ফিলিস্তিনিরা দেখাচ্ছে তাদের মুছে ফেলা যাবে না
কয়েক দশক ধরে, যুক্তরাষ্ট্রের মদদপুষ্ট ইসরাইল ফিলিস্তিনকে রাজনৈতিকভাবে মানচিত্র থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছে। গত কয়েকদিন ধরে, ফিলিস্তিনিরা আবারও প্রমাণ করেছে যে, তাদের কাছ থেকে চুরি করা জমির দাবি এবং সার্বভৌমত্ব তারা সহজে ছাড়বে না।
সংকীর্ণ ইউরো-আমেরিকান অর্থে এখানে 'সার্বভৌমত্ব' শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে না; বরং 'একটি ভূমি শাসন করার কর্তৃত্ব' বোঝাতে ব্যবহার করা হয়েছে। জনগণ এবং তাদের পূর্ব পুরুষদের জমির বিষয়টি এটি এমন একটি সংযোগ যা অন্য সমস্ত রাজনৈতিক আরোপকে অর্থহীন করে দেয়।
আর ফিলিস্তিনের সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের এই সম্পর্কের বিষয়টিই দীর্ঘদিন ধরে মুছে ফেলতে চাইছে ইসরায়েল।
সম্প্রতি, ইসরায়েল এবং আরব রাষ্ট্রগুলির মধ্যে এবং বিশেষ করে ইসরায়েল ও সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রচেষ্টা এই মুছে ফেলাকে তীব্র করেছে। স্বাভাবিককরণের দিকে প্রতিটি পদক্ষেপের সাথে সাথে, শীর্ষস্থানীয় কূটনীতিক এবং রাজনীতিবিদ সহ বিশ্বের আরও বেশি সংখ্যক মানুষ এই ধারণা দাঁড় করাতে চেয়েছে যে, মধ্যপ্রাচ্য এমন একটি অঞ্চলে পরিণত হয়েছে যেখানে ফিলিস্তিনিরা কোনো মাইনে রাখে না। এই ভবিষ্যতের চিত্র তুলে ধরে, যেখানে স্বাধীনতা, মুক্তি এবং সার্বভৌমত্বের জন্য ফিলিস্তিনিদের আকাঙ্খার জায়গা নেই।
ফিলিস্তিনিরা কয়েক দশক ধরে, ইসরাইল প্রতিদিন যে সহিংসতা চালাচ্ছে তা বিশ্বব্যাপী আলোচনায় রাখার চেষ্টা করেছে। তারা সমস্ত হত্যা, নির্যাতন এবং অপব্যবহারের তথ্য সংরক্ষণ করে। তারা বিস্তারিতভাবে নথিভুক্ত করেছে যে, কীভাবে ইসরায়েলি রাষ্ট্রীয় সহিংসতা তাদেরকে স্বাধীনতা এবং মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করেছে এবং আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন করে নিয়মিতভাবে তাদের হয়রানি করেছে।
আর বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কীভাবে ইসরায়েলের নৃশংস নিপীড়নের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে? তারা এমন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, যার চেয়ে নীরবতাই ভালো ছিল।
তারা জোরেশোরে বারবার ইসরায়েলের প্রতি নিজেদের সমর্থন জানিয়েছে। ইসরায়েলের ঔপনিবেশিক দমন নীপিড়নে তারা সহায়তা করেছে এবং ফিলিস্তিনের তাদের অবশিষ্ট ভূমি থেকে সরাতে এবং ইতিহাস ও বৈশ্বিক রাজনীতি থেকে ফিলিস্তিনকে মুছে ফেলতে উৎসাহ দিয়েছে।
বিশ্ববাসীর স্বজাগ দৃষ্টি পেতে ফিলিস্তিনিরা কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়েছে, কখনো নিরস্ত্রভাবে আবার কখনো সশস্ত্র প্রতিবাদ জানিয়ে তারা নিজেদের কথা বলতে চেয়েছে।
যারা শুনেছে তাদের কাছে তারা বারবার নিজেদের অভিযোগ জানিয়েছে, কিন্তু ফিলিস্তিনের পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।
ইসরায়েল যখন ফিলিস্তিন এবং ফিলিস্তিনি জনগণকে আরব ও বৈশ্বিক সজ্ঞানতা থেকে মুছে ফেলার প্রচেষ্টা জোরদার করেছে, ফিলিস্তিনিরা নিজেদেরকে একটি অসহায় পরিস্থিতির মধ্যে খুঁজে পেয়েছে।
তাদের সামনে দুটি পথই খোলা, এই কারাগারের মধ্যে বন্দী থেকে, কারারক্ষী ইসরায়েলের নিয়ম মেনে চলে নিজেদের অভিযোগ তুলে ধরা এবং আশা করা যে, কিছু মানবতা সম্পন্ন মানুষ তাদের উপর চলা বর্বরতা বন্ধে হস্তক্ষেপ করবে। অথবা যে যুক্তিতে তাদের প্রতি এমন অমানবিক আচরণ করা হচ্ছে, সেটাকেই বাস্তবায়ন করে নৃশংসার জবাব দেওয়া।
প্রকৃতপক্ষে, এই জঘন্য বিশ্বব্যবস্থায় উচ্চ আদর্শ ঘোষণা করা হয় শুধুমাত্র যে কোনো কর্তৃত্ব অর্জন ও বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় নৃশংস সহিংসতাকে আড়াল করার জন্য। মূলত এভাবেই সহিংসতার মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের নীপিড়নকারী রাষ্ট্রগুলোর আচরণই বর্তমান পরিস্থিতির ন্যায্যতা দেয়।
অনেকে শোষিতদের এমন কাজকে 'সন্ত্রাস' বলে আখ্যা দেয়, যেন শোষকের পদ্ধতিগত, সুদূরপ্রসারী এবং দীর্ঘমেয়াদি সহিংসতার চেয়েও এটি বেশি নিকৃষ্ট। আবার দুই পক্ষের সক্ষমতা বিবেচনায় অনেকে এমন পদক্ষেপকে 'অযৌক্তিক' বলেও মন্তব্য করে।
শেষের যুক্তিটি অবশ্যই সঠিক। তবে এটাও সত্য যে শোষিতরা বিষয়টি ভুলে যায়নি।
গাজা থেকে ইসরায়েলের উপর সাম্প্রতিক হামলার উদ্দেশ্য তাৎক্ষণিকভাবে ফিলিস্তিনকে মুক্ত করা নয়। বরং এমন হামলাগুলো হয় সংগ্রামের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন এবং গতিশীলতা আনার জন্য। হামলা করা হয়েছে বর্তমান আন্তর্জাতিক ঐকমত্যকে নাড়িয়ে দেওয়ার জন্য, যারা মনে করে ফিলিস্তিনকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা উচিত। এ ঘটনা জানিয়ে দেয় যে, ফিলিস্তিনিরা তাদের ভূমিতে স্বাধীন এবং সার্বভৌম জনগণ হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকার কখনোই ছাড়বে না।
এই হামলা ফিলিস্তিনিদের জন্য পরিস্থিতি বদলে দেবে না, বরং আরো খারাপ অবস্থায় নিয়ে যাবে। তবে খারাপ অবস্থায় যাবে নিজেদের কাজের জন্য নয়, বরং ফিলিস্তিনকে মুছে ফেলতে ইসরায়েলের সংকল্পের জন্য। অবরুদ্ধ থাকা মানুষেরা স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছে সহিংসতার মাধ্যমেই তারা মনোযোগ পাবে। অন্যথায় তারা এমনিতেও মৃত্যুর মুখে পড়বে, নিশ্চিহ্ন করার হুমকিতে পড়বে। এবং তখন সেটা হবে অন্যদের থেকে আড়ালে থেকে, বৈশ্বিক দৃষ্টিসীমার বাইরে।
নিরাপদভাবেই ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় যে, ইসরায়েলি সরকার, সেইসাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অনান্য রাজনীতিবিদ এবং পররাষ্ট্র নীতি বিশেষজ্ঞরা এখন এই সমস্ত ঘটনাকে 'নিরাপত্তা' এর নাম দিয়ে চালাবে। তারা গোয়েন্দা ব্যর্থতা এবং অন্যান্য প্রযুক্তিগত নিরাপত্তা ব্যর্থতার দিকে মনোনিবেশ করবে। তারা গাজা উপত্যকায় তাদের ক্রমাগত নৃশংস বোমা হামলার দিকে মনোনিবেশ করবে। তারা ফিলিস্তিনিদের তাদের অব্যাহত অবরোধ, আরও বেশি ফিলিস্তিনি ভূমি আনুষ্ঠানিকভাবে সংযুক্ত করা এবং ফিলিস্তিনকে মুছে ফেলার চেষ্টা করবে।
কিন্তু এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল: ফিলিস্তিনিদের মুছে ফেলা যাবে না এবং এই অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এবং বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের অনেক মানুষ ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য সংগ্রামকে সমর্থন করে। ফিলিস্তিনের জনগণ এই মুছে ফেলার চেষ্টাকে প্রত্যাখ্যান করতে থাকবে।
সারা বিশ্বের মানুষ তাদের সংগ্রামকে ফিলিস্তিনি সংগ্রামে প্রতিফলিত হতে দেখবে, এটি নিশ্চিত করবে যে, ফিলিস্তিনকে সারা বিশ্বের মন থেকে নিশ্চিহ্ন করা যাবে না।