দানাদার মিষ্টি, বেলাল চৌধুরী ও আরও কিছু...
আমার ছোটবেলা কেটেছে টিকাটুলিতে। এখন টিকাটুলিকে পুরান ঢাকা বলা হলেও পঞ্চাশের দশকে কিন্তু এই টিকাটুলিই ছিল ঢাকার অন্যতম কেন্দ্র। আর ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে অনেক বেশি সরব আর সচল ছিল সদরঘাট। এখন যে মতিঝিল আমরা দেখছি তা তখন এত বড় আর উন্নত ছিল না। এরপর এলো ধানমন্ডি, গুলশানের আমল। কিন্তু তখন পুরান ঢাকার এই অঞ্চলগুলোই ছিল শহরের প্রাণকেন্দ্র।
তখন মতিঝিলে মানুষ পাখি শিকার করতো। আমার বাবা নিজেও পাখি শিকার করতেন। বাবার মুখেই শুনেছিলাম হাওরে যেমন পাখিরা বিচরণ করতে আসে, তেমন '৪৯ সালের দিকে সেখানে পাখির দেখা মিলতো আর লোকজন সেই পাখি শিকার করতো।
টিকাটুলিতে আমরা থাকতাম অভয় দাশ লেনে। পাশেই ছিল কে এম দাশ লেন। এইসব এলাকাগুলো তখন মধ্যবিত্ত সম্ভ্রান্ত পাড়া হিসেবেই পরিচিত ছিল। তখনকার সময়টা এখনকার মতো এত বিস্তৃত ছিল না। আমরা সবাই সবাইকে চিনতাম, জানতাম। পাড়াগুলোতে এখনকার মতো বড় বড় এপার্টমেন্ট ছিলনা, ছিল সব একতলা-দু'তলা বিল্ডিং, যে কারণে পাড়ার সবাই সবারই পরিচিত ছিল। এরকম একটি পরিবেশে আমি বড় হয়েছি, যা ভাবলেই এখন ভালো লাগে।
কে এম দাশ লেনের ১১ নাম্বারে থাকতেন শেরে বাংলা একে ফজলুল হক সাহেব। ফজলুল হক সাহেবের ভাগ্নে আজিজুল হক স্যার থাকতেন আমাদের পাশের বাসায়। নান্না মিয়া নামে তাকে সবাই ডাকতো। তিনিও রাজনীতি করতেন। আবার এদিকে আমরা থাকতাম অভয় দাস লেনের ১০ নাম্বারে। তার নাম ছিল নান্নু মিয়া। এই নান্নু আর নান্না মিয়াকে সবাই গুলিয়ে ফেলতো। একবার আমিও তাই-ই করলাম।
তখন আমার বয়স তিন কি চার বছর। একজন আগন্তুক আমাকে জিজ্ঞেস করলেন নান্নু মিয়ার বাসা কোথায়। যেহেতু সবাই সবাইকে চিনতাম তাই নান্না মিয়া ভেবে আমি পাশের বাসা দেখিয়ে দিলাম। কেননা তখন আমি নিজেও জানতাম না আমার বাবার আরেক নাম নান্নু মিয়া।
এই যে একটা সংস্কৃতি ছিল আমাদের মাঝে, আমরা প্রত্যেকে প্রত্যেককে চিনতাম, জানতাম এটা আমার জীবনে একধরনের ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে এখন তা বুঝতে পারি।
জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে ছোটবেলার কথা যখন ভাবি তখন পুরোটা জুড়ে টিকাটুলিই খেলা করে। সেদিন সমকালের অনুষ্ঠানে গিয়ে আমার মনে হলো, এই সমকালের জন্মও তো আমাদের টিকাটুলিতে। সমকালের সম্পাদক সিকান্দার আবু জাফরের বাড়ি ছিল টিকাটুলিতে। সমকালের অফিসটি ছিল তাঁর বাড়িতেই। ফলে এ অঞ্চলে কবি সাহিত্যিকদের আসা যাওয়া ছিল নিত্তনৈমত্তিক ব্যাপার। কিন্তু আমাদের কাছে তাদেরকে কখনো রহস্যময়ী, অতিমানবী বলে মনে হতো না কিংবা তাদের মাঝে কোনো ভাব বা অহংকারও কাজ করতো না কখনো। এসব জ্ঞানী-গুনী ব্যক্তিরা আমাদের কাছে কেবলই পাড়ার লোক ছিল। একসময় টিকাটুলিতে এমন পরিবেশই বিরাজ করতো। কিন্তু এখনকার মানুষ কি কখনো বুঝতে পারবে, টিকাটুলি আসলে কেমন জায়গা ছিল?
এই সিকান্দার আবু জাফরের একটি এয়ারগান ছিল । একবার তিনি সেই এয়ারগান দিয়ে একটি কাক মারলেন। আর শত শত কাক এসে তাঁর বাড়ির সামনে এসে জড়ো হলো। আমরাও গেলাম সেই দৃশ্য দেখতে। ছোটো ছিলাম, সরল ছিলাম তাই অল্পতেই অবাক হতাম। এখন ভাবতেও আনন্দ লাগে যে, এটাও একটা দেখার মতো বিষয় বলে মনে হয়েছিল তখন ।
ঠিক তার বাড়ির সামনেই থাকতেন শিল্পী সৈয়দ জাহাঙ্গীর। আরেক পাশে থাকতেন বেগম সুফিয়া কামাল। যেহেতু সুফিয়া কামাল ছিলেন আমার নানীর বন্ধু, তাই আমরা তাকে নানী বলেই ডাকতাম। তাঁর ছেলে শাহেদ কামালকে ডাকতাম শামীম মামা নামে। আর যারা কিশোর বয়সের ছিলেন তাদের দেখতাম বড় ভাই বোনের চোখে। এভাবেই একটা পরিবারের মত ছিলাম সবাই। এরমধ্যে অনেকে ছিলেন কলকাতার, যাদের আদিনিবাস ছিল পূর্ববঙ্গে।
অভয় দাশ লেনের ১২ নাম্বার রোডে থাকতেন খোকা মামা। এই খোকা মামা ছিলেন শেখ মুজিবর রহমানের আত্মীয়। বঙ্গবন্ধুর বাবা শেখ লুৎফর রহমান প্রায়ই এসে থাকতেন সেখানে। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে এই পাড়াটি ছিল মূলত সেসব সম্ভ্রান্ত মধ্যবিত্তের আখড়া, যে মধ্যবিত্তরা পরবর্তীতে দেশ প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখেছেন।
মানুষ যখন আজ মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে, সেখানে আসলে আর্থ-সামাজিক বিশ্লেষণটা আর থাকে না। গরীবের মুক্তিযুদ্ধ আর মধ্যবিত্তের মুক্তিযুদ্ধ এক না। আমাদের একটি মুক্তিযোদ্ধা পাড়াই ছিল। এদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন। একটি দেশের মুক্তিযুদ্ধের শ্রেনীচরিত্র নির্ধারিত হয় তার সংস্কৃতি, অবস্থান ও অর্থনীতির ওপরে। মুক্তিযুদ্ধে শ্রেনীচরিত্র বিশ্লেষণ না করলে এ যুদ্ধে মধ্যবিত্তের ইতিহাস, এই শ্রেনীর অবদান, নিয়ন্ত্রণ, ভূমিকা বোঝা সম্ভব না। মুক্তিযুদ্ধে প্রতিটি শ্রেনীর কতটুকু ভুমিকা রয়েছে তা নির্ধারণ করতে হলে সাংস্কৃতিক, রাজনীতিক, সামাজিক দিক থেকে তা বিশ্লেষণ করতে হবে।
'ভিস্তি'
ছোটবেলার যে স্মৃতি আমার সবচেয়ে বেশি মনে হয় তা হলো, আগে মিউনিসিপ্যালিটির একটা পানির কল ছিল। এলাকার অনেকেই এখান থেকেই পানি সংগ্রহ করতো। যেহেতু কলটি আমাদের বাড়ির সামনে ছিল, তাই সেখানে এসে সবাই ভিড় করতো। কেরোসিনের টিনের ভিতর পানি নিয়ে তা বিক্রি করতো। কখনো ১ পয়সা দু পয়সা দিয়ে পানি খেত মানুষ। এই যে একটি শহরে পানি নেই। এই বিষয়টি কি এখনকার প্রেক্ষাপটে ভাবা যাবে? কিন্তু তখন সম্ভব ছিল। কারণ তখন মানুষও কম ছিল, তাদের মধ্যে সহনশীলতাও বেশি ছিল। আর ছিল ভিস্তি, যারা চামড়ার ব্যাগে পানি নিয়ে পানি বিক্রি করতো। এখন এসব রূপকথার গল্প শুধু।
'পুডিংয়ের গাড়ি'
অন্য যে সমস্যাটি প্রকট ছিল তা হলো, স্যানিটারি ল্যাট্রিনের অভাব। আমার জন্ম ৫২ সালে, আমার মনে আছে ৫৫-৫৬ সাল পর্যন্ত, প্রতিদিন সেখানে মিউনিসিপ্যালিটির একটি কনটেইনার গাড়ী আসতো। একদিন আমার বড় ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম এই গাড়িটি কীসের? ভাই আমাকে বললো, এটি নাকি পুডিংয়ের গাড়ী। অর্থাৎ মল টানার গাড়ী। বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে তখন এরকম মল টানার গাড়ি দাঁড়াতো। তাদের বড় একটা কনটেইনার ছিল, প্রতি বাড়ি থেকে মল সংগ্রহ করে কনটেইনারে ফেলা হতো। তারপর সেগুলো গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হতো।
এখন যখন এসব ভাবি নিজেই বিশ্বাস করতে পারিনা যে ঢাকা শহরে এমনও দিনও গেছে আমাদের! এখন হয়তো এসব ভাবাও যায়না কিন্তু একদম পঞ্চাশের মাঝামাঝি সময়টায় ঢাকার টিকাটুলির চিত্র এমনই ছিল। এরপাশে ছিল মতিঝিল, ওয়ারী। ওয়ারী তখন ছিল সম্ভ্রান্ত অভিজাত মানুষের বসতি।
বেলাল চৌধুরী ও দানাদার মিষ্টি
আরেকটি মজার ঘটনা মনে পড়ে। কবি বেলাল চৌধুরীর মতো এত সজ্জন ও ভালো মানুষ খুব কমই আছেন। তিনি আজ বেঁচে নেই। তবে তার মুখে শোনা এই গল্পটি এখনো আমার মনে আছে। একদন বেলাল ভাইয়ের সঙ্গে মিষ্টি নিয়ে কথা হচ্ছিল। তখন, এখনকার মতো এত বিচিত্র রকমের মিষ্টি পাওয়া যেত না। একধরনের মিষ্টি পাওয়া যেত, কিছুটা শক্ত এবং শুকনো, চিনি দিয়ে মোড়ানো। আমরা ওটাকে দানাদার বলতাম। ছোটবাচ্চাদের খুব পছন্দের মিষ্টি ছিল এটি।
বেলাল ভাই একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আফসান তুমি এই মিষ্টি খেয়েছো? এরচেয়ে ভালো মিষ্টি আর হয়না। তিনি বললেন এই মিষ্টি কবি শহীদ কাদরীও খুব পছন্দ করতেন। একবার নাকি শহীদ কাদরীর কাছ থেকে একজন লেখা নেবে। কিন্তু শহীদ কাদরী রাজি হচ্ছিলেন না। তখন একজন বললেন, শহীদ কাদরীর কাছ থেকে লেখা আদায় করতে হলে তাকে এক প্যাকেট দানাদার মিষ্টি পাঠান। যদিও তখন প্যাকেটে করে মিষ্টির তেমন চল ছিল না। তালপাতার একটা ঠোঙ্গার মতো ছিল, ওতে করেই দেয়া হতো মিষ্টি। বেলাল ভাই বললেন, বিশ্বাস করবানা আফসান শহীদ কাদরী সেটা একদম বাচ্চাদের মতো প্যাকেট খুলে খেলেন এবং কবিতাও লিখে দিলেন।
সুতরাং দানাদার মিষ্টি দিয়েও কবিদের ঘুষ দেয়া যেত!
ঐ দুনিয়া একরকম, এই দুনিয়া একরকম। আমি খুশি যে আমি দুটোই দেখেছি। এরপর অনেক জায়গায় খোঁজ করেছি এই মিষ্টির। অনেকে বললো, বরিশালে এই মিষ্টি পাওয়া যায়, একজন আবার বললো ফরিদপুরেও পাওয়া যায়। কিন্তু স্বাদ এত ভালো না। আমাদের সময় এত মিষ্টির দোকান ছিল না। আমরা খেতাম রসগোল্লা, পানতুয়া, চমচম, কালো জাম। ছোটোবেলার মিষ্টির কথা বলতে গেলে এগুলোর কথাই মনে পড়ে।
এই ছিল আমাদের মিষ্টির দুনিয়া। পরবর্তীকালে খেলাম মুক্তাগাছার মন্ডা। আমি মুক্তাগাছার সেই বাড়িতেও গিয়েছিলাম, যেখানে এই মিষ্টি বানানো হয়। এটা প্রথমে জমিদারদের জন্য বানানো হতো। পরে ঢাকায় এনে বড় বড় হোটেলে বিক্রি শুরু হয়। এমন একটি দোকান ছিল স্টেডিয়ামের ওদিকে, নাম ছিল প্রভেনশিয়াল সুইটমিট, এখনো আছে কিনা জানিনা।
অর্থাৎ একথা বলাই যায় যে একটি শহরের ইতিহাস সে অঞ্চলের মিষ্টির উপকরণ, মিষ্টি বানানোর গল্প দিয়েও লেখা যায়!
স্মৃতি হাতড়ে শেষে এটাই বলবো যে, আমার ছোটবেলায় মলভর্তি কনটেইনার গাড়ির ইতিহাস যেমন ছিল, তেমন এই উন্নত দানাদার মিষ্টির ইতিহাসও ছিল। দুটোই আজ কেবল গল্প আর স্মৃতি হয়ে আছে।
- অনুলিখন: রাফিয়া মাহমুদ প্রাত