‘গুম-ক্রসফায়ারের ঘটনায় রাষ্ট্র পরিচালনাকারীরা নির্লিপ্ত থেকেছেন’
মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং এর সাবেক ও বর্তমান সাতজন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
শুক্রবার ইউএস ডিপার্টমেন্ট অফ ট্রেজারি থেকে জারি করা এক প্রেস বিবৃতিতে 'মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘনে' জড়িত থাকার অভিযোগে র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ পুলিশের বর্তমান মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে বলে জানানো হয়।
এ ছাড়া র্যাবের বর্তমান মহাপরিচালক (ডিজি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) খান মোহাম্মদ আজাদ, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) তোফায়েল মোস্তাফা সরোয়ার, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) মো. জাহাঙ্গীর আলম ও সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) মো. আনোয়ার লতিফ খানের ওপরও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে মার্কিন ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট।
পৃথক এক ঘোষণায় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর বেনজীর আহমেদ এবং র্যাব-৭-এর সাবেক অধিনায়ক মিফতাহ উদ্দীন আহমেদের ওপর সে দেশে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
এ ব্যাপারে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের কাছে নিজেদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।
নূর খান লিটন
আমার কাছে যেটা মনে হচ্ছে, এখানে যে সাতজনের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে, তাদের দায় সম্ভবত ঊর্ধ্বতন দায়িত্বশীলতার জায়গায় থাকা। কারণ তারা চেইন অব কমান্ডের উপরের দিকে অবস্থান করেন।
বাংলাদেশে যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে গত দীর্ঘদিন ধরে, সেগুলোর ব্যাপারে গত এক যুগ ধরে বাংলাদেশের মানবাধিকার কর্মীরা, মানবাধিকার সংগঠনগুলো বারবার সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে যেন গুম ও ক্রসফায়ারের ঘটনাগুলোয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনের মাধ্যমে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে বিচার আওতায় আনা হয়। কিন্তু সমস্যা হলো, বাংলাদেশের রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করেন, তারা এ ব্যাপারে নির্লিপ্ততার ভাব করেছেন। এবং তাদের মধ্যে যারা নীতিনির্ধারণীর পর্যায়ে আছেন, তাদের অনেক সময়ের মন্তব্যগুলোও ছিল তুচ্ছতাচ্ছিল্যের নামান্তর।
যেমন ধরেন, তারা অনেক সময় বলেছেন, গুম হওয়া ব্যক্তিদের কাছে লোকে টাকা পাবে তাই তারা পালিয়ে আছেন। তারপর ক্রসফায়ারের ঘটনাকেও জায়েজ করার চেষ্টা করা হয়েছে দুই পক্ষের গোলাগুলির কথা বলে। কিন্তু সাধারণ মানুষ এবং যারা এগুলো নিয়ে কাজ করেন তারা একটা বিষয় নিশ্চিত ছিলেন যে এগুলো সবই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কিংবা জোরপূর্বক অন্তর্ধান।
দাবি জানানো হলেও সরকারের তরফ থেকে কিন্তু কখনোই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি, পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের একটা দুর্বলতাও কিন্তু প্রকাশ পেয়েছে। আর এখন বিশ্বের যে অবস্থা, তাতে একা একা কিন্তু কোনো রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারবে না। তাকে ব্যবসা-বাণিজ্য, সংস্কৃতি, ভাষা নানাবিধ কারণে একে-অপরের উপর নির্ভর করতে হবে। যেমন আমরা অনেক কারণে আমেরিকার উপর যেমন নির্ভরশীল, আমেরিকাও কিন্তু অনেক কারণে আমাদের উপর নির্ভরশীল। ফলে একটা দেশের কিন্তু দায় ও দায়িত্ব থাকে যে সে যার সঙ্গে সম্পর্ক করবে, সম্পর্ক বজায় রাখবে, ব্যবসা-বাণিজ্য করবে, সেদেশের পরিস্থিতি কেমন। গণতন্ত্রের পরিস্থিতি কেমন, মানবাধিকার পরিস্থিতি কেমন, সেই বিষয়গুলো তারা নিশ্চয়ই পর্যবেক্ষণ করেন। এবং সেটার ভিত্তিতেই তারা তাদের সম্পর্ক নির্ণয় করেন।
এসব কারণেই সম্ভবত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের নিষেধাজ্ঞাটা জারি করেছে, এবং এক্ষেত্রে আরেকটি কথাও তারা বলেছে, তাদের (নিষিদ্ধ ব্যক্তিদের) কারো যদি নিজ নামে বা অন্যের নামে আমেরিকায় সম্পত্তি থাকে, সেটিও কিন্তু তারা প্রয়োজনে বাজেয়াপ্ত করবে। তো, এর মাধ্যমে জাতিগতভাবে কিন্তু আমাদের চরিত্রের উপর একটা কালিমা লেপন করা হলো। সরকার যদি আগেই এই ব্যাপারগুলোতে স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করে ব্যবস্থা গ্রহণ করত, তাহলে এই দায় আজ রাষ্ট্রের উপর বর্তাত না।
আজকের এই দায় কেবল সাতজন ব্যক্তির উপর না, প্রকারান্তরে তারা যে সংগঠনের সাবেক বা বর্তমান কর্মকর্তা তাদেরও দায়, এবং এটি যদি চলমান থাকে, তাহলে রাষ্ট্রও সেই দায় এড়াতে পারবে না।
নূর খান লিটন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক এবং মানবাধিকার কর্মী।