ঢাকা নগরবাসীর পৌরজ্ঞান: গাছে ফুল নয়, কফ ভর্তি টিস্যু ঝুলে
ঢাকা শহরের মোটামুটি ভাল একটি এলাকায় আমার বাস। সুউচ্চ, চমৎকার সব আধুনিক ভবন, গাছগাছালিও আছে। প্রতিটি বাড়িতেই গাড়ি-দারোয়ান সবই আছে। দেখে ধারণা করি এখানে যারা থাকেন, তারা শিক্ষিত, উচ্চমধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের মানুষ। তাদের অনেক কিছু থাকলেও পৌরজ্ঞানের অভাব রয়েছে। এই অভাবটা কেমন, সেটা বোঝাতে এখন আরেকটি চিত্রের কথা বলি। আমার বাসায় তিনটি ছোট সাইজের বারান্দা আছে। সেখানে সাধ্যমত গাছ লাগিয়েছি। প্রতিদিন সকালে প্রচণ্ড যানজট ও গাড়ির হর্ণের মধ্যেও এই সবুজ গাছগুলো আমাকে অসম্ভব আনন্দ দেয়। এখানে প্রতিদিন নানাধরণের পাখিও আসে।
এর পাশাপাশি প্রায় প্রতিদিনই দেখি ফ্ল্যাটবাড়ির এই গাছগাছালিগুলোতে টিস্যু, চিপসের প্যাকেট, কাপড়ের ব্যাগ, জালি ব্যাগ ঝুলছে। যেমন, সেদিন চোখ মেলে দেখি একটি সুন্দর ফুল ফুটেছে। আনন্দে কাছে গিয়ে দেখি ওইটি ফুল নয়, কফ ভর্তি টিস্যু। উপরতলার কোন ফ্ল্যাট থেকে কেউ ফেলেছে। ঠিক এভাবেই সিগারেটের টুকরা, কোক-ফানটার ক্যান, প্যাকেট সহ নানান কিছু ছুঁড়ে ফেলা হয়, এমনকি পানের পিকও।
এখানে প্রায় প্রতিটি ভবনের চারপাশে অসম্ভব ময়লা-আবর্জনা জমা হচ্ছে প্রতিদিন।
আমার বোন থাকেন ধানমন্ডি এলাকায় একটি ভবনের দোতলায়। সেদিন বারান্দায় কাপড় মেলতে গিয়ে দেখেন গ্রিলে মল-মাখা ডায়াপার আটকে আছে। প্রতিদিন বিভিন্ন ময়লা-আবর্জনা পড়ে উপর থেকে, তবে ডায়াপার এবারই প্রথম। অথচ মাসে একশো টাকার বিনিময়ে সিটি কর্পোরেশনের লোক আসে প্রতিদিন ময়লা নেয়ার জন্য। টাকা-পয়সা নয়, সমস্যাটা আমাদের খাছলতের।
কিছুদিন আগে মোহাম্মদিয়া হাউজিং লিমিটেডের রামচন্দ্রপুর খালটি দলেবলে পরিষ্কার করেছেন কার্টুনিস্ট মোরশেদ মিশু। বহু কষ্ট করে স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে এই খালটি পরিষ্কার করেছেন তারা। ঐ এলাকায় যারা গিয়েছেন এবং আবর্জনা ভরা এই খালটি দেখেছেন, তারা জানেন ময়লা-আবর্জনায় থকথক করতো খালটি। সাথে এলাকাময় ছড়ানো দুর্গন্ধ। হঠাৎ দেখে মনে হতো আবর্জনা জমানোর ভাগাড় এটি।
যারা খালটি পরিষ্কার করেছেন, তারা বলেছেন খালে নষ্ট ফ্রিজ, কম্বল, তোশক, কোলবালিশ, হেলমেটসহ এমন কোনো জিনিস নেই যা মানুষ ফেলেননি। মানুষ সোনাদানা, টাকাপয়সা, লাশ ছাড়া আর মনে হয় সব জিনিস ফেলেছেন ঐ খালে।
এখন বলেন, এই যে খালটি, আমাদের বাড়ির চারিধার যদি প্রতিদিন আমরাই নোংরা করি, তাহলে কিভাবে এই শহর পরিষ্কার থাকবে? আর নগরীর অন্যসব ঘনবসতিপূর্ণ এবং দরিদ্র মানুষের বসবাসের এলাকায় অবস্থা আরো অনেক ভয়াবহ। প্রতিটি এলাকাই যেন মশা-মাছির প্রজনন ক্ষেত্র। বৃষ্টিতে ঢাকাশহর যে ডুবে যায়, এরজন্যও কি আমরা অনেকটাই দায়ী নই? যেখানে যা খাচ্ছি, যা ব্যবহার করছি সবকিছু ছুঁড়ে মারছি রাস্তায় বা ড্রেনে।
নগরীর ম্যানহোলগুলোর মুখ প্রায় প্রতিদিন মাদকাসক্তরা চুরি করে নিয়ে যায়। জলাবদ্ধতার পর যখন ম্যানহোলগুলো পরিষ্কার করা হলো দেখা গেল হাজার হাজার প্লাস্টিকের বোতল, ক্যান, জালি ও প্লাস্টিকের ব্যাগ ও বক্স বের হয়ে এলো। এসব কারা ফেলেছে রাস্তায়? আমরাই ফেলেছি।
ধরলাম নগরে নানাধরণের মানুষের বাস, কেউ কম শিক্ষিত, কারো পৌরজ্ঞানের অভাব রয়েছে, কেউ হয়তো সচেনতার প্রশিক্ষণ পাননি। কিন্তু যিনি বা যারা হ্যারিয়ার গাড়ির জানালার কাঁচ নামিয়ে ব্যবহৃত টিস্যু রাস্তায় ছুঁড়ে মারেন, লেক্সাস গাড়ির জানালা দিয়ে রাস্তায় থুথু ফেলেন, তাকে আমরা কী শেখাবো? আমি নিজে দেখেছি ইউএস বাংলার অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে ওঠার প্রাক্কালে স্যুটেড-বুটেড একজন লোক ফ্লাইটের গাড়ি থেকে নামলেন এবং নাক ঝেড়ে মাটিতে ময়লা ফেললেন। দেখে মনে হলো ওনাকে চার্জ করি। পরে একরাশ বিরক্তি নিয়ে নিজেকে সামলে রাখলাম।
প্রায়ই চোখে পড়ে রাস্তায় সভা-সমাবেশ হচ্ছে, বাসে-ট্রাকে লোক এসেছেন হাজারে হাজারে। এরা যেসব প্যকেটে খাচ্ছেন, যে বোতলে পানি খাচ্ছেন সব রাস্তার উপর ছুঁড়ে ফেলছেন।
খুব সম্প্রতি আমি দেখেছি একটি রাজনৈতিক দলের প্রোগ্রামে আগত কর্মীরা মানিকমিয়া এভিনিউ, বিজয় স্মরণীর মতো প্রশস্ত রাজপথকে পুরোটাই ডাস্টবিনে পরিণত করেছিলেন।
উল্লেখ্য সংসদ ভবনের সামনে প্রায় প্রতিদিনই সকালে ও সন্ধ্যায় ময়লার ভাগাড় জমে থাকে। যেখানেই লোক সমাগম, যেখানেই ছোটখাট হোটেল ও খাবারের ফেরিওয়ালা, যেখানে সভা-সমাবেশ হয়, সেখানেই একই অবস্থা ঘটে। চারিদিকে ময়লা, যা খাচ্ছি বা ব্যবহার করছি সেটাই ছুঁড়ে মারছি রাস্তায়। আর অন্যদিকে আছে সিটি কর্পোরেশনগুলোর ইচ্ছার অভাব, অব্যবস্থাপনা, পরিকল্পনার অভাব, লোকবলের অভাব।
যারা মোহাম্মদপুরের খালটি পুনরুদ্ধার করেছেন, তারা জানিয়েছেন খালের পাড়ে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগিয়েও কাজ হয়নি। মানুষের সচেতনতা না থাকলে কোনকিছুই কাজ দেয় না। আসল কথা হচ্ছে এটাই। নিজেরা যতদিন পর্যন্ত সচেতন হবো না, ততদিন পাড়া-মহল্লা, সড়ক-জনপদ, অফিস-আদালত, বাগানবাড়ি, পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, খাল-বিল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সবই আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হবে।
খাল পরিষ্কারকারী উদ্যোক্তারা বলেছেন, কোনো কাজ করার জন্য শুধু ইচ্ছা থাকলে তা সম্ভব করা যায়। পাওয়া যায় অন্যদের আর্থিক সহযোগিতা। স্বেচ্ছাসেবকেরাও এগিয়ে আসেন। আর এ কারণেই মাত্র দুই দিনে ময়লার ভাগাড় এই খালটিও পরিষ্কার করে ফেলা সম্ভব হয়েছে। খাল পরিষ্কার ও খালের ওপর তিনটি সেতু রং করার কাজটি করেছেন বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ। মা-বাবার হাত ধরে বাচ্চারা এসে রং তুলি হাতে তুলে নিয়েছে। খালের ময়লা পরিষ্কার করার কাজে যে তরুণ-তরুণীদের কোনো ধারণাই ছিল না, তারাই মাত্র দুই দিনে কাজটি শেষ করেছেন। এর আগেও আমরা দেখেছি ছাত্রছাত্রীরা সেন্টমার্টিন, কক্সবাজার উপকূল পরিষ্কার করছেন। কিন্তু সব ভালো উদ্যোগ চাপা পড়ে যায়, নাগরিকের অসচেতনতার কারণে।
পত্রিকায় খবর দেখেছি অনেক নৌকা একসাথে নেমে পড়ায় হলুদ পদ্মের সাথে পুরো পদ্মবিলই হুমকির মুখে পড়েছে। সিজনের সময় ফুলশূন্য হয়ে পড়ে পদ্মবিল। সেন্টমার্টিনে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ঘুরছেন, ফিরছেন এবং থাকছেন। একটি প্রবাল দ্বীপে যারা বেড়াতে যাচ্ছেন তাদের অধিকাংশেরই যে কাণ্ডজ্ঞানের অভাব সেকথা আর বলার অবকাশ রাখেনা। নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও লোকজন ঝুড়ি ভরে প্রবাল তুলছেন, আর অন্যদিকে চিপস-কোকের প্যাকেট ফেলছেন।
করোনার ঠিক পরপর দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে পর্যটকদের ফেলে রাখা ৫৫৫ কেজি প্ল্যাস্টিক বর্জ্য পরিষ্কার করেছে ফেসবুকের ভ্রমণ বিষয়ক গ্রুপ ট্র্যাভেলার্স অব বাংলাদেশ (টিওবি) এর সদস্যরা। তারা বলেণ, "দ্বীপ থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে আমাদের সদস্যদের বেশ কষ্ট করতে হয়েছে। পর্যটকরা তো চোখ বুঁজে ময়লা ফেলে যান, সেগুলো কোথায় গিয়ে পড়ছে সেদিকে খেয়াল করেন না। দেখা গেল কাঁটাযুক্ত কেয়া গাছের মধ্যে বোতল পড়ে আছে, সেগুলো আনতে গিয়ে আমাদের অনেকেরই হাতে কাঁটা ঢুকে গিয়েছিল। যাই হোক, প্লাস্টিকগুলো সংগ্রহ করে আমরা আমাদের ভাড়া করা ট্রলারে করে সেগুলোকে টেকনাফের একটি দোকানে দিয়ে দিই। ৩৯টি বস্তায় সংগ্রহ করা ময়লার ওজন ছিল ৫৫৫ কেজি", তবে সেটা সেন্টমার্টিনে পড়ে থাকা প্লাস্টিকের পাঁচ শতাংশও হবে না।"
পর্যটকরা একই অবস্থা করে রেখেছেন শ্রীমঙ্গল, লাউয়াছড়া, রাতারগুল, বিছানাকান্দি, কুয়াকাটা, জাফলং, বিরিশিরি, গজনী, মাধবকুণ্ড, লালখাল, ময়নামতী, সাতছড়ি ফরেস্ট, সুন্দরবন, সাজেক, বান্দরবান, রাঙামাটির বিভিন্ন ট্যুরিস্ট স্পটগুলোর। পর্যটকদের ফেলে আসা এই বর্জ্যগুলো সরানোর দায়িত্ব কার? কেউ নেই। কাজেই এগুলো জমতেই থাকে।
যেহেতু বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ নিজের বাড়ির চারপাশ ও আঙিনা পরিষ্কার রাখতে পারেন না বা পরিষ্কার রাখতে চেষ্টা করেন না, এই তারাই বেড়াতে গেলে, পর্যটক হিসেবে দায়িত্বপালন করবেন, সেটা কিভাবে সম্ভব? তাই আমাদের দরকার সচেতনতাবোধ জাগ্রত করা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বিষয়ক প্রচার অভিযান চালানো। নিজের বাড়ি ও বাড়ির চারধার, রাস্তাঘাট, পর্যটন স্পট সব পরিষ্কার রাখার ব্যাপারে যে সবার দায়িত্ব রয়েছে, সে বিষয়টি যেন মানুষ উপলব্ধি করতে পারে, সেটাই আমাদের সবাইকে দেখতে হবে।
বাংলাদেশ একটি ঘন জনসংখ্যার দেশ। দেশের অনেক মানুষ নিরক্ষর এবং শিক্ষিতদেরও অনেকে অসচেতন। বিশেষ করে পরিচ্ছন্নতাবোধ, পরিবেশ-প্রতিবেশ নিয়ে তেমন কোন ভাবনাচিন্তাই কাজ করে না। মানুষকে বুঝাতে হবে, তারা যেন তাদের ব্যবহৃত প্লাস্টিকের বোতল, সিগারেট-চিপসের ও খাবারের প্যাকেট, ঘরের সাধারণ ময়লা, পুরোনো লেপ-তোষক যেখানে সেখানে ছুঁড়ে না মারেন। শুধু একটি প্যাকেটে বা জায়গায় রেখে দেন এবং পরে সেগুলো ময়লা ফেলার নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলে দেন। তাহলেই প্রথম ধাপটা পার হওয়া যাবে।
খাল পরিষ্কার আন্দোলনের প্রধান উদ্যোক্তা মোরশেদ বলেছেন আগের আমলে যেভাবে আন্দোলনে কাজ হতো, "এখন আর সেভাবে হবে না। আন্দোলনও করতে হবে ক্রিয়েটিভভাবে।"
তারা আগামী দুই বছরে ২০০ দেয়াল, নদী, খাল পরিষ্কারের উদ্যোগ নেবেন। খাল পরিষ্কারের অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে তিনি যা বলেছেন, তা ভয়াবহ। সিটি করপোরেশনের পিকআপগুলোর বর্জ্য ধারণক্ষমতা এক হাজার কেজি। খালের এক কোনা থেকেই ছয় পিকআপ বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। অর্থাৎ বর্জ্যের পরিমাণ ধারণা করাও কঠিন ছিল কারো পক্ষে। পরে ডুবুরিরা ব্রিজের নিচের অংশে যেসব পাইপ আছে, সেগুলো ফাঁকা করে ময়লা যাওয়ার রাস্তা করে দিলে বর্জ্য আলাদা করে না তুলে পানির স্রোতের সঙ্গে তা যাওয়ার রাস্তা করে দেওয়া হয়।
এই যে খালটি থেকে পাহাড় সমান ময়লা আবর্জনা তুলে ফেলা হলো, কিন্তু দু'দিন যেতে না যেতেই মানুষ আবার ময়লা ফেলা শুরু করেছেন। এলাকাবাসীর সামনে খালটি পরিষ্কার করা হয়েছে। এখন যদি আবার ময়লা না ফেলার কথা বলতে হয়, তা দুঃখজনক।
আমাদের গোড়া থেকে কাজ শুরু করতে হবে। এই গোড়ারা হলো শিশু-কিশোর ও যুবা। স্কুলে শিশু-কিশোরদের পরিচ্ছন্ন থাকার ও তাদের চারপাশ পরিচ্ছন্ন রাখার ট্রেনিং দিতে হবে। পরিচ্ছন্ন থাকার ও রাখার বোধোদয় কিভাবে জাগানো যায়, সে বিষয়ে ভাবতে হবে। তা নাহলে এই শহর, এই দেশ অচিরেই মশা-মাছি, রোগ-শোকের ভাগাড় হিসেবে পরিচিত হয়ে যাবে। রামচন্দ্রপুর খালটি পরিষ্কার করা ও তাতে পুনরায় ময়লা ফেলার কথা শুনে, মনে হলো সেই কথা যে "স্বাধীনতা অর্জন করার চেয়ে তা রক্ষা করা কঠিন।" আমরা বুঝলাম, কোন এলাকার ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করার চেয়ে, ভবিষ্যতে সেই এলাকাকে ময়লাবিহীন রাখতে পারাটাই বড় চ্যালেঞ্জ।
- লেখক- যোগাযোগকর্মী ও কলামিস্ট
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফল। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।