হুটহাট কেনাকাটায় হতে পারে আর্থিক সংকট
"আমি টাকা আয় করি খরচ করার জন্য। যদি খরচই করতে না পারলাম তাহলে টাকা আয় করে লাভ কি?" এটা আমার বক্তব্য নয়, এক ভদ্রলোকের বক্তব্য। ভদ্রলোক প্রতি মাসে যা আয় করেন তার চেয়ে ব্যয় করেন বেশি। আমি তাকে একদিন বলছিলাম, 'তুমি যেটা আয় করো, তার চাইতে তোমার ব্যয় অনেক বেশি'। সে বলল, 'আয় করি সেটা তো ব্যয় করার জন্যেই'। আমি বললাম, 'ব্যয় করবে ঠিক আছে কিন্তু আয়ের চাইতে যখন ব্যয় বেশি হবে, তখন কি হবে?' উত্তরে বলল, 'একসময় আয় করে সেগুলো ঠিক করে নিব'। কথাটা মন্দ নয়, যদি একসময় আয় করে ঠিক করে নেওয়া যায়, তাহলে খারাপ কি?
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে আপনাকে আপনার সাধ্যের মধ্যে চলতে হবে। যখনই আপনি সাধ্যের বাইরে যাবেন, আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি করবেন তখনই আপনি ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়বেন। হতে পারে সেটি ব্যক্তিগত ঋণ বা প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ। একসময় প্রতিষ্ঠান ঋণ দিবে না, ব্যক্তিও আপনাকে ঋণ দিবে না। তখন আপনি মারাত্মক আর্থিক সংকটে পড়বেন। আর সেই সংকটের মধ্যে যদি আপনার আয় কোনভাবে বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে তখন আপনার অবস্থা মারাত্মক খারাপ হয়ে যাবে। সেইজন্য টাকা আয়ের চেয়ে ব্যয়ের সময় বেশী সতর্ক হবেন। হুটহাট অপরিকল্পিতভাবে টাকা খরচ আপনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
আজ আমি যে বিষয় নিয়ে আপনাদেরকে সচেতন করব সেটা হচ্ছে হুটহাট কেনাকাটা আপনার আর্থিক সংকটের কারণ হতে পারে।
কোন কিছু অর্ডার করা মানেই খরচ করা। এখন হাজার হাজার অনলাইন প্ল্যাটফর্ম আছে। বিভিন্ন পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসে আছে তারা। আপনি ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার যেদিকে যান দেখবেন, বিভিন্ন রকম পণ্যের সমাহার এবং খুব প্রয়োজনীয় পণ্য, খুব আকর্ষণীয়, কখনো কম প্রয়োজনীয় বিলাস দ্রব্য। যা যা আগে মার্কেটে বিক্রি হত এখন সবকিছু আপনি অনলাইনে পাবেন। যখন মোবাইলে অনলাইনে ভিজিট করতে থাকবেন, দেখবেন প্রত্যেকটা ছবি আপনার খুব মনোমুগ্ধকর লাগছে। প্রত্যেকটা খাবার আপনার সামনে জীবন্ত হয়ে উঠছে, আপনার দেখেই খেতে ইচ্ছে করবে। ফলে আপনি কি করছেন?
প্রয়োজন কতটুকু সেটা বিবেচনা না করেই 'এক্ষুণি আমার এটা চাই' বলে সাথে সাথে অর্ডার করে দিচ্ছেন। ছয় ঘণ্টা পরে হোক, চব্বিশ ঘণ্টা পরে হোক, বাহাত্তর ঘণ্টা পরে হোক, আপনি জিনিসটা পাচ্ছেন, আপনি টাকা পরিশোধ করে দিচ্ছেন। আপনাকে আগে যেমন কষ্ট করে দোকানে গিয়ে খুব বুঝেশুনে দেখেশুনে পণ্য কিনতে হত, এখন এসব ঝামেলা আর নেই, আপনি অর্ডার করলেই হল। লাইভে আরও আকর্ষণীয়ভাবে আপনার সামনে জিনিসটা উপস্থাপন করা হচ্ছে। ফলে আপনার তখন মনে হচ্ছে, এক্ষুণি আপনার এই শাড়িটা লাগবে, এক্ষুণি আপনার এই জামাটা লাগবে, এক্ষুণি আপনার এই টিশার্ট লাগবে, এই মেকআপ আইটেম লাগবে, জুতাটা এক্ষুণি লাগবে, না হলে আরেকজন নিয়ে যাবে। ফলে আপনি অর্ডার করে দিচ্ছেন। আপনার পকেটে যে টাকা আছে সেটা খুব দ্রুত বের হয়ে যাচ্ছে।
আপনার কি পকেটে প্রত্যেকদিন টাকা ঢুকছে? যদি এমনটি হত, আপনি অর্ডার করলেই আপনার পকেটে টাকা চলে আসছে তাহলে ব্যাপারটি ভাল হত। আসলে আপনি যতই অর্ডার করছেন ততই আপনার টাকা চলে যাচ্ছে পকেট থেকে। আমার এক বন্ধুর সম্পর্কে আপনাদের একটু বলি, একশো জোড়ার বেশি তার জুতা। তিনি একশোর বেশি জোড়া জুতা কিনেছেন এবং দুই-তিন বছর হয়ে গেছে কোন কোন জুতা তিনি খুলেই দেখেননি। তার টাকাগুলো পকেট থেকে বের হয়ে গেছে ঠিকই কিন্তু সে চিন্তা করেনি কোনটা তার কেনা দরকার আর কোনটা তার কেনার দরকার নেই।
আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে, তুমি এতো জোড়া জুতা কেন কিনেছো? উনি উত্তরে বললেন, 'দেখো আমি শপিং করতে পছন্দ করি। যখন আমি খুবই স্ট্রেসে থাকি তখন আমি শপিং করতে যাই। শপিং করতে যাওয়ার পরে আমার যেহেতু জুতা পছন্দ, আমি বেশিরভাগ জুতাই কিনি'। আমি বললাম, 'এই যে অযথা খরচ কর, তোমার খারাপ লাগে না'? উনি উত্তরে বললেন, 'টাকা খরচ করতে আমার ভালো লাগে'।
আমার কথা হচ্ছে তার হয়তো টাকা আছে সে খরচ করছে, সবার অবস্থা তো তেমন না। তার হয়তো বাবার পক্ষ থেকে টাকার সাপোর্ট আছে, নিজে ইনকাম করছে, স্বামীর পক্ষ থেকে টাকার সাপোর্ট আছে। আপনার হয়ত সেটা নাও থাকতে পারে। আর থাকলেই কেন আপনি অযাচিতভাবে খরচ করবেন? এখানে আমার একটা পরামর্শ আছে, কোন কিছু কেনার আগে আপনি আগে ভেবে দেখুন যে আপনার সাধ্যের মধ্যে কিনছেন কিনা। তারও আগে একটা বিষয় ভাবার দরকার আছে, আপনি নিজেকে প্রশ্ন করুন, জিনিসটা আপনার কেনা দরকার কিনা? এবার আপনি দ্বিতীয় প্রশ্ন করুন নিজেকে, এই জিনিসটা ছাড়া আপনি চলতে পারবেন কিনা? আপনার বিকল্প কোন পথ আছে কিনা। ধরুন, আপনার একটা ব্যাগ খুব পছন্দ হয়েছে, তখন আপনাকে চিন্তা করতে হবে, এই ব্যাগটা না কিনলে কি আপনি চলতে পারবেন? যখন দেখবেন যে, আপনার তো অনেকগুলো ব্যাগ আছে, একটা ব্যাগ হয়তো একটু কালি করলে আপনি সেটা চালাতে পারেন বা একটা বেল্ট ছিঁড়ে গেছে, ওইটা একটু রিপেয়ার করলে আপনি চালাতে পারেন, তাহলে বিকল্প পথ আপনার আছে। তখন আপনি ব্যাগটা কেনা থেকে বিরত থাকুন।
আপনি এমন একটা জিনিস পছন্দ করেছেন যেটা আসলে আপনার লাগবেই, তারপর আরেকটা ছোট্ট প্রশ্ন করুন, এটা কি আপনার জীবনকে উন্নত করবে? সেখানে আপনি উত্তরে পেলেন, এটি আপনার জীবনকে উন্নত করবে, এটা আপনার জীবনে ভ্যালু এ্যাড করবে। তাহলে জিনিস্টা আপনার দরকার, এটার কোনো অল্টারনেটিভ আপনার নেই এবং এটি আপনার জীবনে ভ্যালু এ্যাড করছে সুতরাং আপনি এটা কিনুন। তবে আপনি দরদাম না করে যেটাই সামনে আসছে, যেটাই ভালো লাগছে সেটা কিনবেন না। আপনি দেখুন, যাচাই করুন, দেখুন ঐ জিনিসটা আপনি একটু কম দামে কিনতে পারেন কিনা।
আপনি হয়তো বলবেন আপনার পকেটে টাকা আছে, এতটা সময় কোথায় পাবেন। তবে একটু সময় দিয়ে, একটা ভালো জিনিস যদি আপনি কিনতে পারেন একটু কম টাকায়, তাহলে যে টাকাটুকু আপনি সেভ করলেন সেই টাকাটুকু আপনি পরবর্তীতে খরচ করতে পারবেন। তাই আপনি যখনই কোন টাকা খরচ করবেন, এই প্রশ্নগুলো মাথায় রাখুন এবং বিনা প্রয়োজনে বা কম প্রয়োজনে যেকোনো জিনিস কিনে স্তূপ আকার করবেন না। আপনি এখন নিডস তথা প্রয়োজনের প্রতি বেশি গুরুত্ব দিন; ওয়ান্টস বা চাহিদার প্রতি ফোকাস কম করেন। কারণ হচ্ছে, আপনার যদি টাকা থাকে সেই টাকা আপনি পরে সুন্দরভাবে ভেবেচিন্তে খরচ করতে পারবেন।
আপনি খরচের প্রতি সতর্ক হন, সঞ্চয়ে যত্নবান হন। সঞ্চয়ের পরিমাণ বেশি হলে আপনি বিনিয়োগ করেন। ওয়ারেন বাফেটের একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে, আপনি প্রথমে যে টাকাটা আয় করলেন, তার থেকে আপনি আগে সঞ্চয়টা করুন। সঞ্চয় করে বাকি যে টাকাটা থাকে সেটা থেকে আপনি খরচ করুন। আমরা করি তার উল্টাটা।
অনেকেই আমার কাছে প্রশ্ন করেছেন যে, এখন এমন অবস্থা সঞ্চয়ের কোনো সুযোগই নেই। এটা সত্যি সঞ্চয়ের সুযোগ এখন কমে গেছে। কারণ, দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়ে গিয়েছে, আপনার ইনকাম বাড়েনি, এখন আপনি কি করবেন? দুটো কাজ আপনি একটু করুন, আপনি দেখেন যে, আপনার ইনকামের আর কি কি এভিনিউ আছে? আপনি চেষ্টা করলে আপনার গুণ ও দক্ষতা অনুসারে আপনি অন্য কোন আয়ের খোঁজ পাবেন। যদি খুঁজে পান তাহলে আপনার আয় একটু বাড়লো, সেই টাকাটা আপনি আর খরচ করবেন না। খরচকে একটু টেনে ধরা যায় কিনা সেটিকে নিশ্চিত করুন। আপনি যদি ১৫০০ স্কয়ার ফিটের কোন অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন তাহলে আপনি এখন এক হাজার স্কয়ার ফিটের অ্যাপার্টমেন্টে আসেন। খুব বেশি বদলাবে না আপনার জীবনযাত্রা। আপনি আপনার মতো করে চিন্তা করবেন। চিন্তা করলে দেখবেন যে অল্টারনেটিভ আছে। আপনার খরচের দিকটা দেখতে হবে এবং আপনার জীবনকে সেভাবে নির্বাহ করতে হবে। এই সময়টাতে একটা পয়সা অপচয় করার সুযোগ নেই। ধরুন, আপনার প্রত্যেকদিন নর্থ এন্ডে বা অন্য কোনো কফি শপে খেতে ইচ্ছে করে, একেকটা কফির দাম, আড়াইশো টাকা বা তিনশো টাকা। আপনি পাঁচশো টাকা বা সাড়ে পাঁচশো টাকা দিয়ে এক বোতল কফি কিনতে পারেন যেটা দিয়ে সারা মাস আপনার পুরো পরিবার চলতে পারে। এরকম বিকল্প চিন্তা করেন।
আপনার বেসিক নিডস যেগুলো একেবারে দরকার সেগুলো আপনি খুব বেশি কমাতে পারবেন না। বাচ্চাদের লেখাপড়ার খরচ হয়তো আপনি বেশি কমাতে পারবেন না, তারপরেও দেখবেন কমানোর সুযোগ আছে কি-না। আপনার বাচ্চার যে টিউটর আছে তাকে আপনি বাদ দিয়ে, একটু কষ্ট করে না হয় আপনি নিজে পড়ান। যে কোনোভাবেই হোক আপনি একটু এডজাস্ট করুন। তবে একটা দিকে খুব খেয়াল রাখবেন, যে ইনকামটা চলছে সেই ইনকামটা যেন কোনভাবে বন্ধ না হয়ে যায়। যদি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে সেটা আপনার জন্য বিপদ।
সুতরাং, অর্ডার করার ব্যাপারে সচেতন থাকুন। নিডসের প্রতি বেশি মনোযোগী হন, ওয়ান্টসের প্রতি কম মনোযোগী হন এবং সঞ্চয়ের যে ধারাটা আছে সেটা অব্যাহত থাকুক। হুটহাট কেনাকাটা ও যেকোনো ধরণের খরচের সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে খুব সতর্ক থাকুন।
- লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক, ফাইন্যান্স ও বিজনেস স্ট্রাটেজিস্ট; সিইও, ফিনপাওয়ার লিডারশীপ ইন্টারন্যাশনাল
[বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়]