ভোট দিতে যাবার পূর্বশর্ত হিসেবে একজন নাগরিকের চাওয়া: সিইসির কাছে একটি খোলা চিঠি
অনেকেই, অন্তর্ভুক্তি-মূলক না হবার কারণে নির্বাচনের বিরোধিতা করেন অথবা নির্বাচনে ভোট দিতে ইচ্ছুক নন। তারা অন্তর্ভুক্তিকে সংজ্ঞায়িত করেন, শুধুমাত্র রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণের প্রেক্ষিতে। নিবন্ধিত অসংখ্য 'রাজনৈতিক দল' রয়েছে- সম্ভবত সেই সংজ্ঞায় তাদের সকলের অংশগ্রহণ মুখ্য নয়। বরং, 'অন্তর্ভুক্তি'র দাবির মধ্যে নিহিত রয়েছে কিছু নির্দিষ্ট দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। যদি দলের ভূমিকায় মধ্যসত্ত্বভোগীর রূপ না থাকতো, দলমত নির্বিশেষে এবং সকল প্রতিদ্বন্দ্বীদের অংশগ্রহণে ভোটাধিকার প্রয়োগ কার্যকর করা যেত, সম্ভবত সেটাই সবচাইতে আদর্শ ব্যবস্থা হতে পারতো। কিন্তু বিশৃঙ্খলার আশংকায় মানবসমাজকে দলবদ্ধ হতে দেখা যায়, যার প্রতিফলন আমরা রাজনীতির অঙ্গনেও দেখতে পাই। একই কারণে, ফি বা চাঁদা-আদায়কারীর ভূমিকা থেকে দলগুলোকে নিবৃত করা দুরূহ, এবং রাজনীতি ও নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে সেসবের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখা অধিকতর দুরূহ কাজ। এসবের মাঝে চলমান প্রক্রিয়ায় প্রার্থীদের দেওয়া তথ্য জনসমক্ষে উন্মুক্ত করা, নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় উদ্যোগ।
একপেশেভাবে সংজ্ঞায়িত 'অন্তর্ভুক্তিমূলক' নির্বাচন, বা বিমূর্ত গণতন্ত্রের প্রতি অন্ধ-ভালবাসা, বা বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলির সীমাবদ্ধতা ঘিরে সংশয়– এদের কোনটিই ভোট দিতে দ্বিধান্বিত হবার কারণ নয়। বরং, প্রার্থীদের 'বৈধতা' নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রমের প্রতি সংশয় থাকায়, ভোট দিতে দ্বিধা জেগেছে। একটি বাজারে যেমন ভোক্তাদের সুবিধার্থে সরবরাহ ও পণ্যের গুণগত মান নিশ্চিত করতে সরকারি তৎপরতা দেখা যায়, ভোটার হিসেবে আমরা আশা করি যে, নির্বাচন কমিশন সাংসদ হতে আগ্রহী ব্যক্তিদের বিশদভাবে যাচাই- বাছাই করে যোগ্য প্রার্থীদের 'আইনি' বৈধতার নিশ্চয়তা দিবেন। সংবাদ মাধ্যমে জেনে আশান্বিত হয়েছিলাম যে, গুটিকতক নির্বাচনী এলাকায় ভিন দেশের নাগরিকত্ব (দ্বৈত নাগরিকত্ব) থাকার কারণে প্রার্থিতা খারিজ করা হয়েছে। অথচ ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য ঘাঁটলে দেখা যায় যে, অনেক এলাকায় এই নিয়মটি কার্যকর করা হয়নি এবং পর্যাপ্ত যাচাইয়ের জন্য অন্যান্য তথ্যে অসম্পূর্ণতা পাওয়া যায়। তাই ধারণা করা যায় যে, নির্বাচন কমিশনের ব্যবস্থাপনায় সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রস্তুতিতে ঘাটতি রয়ে গেছে।
যে দুটো নির্দিষ্ট কারণে বর্তমান অগ্রগতির প্রেক্ষিতে আমি ভোট দিতে দ্বিধান্বিত, তার বিবরণ নিচে দিলাম:
(১) প্রতিজন প্রার্থী থেকে পাওয়া তথ্যসমূহ তিনটি প্রধান ভাগে ওয়েবসাইটে (http://103.183.38.66/) পাওয়া যায়। এর মধ্যে হলফনামা (affidavit) সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ, যা শেষ তিনটি সারির প্রথমটির তথ্যে দেয়া আছে। সেখানে শিক্ষা সংক্রান্ত তথ্য, ফৌজদারি মামলায় পূর্বে জড়িত থাকা (বা না থাকার) স্বীকারোক্তি, এবং নির্বাচনের খরচ কীভাবে মেটানো হবে, সে সম্পর্কে তথ্য রয়েছে। প্রার্থীর যোগ্যতা নির্ধারণ এবং ভোটারদের সচেতন সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য এজাতীয় তথ্য সহায়ক হতে পারে। এমনকি (ব্যাংক) ঋণ খেলাপিকে অযোগ্য চিহ্নিত করার বিধি (রুল), যদিও কাঙ্ক্ষিত, সংসদীয় নির্বাচন পরিচালনার জন্য সাংবিধানিকভাবে তা (আমার জানামতে) বাধ্যতামূলক নয়। এসব গৌণ বিষয়াদি হলফনামায় অন্তর্ভুক্ত থাকা সত্ত্বেও, সংসদ-সদস্য হবার মূল পূর্বশর্ত হিসেবে একমাত্র বাংলাদেশের নাগরিক হবার যে বিধান সংবিধানে রয়েছে, তা নিশ্চিত করার জন্য হলফনামায় প্রয়োজনীয় তথ্য ও বিবৃতি চাওয়া হয়নি! অর্থাৎ, একজন প্রার্থিতা-প্রয়াসী ব্যক্তি যে অন্য কোনও দেশের নাগরিক নন, সেই মর্মে একটি অঙ্গীকারনামা এবং যার ব্যত্যয় ঘটলে নির্বাচন-পরবর্তী পদ খারিজ হবার সতর্কবাণী, হলফনামায় উল্লেখ করা আবশ্যিক ছিল। অপর্যাপ্ত যাচাই-বাছাই সম্পর্কে জানার পর, দেশের সংসদে একজন 'বিদেশী' নির্বাচনের প্রক্রিয়াকে সহজ করে দিয়ে– দেশের সংবিধান লঙ্ঘন এর অপরাধে শরিক হতে আমি দ্বিধান্বিত।
(২) দাখিলের অন্য দুটি তথ্যের মধ্যে, আয়কর রিটার্ন/সনদপত্র (সারিগুচ্ছের তৃতীয়) গুরুত্বপূর্ণ, যা সঠিকভাবে পেলে নির্বাচন কমিশন অন্যান্য তথ্যের সাথে সঙ্গতি যাচাই করে প্রার্থিতার বৈধতা নির্ণয় করতে পারে। তথ্য নিরীক্ষা করে জানা যায় যে, প্রার্থীদের অনেকে আয়কর দাখিলের সকল কাগজপত্রের প্রত্যয়িত অনুলিপি জমা দিয়েছেন। এমনকি তারা সেই দাখিলের প্রাপ্তি রশিদ জমা দিয়েছেন, যেখানে মোট আয়, দেয়া কর এবং নিট-সম্পদ মূল্যের উল্লেখ রয়েছে। ব্যতিক্রম দেখা যায় কিছুকিছু প্রার্থীর ক্ষেত্রে, যাদের দাখিলকৃত আয়কর সংক্রান্ত তথ্যাদি অসম্পূর্ণতায় ভরপুর। তাদের আয়কর সনদপত্রে ২০২২-২৩ সনের আয়, দেয়া কর এবং সম্পদের মূল্যের উল্লেখ নেই। এমনকি, কোন কোন ক্ষেত্রে, জমাকৃত কম-প্রয়োজনীয় (বা অপ্রয়োজনীয়) এক পৃষ্ঠাকে সম্পূর্ণ আয়কর দাখিলের (ট্যাক্স রিটার্ন) স্থলে গ্রহণ করা হয়েছে বলে মনে হয়েছে।
লক্ষণীয় যে, জমাকৃত প্রার্থী-ভিত্তিক উপাত্ত সম্ভবত পিডিএফ বা চিত্র (ইমেজ) ফাইলে রয়েছে। এসব উপাত্ত ডিজিটাইজ (সংখ্যা-রূপী) আকারে সংরক্ষণ না হলে– কেন্দ্রীয় পর্যায়ে স্বল্প সময়ে তথ্য যাচাই করা সম্ভব নয়। এছাড়াও, কর ও রাজস্ব বিভাগ বা বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যভাণ্ডারের সাথে মিলিয়ে নেওয়ার সুযোগ হয় না। অর্থাৎ, আজকের তথাকথিত ডিজিটাল যুগে সনদের (কাগজের) উপর ভিত্তি করে প্রার্থীদের 'বৈধতা' নির্ণয় করতে হচ্ছে। সেগুলোও অনুলিপি, যা মূল সনদের সাথে মিলিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব পরে স্থানীয় (নির্বাচনী এলাকা) পর্যায়ের নির্বাচন কমিশন কর্তৃপক্ষের ওপর! স্বভাবতই সেসব কর্মকর্তাদের পারদর্শীতা প্রার্থীদের যোগ্যতা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
যে সমাজে ক্ষমতার অপব্যবহার নিত্যকার ঘটনা, নির্বিচারে মিথ্যার আশ্রয় নেওয়াকে সহ্য করা হয়– যেখানে ওয়েব প্ল্যাটফর্মে সংরক্ষিত উপাত্তকে 'ডিজিটাল' বলে প্রচার করা হয় এবং সেসব উপাত্তের বিশ্লেষণের উদ্যোগ যেখানে সীমিত; সেদেশে আশ্চর্য হবার কিছু নেই যে, নির্বাচন কমিশন হাতেগোনা কয়েকজনকে মাত্র দ্বৈত নাগরিক চিহ্নিত করে– তাদের প্রার্থিতা বাতিল করতে পেরেছে। তবে লক্ষণীয় যে, একই নির্বাচনী এলাকায় কিছু শক্তিশালী বিরোধী পক্ষ থাকার ফলেই সেটা সম্ভব হয়েছে। অথবা, ভিন্নভাবে বললে, 'দ্বৈত নাগরিকত্ব'-এর আইনি হাতিয়ারটি বিশেষ বিশেষ নির্বাচনী এলাকায় ব্যবহৃত হয়েছে!
জাতীয় সংসদের যেকোন নির্বাচনে একজন ভোটার হিসেবে আশা করেছিলাম যে, নির্বাচন কমিশন প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এক গুচ্ছ (সাংবিধানিকভাবে) বৈধ এবং (বিধি-ভিত্তিক) যোগ্য প্রার্থীদের তালিকা (শিডিউল) ভোটারদের সামনে উপস্থাপন করবে। দুর্ভাগ্যবশত, বৈধতা যাচাইয়ের জন্য প্রার্থীর বিদেশে নাগরিকত্ব আছে কি নেই, সেসম্পর্কে সরাসরি প্রশ্ন রেখে তথ্য সংগ্রহের কোনও প্রচেষ্টা দৃশ্যমান নয়। এমনকি, প্রত্যেক প্রার্থীর কাছ থেকে হলফনামায় এবং দলীয় প্রার্থীদের মনোনয়ন দেয়া রাজনৈতিক দলের (পাটির) ব্যবস্থাপকদের (নেতা- নেত্রীদের) কাছ থেকে এসংক্রান্ত কোনও অঙ্গীকারনামা নেওয়া হয়নি বলে জেনেছি। অথচ প্রাক-নির্বাচনী ত্রুটি দূর করবার জন্য এজাতীয় হলফনামা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
উপরে উল্লেখিত কারণে ভোট দেয়ার ক্ষেত্রে দ্বিধা রয়েই যাবে, যদি না নির্বাচন কমিশন অতি-সত্বর নিম্নোক্ত কাজগুলো সম্পাদন করে;
- নৈর্ব্যক্তিকভাবে সকল প্রার্থীদের বিদেশী নাগরিকত্বের বিষয়টি যাচাই করতে হবে এবং এজন্য কারও অভিযোগের জন্য অপেক্ষা করার যুক্তির আশ্রয় না নেয়া।
- প্রার্থীদের কাছ থেকে হলফনামা (যা আইনগতভাবে গ্রহণযোগ্য) নিন যে তারা বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোনো দেশের নাগরিক নন; এবং
- নিশ্চিত করুন যে, সকল যোগ্য প্রার্থীরা তাদের ট্যাক্স রিটার্নের নোটারাইজড কপি এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) জমা দেওয়ার স্বীকৃতির রসিদ জমা দেন। (এনবিআর-এর কাছে এই জমাগুলির সঠিকতা যাচাই করা প্রয়োজন।)
- রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে অঙ্গীকারনামা নিন যে তাদের মনোনীত প্রার্থীদের কেউই অন্য কোনও দেশের নাগরিক নন।
দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে আস্থা রাখতে পারে এমন সংসদ নির্বাচন করা থেকে ভোটারদের বঞ্চিত করা অনুচিত এবং সেকারণে, সময়ের অজুহাত গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা যেন বিবেকের দংশনে না ভুগে, সাংবিধানিকভাবে বৈধ প্রার্থীদের বাছাই করার উদ্দেশ্যে ভোট দিতে যেতে পারি, তার জন্য উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে এবং বৈধ প্রার্থীদের তালিকা (শিডিউল) তৈরি করে জনসমক্ষে আনা জরুরি।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।