ভারতে নতুন নাগরিকত্ব আইন বাস্তবায়নে ৩ রাজ্যের আপত্তি আদৌ টিকবে?
ভারতের লোকসভা নির্বাচনের পূর্বে কেন্দ্রীয় সরকার সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় গেজেট জারি করেছে। গেজেট প্রকাশের সাথে সাথেই তিন রাজ্য থেকে তীব্র আপত্তি তুলে ধরা হয়েছে; দক্ষিণে কেরালা ও তামিলনাড়ু এবং বাংলা। এই তিন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা বলেছেন, তাদের রাজ্যে তারা সংশোধিত সিএএ, অর্থাৎ নতুন নাগরিকত্ব আইন কার্যকর করবেন না।
ভারতের সংবিধান বিশেষজ্ঞদের একাংশ বলছেন, এই ক্ষমতা রাজ্যের নেই। তার কারণ ভারতের সংবিধান কোনো রাজ্যকে সে অধিকার দেয়নি। আম্বেদকাররা যখন ভারতের সংবিধান রচনা করেছিলেন তখনকার দিনেও প্রশ্ন উঠেছিল, রাজ্যগুলো কেন্দ্রের সকল আইন বা সংশোধনী মানতে বাধ্য কিনা। এ প্রশ্নের উদয় হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যবস্থার সংবিধানকে মাথায় রেখে। কারণ মার্কিন সংবিধানের কোনো সংশোধনী কার্যকর করার জন্য রাজ্যগুলোর অনুমোদন প্রয়োজন হয়।
মার্কিন সংবিধান যখন রচিত হয়েছিল তখন মার্কিন রাজ্য সংখ্যা ছিল মাত্র ১৩ টি এবং এর সবগুলোই তখন উপনিবেশ ছিল ইউরোপের বিভিন্ন দেশের। এই রাজ্যগুলো সিদ্ধান্ত নিয়েছিল মূলত একটি যৌথ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য, যেন বাইরের শত্রু তাদের ঘায়েল করতে না পারে। সেই আঙ্গিকেই আজকের মার্কিন সামরিক শক্তি। সময়ের বিবর্তনে আজ ৫০টি রাজ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যবস্থায়। মার্কিন সংবিধান প্রণেতারা এমন একটি সমঝোতার রাস্তা খুঁজে বের করেছিলেন, যেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের একক কোনো কর্তৃত্ব থাকবে না, অর্থাৎ কংগ্রেস কিংবা সিনেটে যদি সংবিধানের কোনো সংশোধনী পাস করতে হয়, তবে তার জন্য রাজ্যগুলোর অনুমোদন নিতে হবে। সে এক জটিল প্রক্রিয়া তারা খুঁজে বের করেছিল সংবিধান সংশোধনের জন্য।
পৃথিবীর ইতিহাসের প্রথম লিখিত সংবিধান, যা আকারে খুবই ক্ষুদ্র। কিন্তু রাজ্যগুলোর স্বাধীনতা এতটা নিশ্চিত করা হয়েছে যে চাইলেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট কিংবা সিনেট বা কংগ্রেস কেউই কোনো আইন রাজ্যগুলোর ওপর চাপিয়ে দিতে পারেন না। কংগ্রেস সিনেটের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্টতায় সংবিধানের কোনো সংশোধনী পাস হলেও রাজ্যের ক্ষেত্রে কার্যকরী করতে হলে সেই রাজ্যটির অনুমোদন নিতে হবে। কিন্তু ভারতের সংবিধান রচনাকারীরা এদিকে মনোযোগী ছিলেন না। ভারতের জন্মের পরের থেকেই কেন্দ্রীয় সরকার অনেকটাই কর্তৃত্ববাদী। রাজ্যগুলোর প্রতি তাদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। চাইলেই তারা লোকসভা ও রাজ্যসভার মাধ্যমে নতুন আইন সৃষ্টি করে সেই আইন রাজ্যগুলোর ওপর চাপিয়ে দিতে পারে। যদিও ভারতীয় রাজ্য সভায় প্রতিটি রাজ্যেরই প্রতিনিধিত্ব আছে।
সংবিধান সংশোধন বা কোনো আইন প্রণয়নের জন্য রাজ্যের কাছে অনুমোদনের নেই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের। ভারতীয় সংবিধানের এটি একটি মারাত্মক দুর্বল দিক। এটি সংবিধানের গণতান্ত্রিক চরিত্র ভীষণভাবে ক্ষুণ্ণ করে। ভারতের সিএএ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার তিনটি রাজ্যে যেভাবে বিরোধীতার সম্মুখীন হল তা অতীতে কখনো দেখা যায়নি। যদিও স্থানীয় রাজনীতিতে এরা বর্তমান সরকার বিজেপির সঙ্গে সাংঘর্ষিক অবস্থানে আছে, বিশেষ করে পশ্চিমবাংলায়। কেরালা এবং তামিলনাড়ুর অবস্থা খানিকটা ভিন্ন। সেখানে এক ধরনের সম্পর্ক কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে তা স্পষ্ট তবে সেটি ঠিক পশ্চিমবাংলার মতো নয়।
সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের যে ধারা নিয়ে আপত্তি উত্থাপিত হচ্ছে, তা হলো মুসলিম সংখ্যালঘু ছাড়া অন্য যেকোনো ধর্মাবলম্বীরা ২০১৪ সলের পূর্বে যারা ভারতে প্রবেশ করেছেন, তারা সকলেই ভারতের নাগরিক হিসেবে গণ্য হবেন। যে রাজ্য তিনটিতে এই আপত্তি উত্থাপিত হয়েছে, এই রাজ্য তিনটিতেই এই বড় সংখ্যক মুসলিম বসবাস করে। তাদের এই আপত্তির কারণ মুসলিম জনগোষ্ঠীকে সান্ত্বনা দেওয়া। তবে তারা কোনভাবেই এই আদেশ কিংবা এই আইন বাস্তবায়ন থেকে বিরত রাখতে পারবে না। কেন্দ্রের কাছে আরো বহু রকমের ক্ষমতা রয়েছে। কেন্দ্র এক বিশাল জনগোষ্ঠীকে সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় খাদ্য ও অন্যান্য সহায়তা প্রদান করে থাকে। যা ভারতীয় নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীকে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা বাধ্যতামূলক করে তোলে।
এছাড়াও কেন্দ্রের কাছে অর্থনৈতিক নানান সহায়তা রয়েছে রাজ্যগুলোর জন্য। কেন্দ্র প্রতিবছর বিরাট অংকের টাকা প্রদান করে পশ্চিমবাংলা রাজ্য সরকারকে। এই টাকা প্রাপ্তি নিয়েও কেন্দ্র রাজ্যের মধ্যে টানাপীড়ন রয়েছে। এধরনের নানান ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের আছে। ফলে কেন্দ্রীয় সরকার চাইলেই রাজ্যগুলোর সরকারকে নানান ভাবে সংকটে ফেলতে পারে। যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে মোটেই সম্ভব নয়।
ভারতের এই একত্রিত সংবিধানের মতন আরও সংবিধানের খোঁজ পাওয়া যায়। যেমন- চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সিদ্ধান্ত সকল জনগোষ্ঠীর জন্য বাধ্যতামূলক। মত প্রকাশের স্বাধীনতা কিংবা আপত্তি করার কোন সুযোগ নাই। অবশ্য কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরে যখন সিদ্ধান্ত হয়, তখন সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় দলীয় সদস্যরা তাদের মত দিতে পারেন। কিন্তু দলের সম্পাদক কর্তৃক উত্থাপিত কোনো প্রস্তাবের বিপক্ষে যারা অবস্থান নেয় তারা চীনের রাজনীতিতে হারিয়ে যায়।
ভারতের এই তিনটি রাজ্যের সিএএ নিয়ে না সূচক বক্তব্য শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা দেখার বিষয়। তবে আপতত মনে হচ্ছে, ভারতের সাংবিধানিক বেঞ্চ এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে। তবে ভারতীয় সংবিধানের কার্যকারিতার দিক থেকে অবশ্যই কেন্দ্রীয় সরকার সিএএ বাস্তবায়নের অধিকার রাখে এবং এখানে রাজ্যের বাধা দেওয়ার কোনো এখতিয়ার নেই।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফল। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।