পক্ষপাতদুষ্ট পশ্চিমারা যখন ইসরায়েলের গণহত্যাকে গণহত্যা হিসেবে দেখে না!
আমাদের কিশোরকালে প্রথম ফিলিস্তিন-ইসরায়েল, আর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর নাম জানতে পারি। আমাদের যাদের বয়স এখন ষাটের ঊর্ধ্বে– তারা প্রায় সবাই ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের কথা মনে করতে পারি। তখন বাইতুল মোকাররম মসজিদ থেকে যুদ্ধবিরোধী মিছিল বেরোত। পাড়ামহল্লায় মিছিল হতো ফিলিস্তিনিদের পক্ষে।
তখনকার সংবাদ মাধ্যম আজকের মতন এতটা শক্তিশালী না হওয়ায়, আমাদের কাছে তেমন কোন তথ্য ছিল না। দৈনিক পত্রিকার হেডলাইন পড়ে কিংবা সরকারি টেলিভিশন রেডিওর মাধ্যমে যে তথ্য প্রকাশ করা হতো, তাই ছিল সম্বল সেকালের। এই আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের আরও ইতিহাস আছে। ১৯৭৩ সালেও আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ হয়েছে। ইসরায়েলের সাথে মিশরের বিশাল সীমান্ত থাকাতে যুদ্ধের কেন্দ্রীকতায় সবসময় মিশরও রয়েছে।
ফিলিস্তিন ভূখণ্ডটির ইতিহাস হাজার বছরের। ইতিহাসের নানান পরিক্রমায় গত একশ বছরের ইতিহাসের দিকে যদি তাকাই, তাহলে আমরা দেখি– ধর্ম দ্বারা বিভাজিত এই ভূখণ্ডটির পরিণতি।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে এই সংকটের জন্ম হয়- ১৯১৭ সনের নভেম্বরে বেলফোর্ ডিক্লারেশনের মাধ্যমে। এর মাধ্যমে ইহুদিদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড বেলফোরকে চিঠি দেন ইহুদিবাদী আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী লর্ড রথচাইল্ড। ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য ইহুদিবাদী নেতারা বহু যুগ ধরেই এই আন্দোলন করছিলেন।
ইহুদি রাষ্ট্র গঠনকালে অধিকাংশ আরব দেশ রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় পরিচালিত হচ্ছিল। সবকটি দেশেই ছিল বেলফোর্ ডিক্লারেশন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ সময়ের কথা। ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ ছিল তখন তুরস্কের ওসমানীয় রাজবংশের হাতে। ইউরোপের বেশ কিছু অংশ দখল করেছিল এই অটোম্যান বা ওসমানীয় রাজারা বহু শতাব্দী ধরে। ফলে ইউরোপজুড়ে অটোম্যানদের সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ প্রবল হয়ে উঠেছিল। অটোম্যান সাম্রাজ্যের অধীন দেশগুলোয় মানুষের ধর্মীয় মতপ্রকাশের অধীকারের উপরও হস্তক্ষেপ করা হয়েছে। ফলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপেরর লক্ষ্য ছিল অটোম্যান সাম্রাজ্যকে পরাজিত করা। এ পরাজয়ের ভেতর দিয়েই ফিলিস্তিন ভূখণ্ডসহ আরব দেশগুলোর বিরাট অংশে ব্রিটিশ ও ফরাসি উপনিবেশ সৃষ্টি হয়। সেই উপনিবেশবাদই আজকের সংকটের জন্ম দিয়ে যায়।
পৃথিবীর সকল গণমাধ্যমে গত ১০-১৫ দিন ধরে হামাস ও ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি হামলার ঘটনা দেখছি । হামাস কর্তৃক ইসরায়েল আক্রমণ হওয়ার পর মুহুর্ত থেকেই ইসরাইল তার ব্যাপক শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে গাঁজা উপত্যকার নিরীহ জনগোষ্ঠীর ওপর।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরপরই ইঙ্গ-মার্কিন সম্পর্কের গভীরতা গড়ে ওঠে। সেই সম্পর্কের সূত্র ধরেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তারা মিত্রশক্তি গড়ে তোলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পর ১৯৪৮ সালে তারা ফিলিস্তিনের বুকে ইসরায়েল নামক রাষ্ট্রটির জন্ম দেয়। যেখানে পৃথিবীর নানান দেশে বসবাসরত ইহুদীরা একত্রিত হয়ে প্রবেশ করতে থাকে। বিভাজিত আরব দেশগুলো এই সময় চেষ্টা করে ইসরাইলিদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে, কিন্তু যুক্তরাস্ত্র-যুক্তরাজ্য-ফান্সসহ প্রায় সকল শক্তিধর পশ্চিমা রাষ্ট্রের সমর্থনে ইসরায়েল তার জন্মসূচিত করে।
পৃথিবীর এই শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো তাদের ব্যাখ্যার গণতন্ত্র, তাদের ব্যাখ্যার মানবাধিকার চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে পৃথিবীর সকল দেশের উপর । এসব বিষয়কে সামনে রেখেই ইউক্রেন যুদ্ধে তারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে অংশ নিয়েছে। অস্ত্র সরবরাহ করেছে। একই অবস্থা সৃষ্টি করেছে ইসরায়েলের পক্ষে ও ফিলিস্তিনিদের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে। এই মহাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে কখনো তেমনভাবে একত্রিত হতে পারেনি আরব দেশসমূহ। কেবলমাত্র সেই ১৯৭৩ সনের যুদ্ধের সময়ের তেল অবরোধ ছাড়া। তাও অল্প কিছুকাল পরেই সেই সমঝোতা ও আরবদের ঐক্য ভেঙে দিতে সক্ষম হয়েছিল ব্রিটিশ-মার্কিন চক্র।
অষ্টাদশ শতাব্দী থেকেই পৃথিবীতে 'জায়নিস্ট মুভমেন্ট' (ইহুদিবাদি আন্দোলন) ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই আঙ্গিকেই রবীন্দ্রনাথ যখন আমেরিকা ভ্রমণ করছিলেন, তখন ১৯২৪ সালে জুইস স্ট্যান্ডার্ড নামক পত্রিকাটি তার কাছে জানতে চেয়েছিল এ ভূখণ্ডের ভবিষ্যৎ নিয়ে। জায়নবাদী আন্দোলনের সমর্থনকারী পত্রিকাকে রবীন্দ্রনাথ তখনই বলেছিলেন, এই অতি-জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ভবিষ্যতের পৃথিবীকে গভীর সংকটের মধ্যে ফেলে দেবে। তার সেই সাক্ষাৎকারটি ওই পত্রিকাটি প্রকাশ করেছিল ১৯২৪ সালে।
পশ্চিমা বিশ্বের এই উগ্র-জাতীয়তাবাদী চেতনা আজকের সারা পৃথিবীর মূল সংকট। যা কখনো কখনো ক্ষুদ্র জাতিগুলোকেও উগ্র জাতীয়তাবাদী চিন্তায় ভারাক্রান্ত করে। যেমনটি হয়েছে ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরে। তাদের নিজেদের ঐক্য না থাকার ফলে, পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকার মধ্যেকার জনগোষ্ঠীও এ সংকটে। আর এ সংকটের মূল হচ্ছে, মুসলিম ধর্মীয় গোষ্ঠীর বিভাজন। এই বিভক্তি কাটিয়ে যতদিন না আরব জনগোষ্ঠী একত্রিত হতে পারছে ততক্ষণ পর্যন্ত ইসরায়েল, আরবদের স্বাভাবিক বাঁচার অধিকার স্বীকার করবে না।
নারী-পুরুষ-শিশু-হাসপাতাল সমস্ত কিছুর উপর যে নির্বিচার আক্রমণ, গণহত্যা চালাচ্ছে ইসরায়েল পশ্চিমা বিশ্ব তাতে নিশ্চুপ।
পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত বৈশ্বিক গণমাধ্যমগুলো বলার চেষ্টা করছে সকল দায়ভার ফিলিস্তিনিদের কিংবা হামাসের। ইসরায়েলের গণহত্যাকে তারা গণহত্যা হিসেবে দেখছে না। এমনই পরিস্থিতিতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নানান ধরনের কূটনৈতিক অবস্থান দেখছি। প্রতিবেশী ভারত ঘটনার পর দিনই সরাসরি ইসরাইলের পক্ষ অবলম্বন করে, কিন্তু দিন দশের পরেই তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে ফিলিস্তিনি অধিকার নিয়ে কথা বলছে। মধ্যপ্রাচ্যের শক্তির কাছে মাঝে মাঝেই তারা আত্মসমর্পণ করে। আরব জাতীয়তাবাদীত যদি কিছুটা গভীর হতো, তাহলে হয়তো পশ্চিমারাও খানিকটা নতি-স্বীকার করতে বাধ্য হত। শেষ কথা হলো- যতদিন পর্যন্ত আরবরা নিজেদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা না করতে পারবে, ততদিন পর্যন্ত ইসরায়েলের এই গণহত্যা অব্যাহত থাকবে।
ইউরোপের দেশগুলো হামাসকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে চিহ্নিত করেছে, কিন্তু পশ্চিম তীরে অব্যাহত হত্যাকাণ্ডের কোন নিন্দা কিংবা সমালোচনা দেখা যায় না তাদের গণমাধ্যমে।