স্কুলছাত্রীদের যৌন হয়রানি: অভিভাবকরা কি দায় এড়াতে পারেন?
যৌন নির্যাতনের অভিযোগ ওঠা ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক মোহাম্মদ মুরাদ হোসেন সরকারকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এখন তার বিচার হবে। কিন্তু কষ্ট পেলাম এই ভেবে যে ঢাকা শহরের এত বিখ্যাত ও স্মার্ট একটি স্কুলে পড়েও কেন এখানকার ছাত্রীরা নিজেকে রক্ষা করার বেসিক টুলস বা পন্থা সম্পর্কে জানে না? কেন পরিবার থেকে তাদের সচেতন করা হয়নি নিজের সুরক্ষার ব্যাপারে? কেন 'ভালো বা নিরাপদ স্পর্শ' এবং 'খারাপ বা অনিরাপদ স্পর্শ' সম্পর্কে তাদের সঠিক জ্ঞান নেই?
একজন 'ভুক্তভোগী'র অভিভাবক বলেছেন, 'এই শিক্ষক আগে থেকেই শিক্ষার্থীদের যৌন নিপীড়ন করে আসছিলেন। কিন্তু শিক্ষার্থীরা ভয়ে মুখ খুলত না। এমন কাজগুলো তিনি কোচিং ক্লাসের শেষে করতেন। উনি সবসময় বলতেন, ।"আমি তোমাদের বাবার মতো।।" বাবার মতো বলে বলে ম্যানিপুলেট করতো।' এরকম শিক্ষকের বিরুদ্ধে এত দেরিতে কেন অভিযোগ এলো? কেন ছাত্রীরা ভয় পেয়ে মুখ বন্ধ রেখেছে, এমনকি তারা বাবা-মা, ভাইবোনের সামনেও মুখ খোলেনি? আর বাবার মতো 'বলে বলে' একজন শিক্ষক একজন ছাত্রীর কতটা কাছে আসতে পারেন? এই বাউন্ডারি সম্পর্কে কেন সন্তানকে শিক্ষা দেয়া হয়নি?
বারবার অভিভাবকরা একটি কথা বলছেন যে ছাত্রীরা তো তাকে 'বাবার মতোই দেখে'। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে একজন শিক্ষক মর্যাদার দিক দিয়ে বাবার মতো হতে পারেন, কিন্তু আচরণের দিক থেকে কেন বাবার মতো হবেন? বাবা তার কন্যাসন্তানকে জড়িয়ে ধরতে পারেন, আদর করতে পারেন, পাশাপাশি শুয়ে থাকতে পারেন, বেড়াতে যেতে পারেন, প্রয়োজনে অনেক ব্যক্তিগত কথা শেয়ার করতে পারেন, কিন্তু একজন শিক্ষক কি তা করতে পারেন? পারেন না। অথচ মুরাদ হোসেন সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে যে তিনি স্কুলের ক্লাসে এবং তার কাছে কোচিংয়ে পড়তে আসা মেয়েদের নাক ধরে টানতেন, মাথায় ঘাড়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতেন, নিয়মিত জড়িয়ে ধরতেন, বুকে হাত দিতেন এবং এসব আদর তিনি 'বাবার মতো' করেন বলে মেয়েদেরকে বলেন, আর মেয়েরা সেটা বিশ্বাসও করত!
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে 'ভালো সম্পর্ক' তৈরি করে কোচিং ক্লাসেই তাদের যৌন হয়রানি করে আসছিলেন তিনি। বছরের পর বছর ধরে তার এ ধরনের কর্মকাণ্ড চললেও ভয়ে কেউ মুখ খোলার সাহস পায়নি। যৌন নিপীড়ন নিয়ে ছাত্রীদের কোনো পরিষ্কার ধারণা নেই বলেই দিনের পর দিন তাদেরকে যৌন হয়রানি করে গেছেন এই ব্যক্তি।
কেন ছাত্রীদের যৌন হয়রানির মতো মারাত্মক একটি অপরাধ সম্পর্কে ধারণা নেই? এর দায়ভার নিতে হবে অভিভাবক ও পরিবারকে এবং স্কুলকেও। শিশুর প্রতি যৌন নির্যাতন একটি নীরব মহামারি—যা পরিবারে, সমাজে সবসময় ঘটছে, কিন্তু সেটা গোপনে ঘটছে। অভিভাবকরা অনেকক্ষেত্রে তা বুঝতে পারেন না, জানতে পারেন না অথবা জানলেও পারিবারিক ও সামাজিক কারণে চুপ করে থাকেন। শুধু নিজেরা চুপ থাকেন তা নয়, সন্তানকেও চুপ থাকতে বাধ্য করেন।
শিশুর নিরাপত্তাকে উপেক্ষা ও অবহেলা করে যৌন নির্যাতনের ঘটনাগুলো এড়িয়ে যাওয়া হয় বলে, দিনে দিনে পরিবারে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, পথে, গণপরিবহণে এর হার বাড়ছে। একেবারে শিশু থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী, কেউই যৌন নির্যাতন থেকে মুক্তি পাচ্ছেন না। খুব চরম পর্যায়ে না গেলে এসব খবর আমরা পাই না। দেশে শিশুর প্রতি যৌন নির্যাতন একটি ভয়াবহ সমস্যা হলেও সামাজিক ট্যাবুর কারণে একে নিয়ে কথাবার্তা হয় সামান্য। যৌন হয়রানিকে ঘিরে নীরবতার সংস্কৃতি রয়েছে আমাদের পরিবার ও সমাজে। যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক কৌশলগুলো শিশুকে প্রাথমিক স্তর থেকেই শেখানো উচিত। অথচ দেখা যায় যৌন নির্যাতন প্রতিরোধের কৌশলগুলি সন্তানকে শেখানোর ব্যাপারে মা-বাবার সম্পৃক্ত থাকার উদাহরণ খুব কম। বেশিরভাগ মেয়ে ও ছেলেশিশুই পরিবারে ও পরিবারের বাইরে যৌন নির্যাতনের বিভিন্ন রূপ সম্পর্কে জানে না এবং যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে কী করতে হবে সে সম্পর্কেও অজ্ঞ।
বাবা-মা ও অভিভাবকরা সবসময় তাদের সন্তানকে অপরিচিতদের সাথে নম্র, লাজুক এবং ভদ্র হতে শেখান। বিশেষ করে শিক্ষক ও বড়দের সাথে ভালো ব্যবহার, নমনীয় আচরণ করতে ও 'হ্যাঁ' বলতে শেখান। কিন্তু এখন অভিভাবকদের অন্যভাবে ভাবতে হবে। আপনার সন্তান যদি মনে করে বয়স্ক কারো দ্বারা সে অপদস্থ হচ্ছে বা কেউ তার সাথে অশোভন আচরণ করছে, তাহলে অবশ্যই তাকে সেটা প্রতিহত করা শেখাতে হবে। যেকোনো ধরনের অস্বস্তিকর পরিস্থিতির শিকার হলে, শিশু যেন সাহায্যের জন্য চিৎকার করে এটাও শেখাতে হবে। মা-বাবাকে জানতে হবে তাদের সন্তান তার পরিচিত জায়গা, যেমন গৃহ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পাড়া-প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনদের দ্বারা বেশি যৌন নির্যাতনের মুখোমুখি হয়ে থাকে।
ছাত্রীরা অভিযোগ করেছে যে মুরাদ সরকার নাকি যৌন হয়রানি করার পর ছাত্রীদের বলতেন যে এসব করে দোয়া-দরুদ পড়ে ফেলতে হয় এবং নামাজ পড়ে মাফ চাইলে আল্লাহ মাফ করে দেন। এজন্য মুরাদ স্যার স্পেশাল দোয়াও শিখিয়ে দেবার কথা বলেছেন। বেশ কামেল লোক এই শিক্ষক। তবে আবারও বিস্মিত হওয়ার পালা, মুরাদ সরকারের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ যদি সত্যি হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে তার ছাত্রীরা যথেষ্ট কাণ্ডজ্ঞানহীন অথবা বোকা। ধর্মের দোহাই দিয়ে এই লোক যে অনাচার করছেন, স্কুলে পড়ার পরেও এটা তারা বুঝবে না কেন?
সন্তান স্কুলে পড়ার সময়ও যদি অভিভাবকরা মনে করেন যে তাদের সন্তানের ভাল ও খারাপ স্পর্শ এবং এই জাতীয় অন্যান্য বিষয়গুলোর সম্পর্কে বোঝার মতো বয়স হয়নি, তা কিন্তু ঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে শিশুদের সাথে অরুচিকর কিছু করা হলে, তারা ঠিক সেটা বুঝতে পারে। কিন্তু উপযুক্ত মানুষ ও পরিবেশ না পেলে কিছু বলতে চায় না। বাবা-মা বা অভিভাবকের মূল দায়িত্ব হলো সন্তানের জন্য এমন পরিবেশ তৈরি করা, যেন শিশু কোনোরকম ভয় না পেয়ে তাদের জীবনের ভাল ও মন্দ দুই অভিজ্ঞতাই শেয়ার করতে পারে। কারণ পরিসংখ্যান বলে যে ৭ থেকে ১৩ বছরের শিশুরা সবচেয়ে বেশি যৌন হয়রানির শিকার হয়। শিশু বিশেষজ্ঞরা বলেন পাঁচ বছর বয়সের কাছাকাছি পৌঁছুলে শিশুর সাথে শিশুর শারীরিক নিরাপত্তা প্রসঙ্গে কথা বলা শুরু করা যায়। তারা পরামর্শ দেন বিভিন্ন পরিভাষা ব্যবহার না করে বা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কথা না বলে শিশু-কিশোরীরা বুঝতে পারে এমন ভাষাতেই তাদের সঙ্গে কথা বলা উচিত।
অধিকাংশ মেয়েই নাকি ভয়ে বাবা মাকে ঘটনা বলেনি। এর ফলে দিনের পর দিন মুরাদ সরকারের হাতে নিপীড়িত হতে হয়েছে। এই লোক তাদের হুমকি দিয়েছেন, ব্ল্যাকমেইল ও ব্রেইনওয়াশ করেছেন। ছাত্রীরা হয়তো শিক্ষকের এই জঘন্য আচরণকে অবমাননাকর হিসাবে উপলব্ধি করেছে, কিন্তু ভয় ও বিভ্রান্তির কারণে ঘটনাটি প্রকাশ করতে পারেনি। কারণ ভুক্তভোগী ছাত্রী হয়তো বুঝতে পারেনি কাকে বলবে, কীভাবে বলবে। যাকে বলবে সে কি তার কথা বিশ্বাস করবে? নাকি তাকে ভুল বুঝবে? লজ্জা বা কলঙ্কের ভয়ে এবং সামাজিক স্টিগমার কারণে যৌন নিপীড়নের কথা তারা প্রকাশ করে না।
সন্তান যৌন হয়রানির শিকার হলে তা গোপন না করে মুখ খুলতে হবে পিতা-মাতাকে। সন্তানকে বকা দেয়া, ভয় দেখানো বা লুকিয়ে থাকতে বলা নয়, তাকে বলুন তার প্রতি যে অন্যায় ও খারাপ আচরণ করা হয়েছে এজন্য তার কোনো দোষ, ভয় বা লজ্জা নেই। লজ্জা বা দোষ সেই ব্যক্তির, যে এই খারাপ আচরণ করেছে।
আমাদের দেশে অধিকাংশ অভিভাবক মনে করেন বয়ঃসন্ধিকালে শিশু-কিশোরদের 'যৌনতা বিষয়ে সচেতনতা শিক্ষা' দিলে তারা নষ্ট হয়ে যাবে অথবা যৌন বিষয়ের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠবে। অথচ এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। এই শিক্ষার মাধ্যমে বয়ঃসন্ধিকালের ছেলেমেয়েরা তাদের প্রতি হওয়া যেকোনো ধরনের যৌন হয়রানি ঠেকাতে পারবে, মা-বাবাকে এ ধরনের সমস্যার কথা জানাতে পারবে, পরিবারের ভেতরে এবং বাইরে নির্যাতনকারীকে 'না' বলতে পারবে। এছাড়া জানতে পারবে কোন ধরনের অজানা বিষয়ে বাবা-মা, অভিভাবক, শিক্ষক ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র থেকে তাদের উপদেশ নেওয়া দরকার। সেইসাথে বুঝবে যে কীভাবে সামাজিক ট্যাবু ভাঙতে হবে এবং এ-সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।
স্কুলগুলো হতে পারে এ-সংক্রান্ত জ্ঞান দেওয়ার জন্য মূল স্থান। স্কুলের মাধ্যমেই এলাকা ও শ্রেণীভেদে ছাত্রছাত্রীদের কাছে যৌন সচেতনতা, নিরাপদ ও অনিরাপদ স্পর্শ এবং এ সম্পর্কিত পারস্পরিক বিজ্ঞানভিত্তিক, বাস্তবসম্মত তথ্য পৌঁছানো সহজ হবে। এখনো পরিবারে, সমাজে ও স্কুল পর্যায়ে শিশু-কিশোরদের সাথে প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলাটা ট্যাবুই রয়ে গেছে। অথচ দেখা যাচ্ছে কিশোর-কিশোরীরা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। এই প্রেক্ষিতকে সামনে রেখে বাংলাদেশের জাতীয় পাঠ্যক্রমে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মূল লক্ষ্য ছাত্রছাত্রীরা যেন বয়ঃসন্ধিকালের মানসিক ও শারীরিক পরিবর্তন ও অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারে এবং সেই অনুযায়ী সচেতন হতে পারে।
তবে অভিযোগ আছে যে ট্যাবুজনিত কারণে অনেক শিক্ষক/শিক্ষিকা প্রায়ই বিষয়টি পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। একইরকম বিব্রতকর অবস্থা এবং সামাজিক স্টিগমার কারণে পরিবারের মধ্যেও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কথা জানতে দেওয়া ও বলতে দেওয়া হয় না, বরং এড়িয়ে যাওয়া হয়। ফলে যে তথ্য জানাটা শিশু-কিশোরদের জন্য জরুরি, সেটা তারা জানতে পারছে না বা ভুলভাবে জানছে। যৌন নিপীড়নকারী ব্যক্তি এমন মানুষের বেশে বা কাজ নিয়ে শিশুর কাছে আসে, যাকে শিশু ও শিশুর পরিবার বিশ্বাস করে ও আস্থা রাখে, যেমন মুরাদ সরকারের মতো শিক্ষকরা। প্রায়ই এরা বাবা বা মায়ের মতো স্নেহদানকারীর ভূমিকায় সামনে আসে। যৌন হয়রানির এই ঘটনা ঘটে থাকে শিশুর নিজ বাড়িতে, আত্মীয় বা পারিবারিক বন্ধুদের বাড়িতে, স্কুলে, মাদ্রাসায়, দোকানে, স্কুলে যাওয়ার পথে ও অন্যান্য পরিচিত পরিবেশে।
তাই অভিভাবককে সন্তানের কথা, অভিযোগ ও কারো প্রতি তার আপত্তি থাকলে সেটা শুনতে হবে এবং বিশ্বাস করতে হবে। আজকের দ্রুত পরিবর্তিত সমাজে যেখানে শিশুদের নিরাপত্তা এবং সুস্থতা একটি প্রধান উদ্বেগের বিষয়, সেখানে অভিভাবকের উচিত এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন করা এবং শিশুকে তা জানিয়ে দিয়ে সম্ভাব্য ক্ষতি থেকে সন্তানকে রক্ষা করা। শিশুকে সব ধরনের ধারণা দিয়ে তাকে প্রস্তুত করতে হবে, যেন সে ভয় না পায়, তথ্য গোপন না করে এবং দুর্বল হয়ে না পড়ে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সন্তানকে 'নিরাপদ বা ভালো স্পর্শ ও অনিরাপদ বা খারাপ স্পর্শ' সম্পর্কে ধারণা দেওয়া। শিশুর প্রতি যৌন নির্যাতনের ঘটনা যতটাই ভীতিকর এবং মনখারাপ করা হোক না কেন, তা-ও সেটা এড়িয়ে যাওয়ার কোন উপায় নাই।
অভিযোগ আছে যে মুরাদ সরকার প্রথমে ক্লাসে ডার্টি জোকস বলতেন। সেটা শুনে যে মেয়েরা হঠাৎ হেসে ফেলে তাদের টার্গেট করতেন এবং এরপর কোচিংয়ের ফাঁকে যৌন নিপীড়ন করতেন। মানুষের যৌনতাবিষয়ক অপরাধপ্রবণতা নিয়ে যারা কাজ করেন, তারা বলেন এমনও হতে পারে যৌন হয়রানি করার আগে অপরাধী তার টার্গেটকে নানাভাবে স্পর্শ করে, গল্প করে বা ছবি দেখিয়ে অভ্যস্ত করে তুলতে পারে, যেন সে কিছু বুঝতেই না পারে। এভাবেই তারা ক্রমশ গোপনে অপরাধ চালিয়ে যেতে থাকে, ঠিক মুরাদ সরকারের মতো।
আমরা অনেকেই এখনো বিশ্বাস করতে পারি না যে শিশুদের জন্য সবচেয়ে অনিরাপদ জায়গা হলো তার পরিচিত মানুষ। অভিযুক্ত মুরাদ সরকারের মতো যারা যৌন নিগ্রহকারী, সে নিশ্চিত থাকে যে ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের হয়রানির কথা কাউকে বলে না বা বলতে চায় না। বললেও শিশুর কথা সাধারণত বিশ্বাস করা হয় না। যারা শিশুর শ্লীলতাহানি করে বা করার চেষ্টা করে তারা তাদের ভালো আচরণ দিয়ে শিশুর পরিবারে কাছের মানুষ ও নির্ভরশীল মানুষ হিসেবে জায়গা করে নেয়। অল্প ক্ষেত্রে অভিভাবক বুঝতে পারলেও পারিবারিক সম্মান ও শিশুর চরিত্রের কথা ভেবে চুপ করে থাকেন।
এবার আসি আজিমপুর ভিকারুননিসা স্কুলের কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে। কোচিং সেন্টারে ছাত্রীদের যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠার পর শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা সোচ্চার হলে আজিমপুরের দিবা শাখার ওই শিক্ষককে প্রথমে প্রত্যাহার করে কেন অধ্যক্ষের কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হলো? এরকম ভয়াবহ একটি অভিযোগের পর এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় বদলি কী রকমের শাস্তি হলো? এরপর তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। অভিযোগ আছে, স্কুল কর্তৃপক্ষ প্রথম থেকেই মুরাদ সরকারের কুকর্ম আড়াল করার চেষ্টা করছে। শিক্ষকদের তদন্ত কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছে যে ছাত্রীদের আনা অভিযোগগুলো এক বছর আগের হওয়ায় এবং তিনি (মুরাদ স্যার) পবিত্র হজ করার পর এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি বিধায় তাকে বরখাস্ত করা হলো না।
মনোবিজ্ঞানী বা শিশু বিশেষজ্ঞ না হলেও পরিবারে মায়েরাই পারেন খুব সুন্দর করে সন্তানের সঙ্গে এ ধরনের অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বলতে ও শিক্ষা দিতে। হঠাৎ বা একদিন-দুদিন নয়, সবসময়ই এ প্রসঙ্গে কথা বলে সচেতন করা উচিত। সন্তানকে তাদের শরীরের মালিকানা শেখাতে হবে। অর্থাৎ তাকে বোঝাতে হবে, তার শরীরের মালিক সে এবং তাকেই তার শরীরের নির্দিষ্ট অংশগুলিকে 'ব্যক্তিগত এলাকা' হিসেবে সংরক্ষণ করতে হবে।
যদি কারো আচরণ ও স্পর্শ পছন্দ না হয় এবং অস্বস্তিকর মনে হয় তাহলে, যেন সে তার মা-বাবাকে সেই ঘটনার কথা জানায়। এখানে লোকলজ্জার প্রশ্নটি অবান্তর। শিশু-কিশোররা ঠিক মনে না করলে তাদের স্পর্শ করার অধিকার কারও নেই। মা-বাবা ও অভিভাবক হিসেবে নিজের সন্তানকে শেখাতে হবে বড়দের সম্মান করা মানে এই নয় যে তাদের নোংরা আচরণ মেনে নেওয়া, যেমনটা মেনে নিয়েছে মুরাদ সরকারের ছাত্রীরা।
- শাহানা হুদা রঞ্জনা: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফল। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়