অপ্রয়োজনীয় সাফারি পার্ক আর কেন?
গত এক যুগ ধরে নানা অপ্রয়োজনীয় লক্ষ্য-উদ্দেশে ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের খামখেয়ালিপনা অধিক গুরুত্ব দিয়ে জন-আকাঙ্ক্ষা ও জনস্বার্থবিরোধী প্রকল্প প্রণয়ন ও প্রকল্প ব্যয় করাই যেন বাংলাদেশে রীতি ছিল। অবিবেচনাপ্রসূত এসব প্রকল্প অবলীলায় পার হয়ে যেত পরিকল্পনা প্রণয়নের সব ধাপ। অথচ সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের সেবা ও কাজের ধরন অনুযায়ী যেসব ব্যয় জরুরি, সেসব বিষয় ক্রমাগত উপেক্ষিত থেকেছে; বরং রাষ্ট্রের সম্পদবিনাশী সব আয়োজন করা হয়েছে বারবার, বহুবার।
বাংলাদেশ বন অধিদপ্তরের লাঠিটিলা সাফারি পার্ক প্রকল্পটি তেমনি এক প্রকল্প। আমজনতা ও পেশাজীবীদের পরামর্শ উপেক্ষা করে মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার লাঠিটিলায় পাঁচ হাজার ৬৩১ একর সমৃদ্ধ সংরক্ষিত বনে 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক, মৌলভীবাজার (১ম পর্যায়)' শীর্ষক ৩৬৪ কোটি ১১ লাখ টাকার প্রকল্পটি পরিবেশ অধিদপ্তরের যথাযথ পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা ছাড়াই একনেকে অনুমোদিত হয়ে অর্থ বরাদ্দ প্রাপ্তি ও বাস্তবায়নের অপেক্ষায় আছে!
বলা হচ্ছে, এমনকি একজন সাবেক বনমন্ত্রীও বলেছেন, সাফারি পার্ক করে এখানকার বনে জবরদখল প্রতিরোধ করা হবে। জবরদখল প্রতিরোধে এনফোর্সমেন্ট, সামাজিক বনায়নসহ জীবিকায়ন নির্ভর নানা উপায় আছে, যা খোদ বন অধিদপ্তরই অন্যত্র সফলভাবে বাস্তবায়ন করেছে। সে রকম ভাবা যেত।
বাংলাদেশের অনেক বনেই এর চেয়েও ব্যাপক জবরদখল আছে, যা উদ্ধারে কার্যকর ও জনসম্পৃক্ত উদ্যোগ তেমন চোখে পড়ে না। অথচ সমৃদ্ধ বন ধ্বংসের জন্য লাঠিটিলার বনে সাফারি পার্ক করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। বন ও বন্যপ্রাণ বিনাশের আয়োজন আছে এ প্রকল্পে।
লাঠিটিলার এই বন এলাকা বৃক্ষরাজি ও বিপন্নপ্রায় নানা বন্যপ্রাণে সমৃদ্ধ। অথচ এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন সমীক্ষা দলের জীববৈচিত্র ও বন্যপ্রাণী পরামর্শকরা বনভূমিটি পাথারিয়া সংরক্ষিত বনের অংশ হিসেবে নানা উল্লেখযোগ্য বন্যপ্রাণী যেমন হাতি, বনরুই, উল্লুক, মায়া হরিণ, বন্যশকুর, চিতা বিড়াল, গন্ধগোকুল ইত্যাদির আবাসস্থল, এটা তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেও বনটিতে বিদেশি বন্যপ্রাণী জিরাফ, জেব্রা, জলহস্তী, সিংহ, কুমির, অরিক্স, অস্ট্রিচ, ইমু, আফ্রিকান মোষ, ডলফিন, ক্যাঙারু ইত্যাদি আমদানি করে সাফারি পার্ক করার পরামর্শ দিলেন কোন বিবেচনায়?
বন্যপ্রাণীর যত্ন ও সেবার ক্ষেত্রে যেসব কোয়ারেন্টাইন, দক্ষতা ও প্রটোকল মেনে চলা দরকার, বন অধিদপ্তরের সাফারি পার্কগুলোতে সেসব সক্ষমতা না গড়েই নানা জেনেটিক রোগ সংক্রমণের উর্বরক্ষেত্র হিসেবে বাংলাদেশে একই নামে একের পর এক তিন-তিনটি (যেগুলো আসলে একটা বড়সড় চিড়িয়াখানাই) সাফারি পার্ক প্রতিষ্ঠা করায় সরকারকে উজ্জীবিত করে চলছে কোন কোন মহল?
দেশি বন্যপ্রাণের আবাসস্থল বিনষ্ট করার জন্য নানা অপ্রয়োজনীয় স্থাপনা, সড়ক ও কনক্রিটের জঙ্গল তৈরি, মুক্ত বন্যপ্রাণকে খাঁচায় পুরে, লক্ষ-কোটি টাকা ব্যয়ে বিদেশি বন্যপ্রাণী আমদানি ও প্রদর্শনের এত তোড়-জোড় কার ব্যবসায়িক স্বার্থে?
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের নামে ব্যবসা ও ব্যক্তিগত সুবিধাদির অনন্ত ব্যবস্থা কোন প্রয়োজনে? কোন স্বার্থে?
বিগত এক দশক ধরে দেখছি, আমাদের দেশে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের নামে চলছে ব্যবসা, ব্যক্তিগত সুবিধাদির যথেচ্ছ ব্যবহার। হাতি-বাঘ ইত্যাদি বড় বন্যপ্রাণী রক্ষার নামেও অপচয় হয় বিপুল অর্থ। অথচ ছোট স্তন্যপায়ী বন্যপ্রাণী ও পাখি সংরক্ষণ আলোচনাতেই থাকে না।
বন্যপ্রাণীবিদ ছাড়াও কিছু দেশিয় ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক পরামর্শক এবং আন্তর্জাতিক সংরক্ষণবাদী প্রতিষ্ঠানগুলো পরামর্শ সেবার বাইরে গিয়ে বিগত ১৫ বছরে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কাজের বাস্তবায়ন ও বিপন্ন বন্যপ্রাণীর অবিরাম মৃত্যু দেখেও প্রশ্ন তোলেননি। এমনকি নিজেদের মধ্যে আলোচনার আয়োজন করে সরকারকে উপযাচক হয়ে পথ নির্দেশ করেননি। বাঘ সংরক্ষণ ও হাতি সংরক্ষণের নামে গৃহীত নানান বৃহৎ প্রকল্পের সাফল্য কী? বিশেষত ১০ মিলিয়ন ডলারের বাঘ প্রকল্প? তার কি যথাযথ পর্যালোচনা হয়েছে? ধারণা করা যায়, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের নামে অনেক ব্যয় খোদ বন অধিদপ্তরেরও অজানিত।
বেশিরভাগ সময়ই পেশাজীবীদের মধ্য থেকেও ঘুরে ফিরে অল্প কিছু চেনামুখ বেছে নেওয়া হয় নানা কাজে, যাতে বন্যপ্রাণী ঘিরে ব্যবসা চলমান থাকে। কোনো কোনো বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ বন্যপ্রাণীকে প্রদর্শনযোগ্য করতেই ব্যস্ত থাকেন। তাই তারা বাংলাদেশের যেখানেই মুক্ত বন্যপ্রাণী ধরা পড়ে, হোক পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী কিংবা যশোর, সব ধরে এনে সাফারি পার্কে আটকে রাখেন। প্রতিবেশ-আবাসস্থল ইত্যাদি বিবেচনাতেই আসে না।
এসব কারণে আমার ধারণা জন্মেছে যে বাংলাদেশের যে কয়টি কালো ভাল্লুক বা সাম্বার হরিণ আছে, তার সিংহভাগ আছে হয় সাফারি পার্কে, নয়তো চিড়িয়াখানায়। এ যাবৎ সাফারি পার্ক তৈরিতে যে ব্যয় হয়েছে, তার এক দশমাংশ বিপন্নপ্রায় বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ, ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয় সক্ষমতা অর্জনে প্রশিক্ষণ, গবেষণা এবং বন্যপ্রাণী পাচার ও অপরাধ দমনের মতো গুরত্বপূর্ণ খাতগুলোতে ব্যয় হয়নি, এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
সাফারি পার্ক-অন্তপ্রাণ কিছু বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞের মতে, প্রাণীগুলো সাফারি পার্কে আছে বলেই টিকে আছে, নইলে প্রকৃতিতে তার টিকে থাকার পরিবেশ নেই।
এ ধারণার কারণেই সারাদেশে অনেক জায়গায় বন্যপ্রাণীকে অবৈধভাবে আটকে রেখে মিনি-চিড়িয়াখানা ও চিড়িয়াখানা গড়ে তোলা হয়েছে; কখনো কখনো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়! অথচ চিড়িয়াখানাতেও বন থেকে সংগ্রহ করে বন্যপ্রাণী রাখার কোনো প্রটোকল নেই।
বাংলাদেশের অনেক চিড়িয়াখানার প্রাণী সংগ্রহের দলিল খুঁজলে বন্যপ্রাণী পাচারের আলামত পাওয়া যাবে। প্রকৃতিতে টিকে থাকার জন্য আবাসস্থল সংরক্ষণে গুরুত্ব না দিয়ে বন্দী বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেমন বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ, এটা আমার মাথায় আসে না! এসব বন্যপ্রাণ বিশেষজ্ঞকে আমি সাফারিপার্ক স্থাপনে অর্থ ব্যয় না করে বিপন্নপ্রায় বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণে যেসব জাতীয় সংরক্ষণ কর্মকৌশল হাতে নেওয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়নে অর্থ ব্যয়ের বিষয়টি ভাবতে, প্রকল্প কিংবা কার্যক্রম গ্রহণ বা বাস্তবায়নের মান নিয়ে প্রশ্ন করতে দেখি না।
প্রাকৃতিক বন রক্ষা ছাড়া বিচ্ছিন্নভাবে, এমনকি বাইরে থেকে খাবার সরবরাহ করে, যা বন বিভাগ নানা জায়গায় করে থাকে; দীর্ঘমেয়াদে বন্যপ্রাণী বাঁচানোর উপায় নেই। কেননা দেশের সব গুরুত্বপূর্ণ বন্যপ্রাণী প্রাকৃতিক বনেই বাস করে। প্রয়োজন বন্যপ্রাণী উপযোগী আবাসস্থল। জরুরি ভিত্তিতে দেশের প্রাকৃতিক বনগুলোর পুনরুদ্ধার প্রয়োজন। অথচ আমরা এদেশে বিগত বছরগুলোতে ক্রমাগত উল্টোটাই হতে দেখেছি।
বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল, বিশেষত এদেশের নিবাসী হাতিদের এলাকা, চুনতি, ফাসিয়াখালী ও মেধাকচ্ছপিয়ার তিনটি রক্ষিত এলাকা ধ্বংস করে নির্মিত হলো রেলপথ। জনগণ কি চেয়েছিল এই রেলপথ? আজ কার কাজে লাগছে এই রেলপথ? এখন তো শুনছি ওই অঞ্চলে হঠাৎ বন্যার জন্যেও জনগণ দুষছেন রেলপথকেই। অথচ এ এলাকার মানুষ ও বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা কেউই জোরালোভাবে দাড়াননি জনস্বার্থে! বন ও বন্যপ্রাণী ধ্বংসের আয়োজকদের যথাযথ জবাবদিহির মধ্যে আনতে ব্যর্থ হয়েছেন।
আমরা বন ও বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনার সাথে ব্যাপক মানুষের সংযোগ ঘটাতে পারছি না বলেই এমন হচ্ছে। এখনও আমাদের বন ও বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনার চিন্তা আটকে আছে প্রকল্প-নির্ভরতা, গুটিকয়েক ছদ্ম-বন্যপ্রাণী-সাফারি পার্ক ব্যবসায়ী, সহযোগী চেনামুখ পরামর্শক আর প্রতিষ্ঠানের ঘেরাটোপে। তাই নতুন করে বিদেশি বন্যপ্রাণী আমদানি করে প্রদর্শনের জন্য নেওয়া লাঠিটিলায় সাফারিপার্ক তৈরির হঠকারী পরিকল্পনা বাদ দিয়ে জনগণের নানা অংশের সাথে সংযোগ বাড়িয়ে নতুন জবাবদিহিমূলক বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি তৈরি করা দরকার। জরুরি ভিত্তিতে ইতিপূর্বে ফেলে রাখা সব বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কৌশল, হাতি করিডোর পরিকল্পনা, বাঘ ও হাতি সংরক্ষণ সংক্রান্ত পরিকল্পনাগুলোর বাস্তবায়নে উদ্যোগ নিতে হবে।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, আরণ্যক ফাউন্ডেশন,
সাংগঠনিক সম্পাদক, ইনস্টিটিউট অব ফরেস্টার্স বাংলাদেশ