২০২২ সালের ভূ-রাজনীতির উত্তপ্ত ৫ মঞ্চ
রাজনীতি হচ্ছে কথার ফুলঝড়ি ছোটানোর মঞ্চ, ঠিকঠাক লাইন-লেন্থে থাকলে সব কথাই এই জগতে জায়েজ। তবে এতো কথার পরেও রাজনীতিতে 'শেষ' বলে কোন কথা নেই! কবিরা যেমন নতুন বছরের সূচনা করেন পুরোনোকে বিদায় জানিয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে সেই সুযোগ আর কই? একটা নতুন বছর মানেই যে অতীতের সব ঝড়-ঝঞ্ঝার নিঃশর্ত প্রস্থান তা কিন্তু নয় বরং এখানে নতুন দিনের আগমনে নতুনভাবে প্রস্তুতি চলে আঘাত হানার। রাজনীতির এই চিরাচরিত নীতি ভুল না হলে অতীতের তিক্ততা এবছরও বয়ে চলবে বিশ্ব। ভূ-রাজনৈতিক দৃষ্টিতে এই বছর কেমন হতে পারে এইসব দ্বন্দ্বের পরিধি, উত্তেজনার পারদে কোন কোন অঞ্চল সবচে বেশি হতে পারে উত্তপ্ত? এক নজরে দেখে আসা যাক।
ইন্দো-প্যাসিফিক
আক্ষরিক অর্থে ইন্দো-প্যাসিফিক অন্যান্য ভৌগোলিক অঞ্চলের মতো না হলেও কৌশলগত দিক থেকে এটি ভূ-রাজনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ হয়ে উঠছে ক্রমান্বয়ে। শুরুতে এটি ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের কৌশলগত সহায়তার ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হলেও তা যে চীনকে ঠেকানোর প্রয়াস সেটা বলা বাহুল্য। একমেরু কেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা ভেঙে চীনের ক্রমাগত পরাশক্তি হয়ে উঠা অবশ্যই সাদরে মেনে নিবে না যুক্তরাষ্ট্র, সেটাই এই অঞ্চলকে তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছে। চীন-যুক্তরাষ্ট্রের এই দ্বন্দ্বের ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে এবছরও, শুরুতে কোয়াডই মুখ্য থাকলেও এবার এর সাথে যুক্ত হয়েছে অকাস জোট। এই জোটবদ্ধতা দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের একক আধিপত্য রুখতে যুক্তরাষ্ট্রর জন্য ভালোই কাজে দিবে।
অপরদিকে ১৯৪৯ এর বিপ্লব পরবর্তী সময়ে ক্ষমতা কাঠামোয় যে ওলটপালট হয়েছিল তার রেষ এখনো শেষ হয়নি চীন-তাইওয়ানের মধ্যে, উভয়ের মধ্যে আসল চীন কে সেই দ্বন্দ্ব নিরসন হলেও চীন এখনও তাইওয়ানকে নিজেদের অংশ হিসেবেই দেখে বিপরীতে তাইওয়ান আশা দেখে স্বাধীনতার। এমন পাল্টাপাল্টি অবস্থায় চীনা যুদ্ধ বিমান প্রায়ই তাইওয়ান এর আকাশ সীমা অতিক্রম যুদ্ধের বার্তা দিয়ে যায়, এই পরিস্থিতিতে তাইওয়ান এর ভরসা পশ্চিমের দিকে।
চীন-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক এমনিতেই ভালো যাচ্ছে না, তার উপর নিজেদের আঙ্গিনায় দাঁড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এমন বহুমুখী চোখ রাঙানি চীন অবশ্যই সহজে ছেড়ে দিবে না। ফলে এবছর যে ইন্দো-প্যাসিফিকের বিস্তীর্ণ জলরাশি আরো অশান্ত হয়ে উঠবে তা এক প্রকার নিশ্চিত।
দক্ষিণ এশিয়া
দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতি মানেই ভারত-পাকিস্তানের লড়াই, একেবারে খেলার মাঠ থেকে রাজনীতির ময়দান সবখানেই কেউ কাউকে বিন্দু পরিমাণ ছাড় দিতে নারাজ। এবার তাদের জন্য নতুন উত্তেজনা আফগানিস্তান, কাবুলে দুই পক্ষের এই প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা নতুন নয় পাশাপাশি তালেবানের ক্ষমতায় আরোহণও গত বছরের ঘটনা। তবে বাস্তবতা বলে যুদ্ধ শেষ হলেই সব সমস্যা সমাধান হয়ে যায় না বরং ক্ষমতায় টিকে থাকার লড়াই নতুন করে আবার যুদ্ধের দিকে নিয়ে যায়। তালেবানেরও একই অবস্থা, গদি দখল করতে পারলেও তাদের এখনো বাকি আছে আন্তর্জাতিক সমর্থন, পাশাপাশি নিষেধাজ্ঞার কবলে বিপর্যস্ত অর্থনীতি একটি সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এমন পরিস্থিতিতে আফগানিস্তান কি যে কোনো এক বলয়ের দিকে নির্ভার হয়ে থাকতে পারবে নাকি তাদের ছুটতে হবে পুরোনো শত্রুর দোয়ারে? চীনের সমর্থনপুষ্ট পাকিস্তান কি এসব শুধুই তাকিয়ে দেখবে ,উত্তর না হলে আফগানিস্তানকে ঘিরে আরো জটিল হবে এই অঞ্চলের রাজনীতি।
মধ্যপ্রাচ্য
সমস্যাসঙ্কুল মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে সংঘাতের এমনিতেই অন্ত নেই, নতুন বছরে নতুন আরেকটি যুদ্ধের ভার কি তারা নিতে পারবে? সবকিছু নির্ভর করছে একটি ঘটনার উপর, পরমাণু আলোচনার কি পরিণতি হবে ভিয়েনায়? মধ্যপ্রাচ্যে সমস্যা অনেক কিন্তু ঘুরেফিরে সবকিছুর মূলে এক-দুইটা দেশই, তবে এসবের গোড়াপত্তন বলা যায় ইসরায়েলকে ঘিরেই, ফিলিস্তিন সংকট মোকাবিলায় অতীতে ইসরায়েল বিরোধী অবস্থানে ছিলো প্রায় সব আরব দেশগুলোই।
তবে সেই ধারা ভেঙে মরুর দেশগুলো ছুটছে ইসরায়েলের সাথে মিত্রতার দিকে বিপরীতে দিনে দিনে আরো কঠোর অবস্থানে হাঁটছে ইরান, এখান থেকেই পরমাণুর উত্থান। ইরানের পরমাণু কর্মসূচী রুখতে ২০১৫ সালে চুক্তিতে উপনীত হয়েছিল ইরান ও বিশ্বের ক্ষমতাধর ৬ রাষ্ট্র, পরমাণু কর্মসূচী থেকে সরে আসার ফলে ইরান আবার অর্থনীতিকে পুনর্গঠনের সুযোগ পেয়েছিল তবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময়ে ২০১৮ তে যুক্তরাষ্ট্র বেরিয়ে যায় চুক্তি থেকে। এখন বাইডেন আমলে বিশ্ব নেতারা আবার চাইছেন ইরানকে চুক্তিতে ফেরাতে, দু'পক্ষের মধ্যে ভিয়েনায় এখন চলছে ৮ম রাউন্ডের আলোচনা। এর অগ্রগতি কি হবে তার উপর ঝুলে আছে মধ্যপ্রাচ্যের আগামী দিনগুলোর পরিস্থিতি, একদিকে ইসরায়েলের যুদ্ধংদেহী মনোভাব অপরদিকে পুরো আরব ভূখণ্ড জুড়ে ইরানের 'প্রক্সি ওয়ারফেয়ার'। দু'পক্ষের মধ্যে কোন ধরনের ঐক্যমত্য গঠন না হলে তার পরিণাম ভোগ করতে হবে সবাইকেই।
পূর্ব ইউরোপ
রাশিয়ার দৃষ্টিতে পূর্ব ইউরোপ তাদের নিজস্ব বলয়, একই কারণে তারা এই অঞ্চলে তাদের শত্রু পক্ষের উপস্থিতিকে সবসময় সন্দেহের চোখে দেখে। ইউক্রেনের সাথে রাশিয়ার যাবতীয় সমস্যার আদ্যোপান্তও এটা। দেশ দুটির মধ্যে পানি বন্টন থেকে বিদ্রোহীদের মদদ দেওয়ার মত বিষয়ে উত্তেজনা বিরাজ করলেও মূল সমস্যা ইউক্রেনের পশ্চিমের দিকে ছুটা নিয়ে। এ বছরের শুরুর দিকে ধারণা করা হচ্ছে রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালাতে পারে, যেটা কারো জন্যই বৃহত্তর স্বার্থে মঙ্গলজনক হবে না তবে ইতোমধ্যে আলোচনার খবর আসছে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে রাশিয়ার। নতুন একটি যুদ্ধ বাধলে সেখানে জড়াতে হবে ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্রকে, করোনায় বিপর্যস্ত ইউরোপ এমন পরিস্থিতি এড়াতে চাইলেও ইউরোপকে এই সমস্যা নিয়েও ব্যস্ত থাকতে হবে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া
তূলনামূলক শান্ত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আসিয়ান জোটের দেশগুলোর মধ্যে আগামী বছর অন্তঃর্দ্বন্দের সম্ভাবনা খুব কম থাকলেও মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি ঝামেলায় ফেলতে পারে জোটের সদস্যদের। ভূরাজনৈতিক কারণে কম গুরুত্বপূর্ণ রোহিঙ্গাদের বেলায় মিয়ানমারের জান্তারা কুলিয়ে উঠতে পারলেও এবার নিজেদের মধ্যে গৃহ যুদ্ধে পরিস্থিতি টালমাটাল। ২০২১ সালের শুরুর দিকে সূচির ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি ৮০ শতাংশ ভোট পাওয়ার পরেও ক্ষমতা না ছেড়ে অভ্যুত্থান ঘটায় তাতমাদৌ। সংখ্যাগরিষ্ঠ বার্মিজরা এতোদিন সেনাবাহিনীর জাতিগত নিধনে মৌন সম্মতি দিয়ে আসলেও নিজেদের বেলায় ঠিকই প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, এনএলডি অন্যান্য বিরোধীদের সাথে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছে জাতীয় ঐক্যমতের সরকার যাদের সামরিক শাখা বার্মার অন্যান্য জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনকে সাথে নিয়ে গঠন করেছে পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ), বিভিন্ন ফ্রন্টে প্রায়ই এদের সাথে তাতমাদৌর যুদ্ধের খবর পাওয়া যায়। খোদ আসিয়ান সহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংগঠনের প্রতিবাদ প্রতিরোধের মুখোমুখী হতে হচ্ছে মিন অং হ্লাইং সরকারকে, অন্যদিকে ফ্রান্সের মত দেশের কাছ থেকেও স্বীকৃতি পেতে শুরু করেছে জাতীয় ঐক্যমতের সরকার, তবে চীনের ভূমিকাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ যারা সমর্থন দিচ্ছে জান্তা সরকারকে। স্পষ্টতই প্রতীয়মান বিশ্ব মোড়লদের নিজেদের স্বার্থের খেলায় লম্বা হচ্ছে আরেকটি সমস্যা।
দিনশেষে সবখানেই সরব উপস্থিতি আছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের, সেই বিবেচনায় বলা যায় তাদের মধ্যে যে সিংহাসনের লড়াই চলমান তারই অংশ হতে চলছে এ বছরের বিশ্ব রাজনীতি, এই ছোট-বড় দ্বন্দ্ব সংঘাত গুলোর পরিণতিই বছর শেষে বলে দিবে কারা হাল ধরবে মহামারি পরবর্তী বিশ্বের।
লেখক: আল মাসুম সাকিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী