তার জন্য চাই দৃঢ় মানসিকতাও।
লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক; ফাইন্যান্স ও বিজনেস স্ট্রাটেজিস্ট; সিইও, ফিনপাওয়ার লিডারশিপ ইন্টারন্যাশনাল
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।