ডায়াবেটিস রোগীর রোজা রাখার ঝুঁকি ও করণীয়
পৃথিবীতে প্রায় ২৩৫ কোটি মুসলমান আছে, যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৮%। বর্তমানে পৃথিবীতে ডায়বেটিস রোগীর সংখ্যা প্রায় ৪৪৫ মিলিয়ন। ২০৪০ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ৬৪২ মিলিয়নে। এর মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক ও সুস্থ মানুষরা রোজা রাখেন সাধারণত। পৃথিবীর মোট প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমানের ৩৬% ডায়াবেটিসে ভুগছেন। এক গবেষণায় দেখা গেছে, টাইপ ১ ডায়াবেটিস রোগীদের ৪৩% এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিস রোগীদের ৭৯% রমজান মাসে রোজা রাখেন।
রোজার সময় একজন মানুষকে ভোররাত হতে সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত না খেয়ে থাকতে হয়। ভৌগোলিক অবস্থান ও মৌসুম ভেদে এ সময়কাল ১৪ ঘণ্টা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ২৩ ঘণ্টা পর্যন্ত হতে পারে।
আমাদের দেশে সেহরি ও ইফতারের মধ্যবর্তী সময় সর্বোচ্চ ১৮ ঘণ্টা হতে পারে। এ দীর্ঘ সময় একজন ডায়াবেটিস রোগীর না খেয়ে থাকা উচিত হবে কি না, তা নিয়ে অনেক বছর ধরে বহু বিতর্ক হয়েছে। অবশেষে পৃথিবীর মুসলমান ও অমুসলমান ডায়বেটিস বিশেষজ্ঞগণ সর্বসম্মতভাবে মতামত দিয়েছেন যে, ডায়াবেটিস রোগীর পক্ষে রোজা রাখা ক্ষতিকর হবে। ডায়াবেটিস রোগীর বিপর্যস্ত বিপাকীয় তন্ত্রের কারণে দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকলে শারীরিক নানাবিধ সমস্যা হতে পারে।
কোনো ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ ডায়াবেটিস রোগীকে রোজা রাখার পরামর্শ দেবেন না। তবে কোনো ডায়াবেটিস রোগী যদি ধর্মীয় প্রচণ্ড আগ্রহের কারণে রোজা রাখতে চান, তবে তাকে নিষেধ করাও কারও পক্ষে সম্ভব না। এখানে আমরা ডায়াবেটিস রোগীর রোজা রাখার কারণে যেসব সমস্যা হতে পারে এবং তা থেকে যতটা সম্ভব সতর্ক থাকার পদ্ধতি আলোচনা করব।
রোজা রাখার সময় ডায়াবেটিস রোগীর ঝুঁকিসমূহ
১. রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা কমে যাওয়া (হাইপোগ্লাইসেমিয়া):
খাদ্য গ্রহণে অনেকক্ষণ যাবত বিরত থাকলে রক্তের গ্লুকোজের পরিমাণ কমতে থাকে। রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ ডায়াবেটিস রোগীর রোজা রাখার সময় এতটাই কমে যেতে পারে যে তাকে হাসপাতালে ভর্তি পর্যন্ত করতে হতে পারে। টাইপ ১ ডায়াবেটিস রোগীর ক্ষেত্রে এরূপ হাইপোগ্লাইসেমিয়া হবার সম্ভবনা ৪.৭ গুণ এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে ৭.৫ গুণ বেশি।
২. রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া (হাইপারগ্লাইসেমিয়া):
রোজা রাখার কারণে টাইপ ১ ও টাইপ ২ উভয় ধরনের ডায়াবেটিস রোগীর ক্ষেত্রেই রক্তে গ্লুুকোজের মাত্রা বেড়ে যাবার কিছুটা ঝুঁকি থাকে। টাইপ ১ ডায়াবেটিস রোগীর ক্ষেত্রে তা মারাত্মক হতে পারে। তবে কারও কারও ক্ষেত্রে এ থেকে জীবননাশের ঘটনাও ঘটতে পারে। রমজান মাসের শেষের দিকে এ ঘটনাগুলো ঘটার সম্ভাবনা বাড়তে থাকে।
৩. ডায়াবেটিক কিটোঅ্যাসিডোসিস
টাইপ ১ ডায়াবেটিস রোগীরা বেশ কিছু ক্ষেত্রে রক্তের গ্লুকোজ মারাত্মকভাবে বেড়ে যাওয়া বা এর ধারাবাহিকতায় কিটোনবড়ি বেড়ে যাবার কারণে সংকটাপন্ন অবস্থায় পড়তে পারেন; বিশেষ করে যাদের রক্তের গ্লুকোজের নিয়ন্ত্রণ রোজা শুরুর আগে ভালো ছিল না। টাইপ ২ ডায়াবেটিস রোগীর ক্ষেত্রেও এরকম হতে পারে।
৪. পানিশূন্যতা ও থ্রম্বোএম্বোলিজম
রোজা রেখে দীর্ঘ সময় পানি বা পানীয় খাদ্য গ্রহণে বিরত থাকার কারণে শরীরে পানিশূন্যতা (ডিহাইড্রেশন) দেখা দিতে পারে। আর গরম ও বেশি আর্দ্র আবহাওয়ায় পানিশূন্যতা আরো প্রকট হতে পারে। যাদেরকে রোজা রেখে কঠোর শারীরিক শ্রম দিতে হয়, তাদেরও পানিশূন্যতা দেখা দেবার ঝুঁকি থাকে। তাছাড়া, রক্তে বেশি মাত্রায় গ্লুকোজ থাকলে শরীর থেকে পানি ও খনিজ পদার্থ বের হয়ে যাবার হার অনেক বৃদ্ধি পায়। এতে করে বসা বা শোয়া অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়ালে মাথা ঘুরে যেতে পারে। বিশেষত, যাদের ডায়াবেটিসের কারণে স্নায়ুবিক সমস্যা দেখা দিয়েছে, তাদের এ সময় সহসা জ্ঞান হারানো, মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়া, আঘাতপ্রাপ্ত হওয়া, হাড় ভেঙে যাওয়া ইত্যাদি ঘটে যাবার সম্ভাবনা বেশি থাকে। দেহের পানিশূন্যতার কারণে রক্ত জমাট বেঁধে চোখের রেটিনার কেন্দ্রীয় শিরা বন্ধ হয়ে দৃষ্টিশক্তি হারাবার ঘটনা ঘটেছে সৌদি আরবে ও অন্যান্য মরু অঞ্চলে।
রোজায় ডায়াবেটিসের ব্যবস্থাপনা
ডায়াবেটিস রোগীর রোজা রাখা একান্তভাবেই তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত, যা তার স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করতে পারে এবং তার চিকিৎসকের জন্যও তা চ্যালেঞ্জ ছুেড় দেয়। প্রত্যেক ডায়াবেটিস রোগীই রোজা রেখে কমবেশি ঝুঁকির আওতায় চলে আসেন।
এক্ষেত্রে করণীয় বিষয়সমূহ হলো:
- প্রত্যেক রোজাদার ডায়াবেটিস রোগীর অবস্থা তার স্বাতন্ত্র্যসহ বিবেচনা করতে হবে।
- ঘন ঘন রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা দেখতে হবে (প্রতিদিন বেশ কবার—কম পক্ষে তিনবার—রক্তে গ্লুকোজ মাপতে হবে)। দিনের শেষভাগে অবশ্যই রক্তের গ্লুকোজ দেখার ব্যবস্থা থাকতে হবে। আর টাইপ ১ ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে খুব সতর্কতার সাথে রক্তের গ্লুকোজ লক্ষ রাখতে হবে। রমজানের প্রথম দিকের দিনগুলোতে একটু বেশি সর্তক থাকতে হবে, পরে অবস্থা বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।
- প্রতিদিনের খাদ্যের পুষ্টিমান অন্যান্য সময়ের মতোই রাখার চেষ্টা করতে হবে, যদিও তা খুব সহজ না-ও হতে পারে। স্বাভাবিক দৈহিক ওজন ধরে রাখার পদক্ষেপ নিতে হবে। গবেষণায় দেখা যায় রমজানে রোজা রেখে ২০%-২৫% ডায়াবেটিস রোগীর দৈহিক ওজন কমে বা বাড়ে। ইফতারে চর্বিসমৃদ্ধ খাদ্য এবং তেলেভাজা খাবার গ্রহণ করা হতে যতটা সম্ভব বিরত থাকতে হবে। কেননা এসব খাবার হজম হতে সময় লাগবে। কিন্তু ডায়াবেটিস রোগীর ইফতারের পরপরই যত দ্রুত সম্ভব রক্তে গ্লুকোজ সরবরাহ করার ব্যবস্থা করা জরুরি। সেজন্য জটিল শর্করাজাতীয় খাবার সেহরির সময় খেতে হবে। আর ইফতারিতে সহজপাচ্য খাবার খেতে হবে। প্রচুর পানি ও অন্যান্য তরল খাবার খেতে হবে। সেহরির খাবার নির্ধারিত সময় শেষ হবার ঠিক পূর্বে (অর্থাৎ ফজরের আযানের ঠিক আগে সেহরি শেষ হলে ভালো) খেতে হবে এবং তারপর প্রচুর পানি পান করা বাঞ্ছনীয়।
- শারীরিক শ্রম বা ব্যায়ামসহ স্বাভাবিক শারীরিক কর্মকাণ্ড চালানো যেতে পারে এ সময়। তবে খুব বেশি কঠোর পরিশ্রম বা ব্যায়াম না করাই ভাল। এতে করে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হতে পারে। আর কঠোর পরিশ্রম বিকাল বেলায় তো করা যাবেই না। তারাবি নামাজ পড়লে, তাকে শারীরিক শ্রমের বিকল্প হিসেবে গন্য করা যেতে পারে। কিছু কিছু ডায়াবেটিস রোগী (বিশেষত টাইপ ১) যাদের রক্তের গ্লুকোজ ঠিকমতো রাখা যাচ্ছে না, তাদের ক্ষেত্রে হাইপোগ্লাইসেমিয়ার ঘটনা প্রায়শ মারাত্মক হয়।
- প্রত্যেক ডায়বেটিস রোজাদারকে এ কথা খুব স্পষ্টভাবে বুঝতে হবে যে, যখনই হাইপোগ্লাইসেমিয়ার কোনো লক্ষণ শরীরে দেখা দেয় তার পর যতটা সম্ভব দ্রুততর সময়ের মধ্যে গ্লুকোজ/চিনি/মিষ্টি কোনো খাদ্য, সরবত ইত্যাদি যেকোনো একটি খেয়ে নিতে হবে। যাদের হাইপোগ্লাইসেমিয়া হয়েছে, তারা তো খুব সহজেই এর প্রাথমিক উপসর্গ চিনতে পারবেন। আর যাদের তেমন অভিজ্ঞতা হয়নি, তাদের বুক ধড়ফড়ানি, মাথা ফাঁকা ফাকাঁ লাগা, ঘাম হওয়া, হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাওয়া, চোখে অন্ধকার দেখা, মাথা ঘোরা ইত্যাদির এক বা একাধিক লক্ষণ দেখা দিতে পারে। তখন হাইপোগ্লাইসেমিয়া (রক্তের গ্লুকোজ এ সময় সাধারণত ৩.৩ মিলিমোল/লিটার) হবার কথা। আবার দিন শুরুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই যদি রক্তের গ্লুকোজ ৩.৯ মিলিমোল/ লিটার বা তার চেয়ে কমে যায়, তাহলেও কিছু খেয়ে নেওয়া জরুরি। আর যারা ইনসুলিন, সালফুনাইলইউরিয়া-মেগ্লিটিনাইড জাতীয় ওষুধ গ্রহণ করছেন, তাদের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটার সম্ভাবনা বেশ বেশি। আবার রক্তের গ্লুকোজ ১৬.৭ মিলিমোল/ লিটারের বেশি হলেও রোজা রাখা সম্ভব হবে না।
প্রাক-রমজান মূল্যায়ন
যেসব ডায়াবেটিস রোগী ডায়াবেটিস নিয়ে রোজা রাখার সব ঝুঁকির কথা জেনেও রোজা রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, তাদেরকে রোজা শুরুর কমপক্ষে এক মাস আগে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিতে হবে। এর মধ্যে আছে ঘুম থেকে উঠেই এবং খাওয়ার ২ ঘণ্টা পর (মোট ৪ বার) রক্তের গ্লুকোজ, খালি পেটে রক্তের লিপিড, লিভার, কিডনী ও হৃদপিন্ডের কার্যকারিতার পরীক্ষা এবং এইচবিএ১সি ইত্যাদি পরীক্ষা করে নিতে হবে।
সবারই নিজের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে আগ্রহী হওয়া উচিত। চিকিৎসকরা এক্ষেত্রে তাদেরকে সহায়তা দেবেন। তবে রমজানের ৩ মাস আগে থেকে ডায়াবেটিস রোগীর রোজা রাখার প্রস্তুতি শুরু করাটা সবচেয়ে বিবেকপ্রসূত পদক্ষেপ হবে।
- ডা. শাহজাদা সেলিম: সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ