আমরা কেন বনভূমি ধ্বংস করে সাফারি পার্ক বানাই
অমানুষগুলো দেখতে অবিকল মানুষের মত- এই হেডলাইন এবং সাথে ছবিটা দেখে ভেবেছিলাম লেখাটি পড়বো না। পড়েও মনে হল, না পড়াই ভাল ছিল, কেন পড়লাম? বাচ্চা হাতির উপর নির্মম নির্যাতনের কথা পড়ে খুব কষ্ট পেলাম।
একদল লোক হাতির বাচ্চাটিকে ২-৩ মাসব্যাপী 'প্রশিক্ষণ' এর নামে নানা কলাকৌশল শেখাতে গিয়ে নির্মম নির্যাতন চালায়। এ সময় হাতিটি শৃঙ্খলমুক্ত হতে জোর চেষ্টা চালায়, শুড় উঁচিয়ে কাতরায়। কখনও নির্যাতনে হাতি শাবক মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, তবুও নির্যাতন থামে না। সাতজনের হাতে থাকা সাতটি লোহার রড দিয়ে অবিরাম খোঁচানো হয় হাতি শাবককে। এই নিষ্ঠুর প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার নাম 'হাদানি'।
শুধু বশ মানানোর জন্য ও পরে এদের ব্যবহার করার জন্য, মায়ের কাছ থেকে বাচ্চা হাতিকে বিচ্ছিন্ন করে অসম্ভব অত্যাচার করা হয়। যদিও মৌলভীবাজার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট পোষ মানাতে হাতির বাচ্চা নির্যাতন বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সেই অমানুষরা কি থামবে?
জুড়ীতে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে পোষ মানাতে হাতি শাবককে মান্ধাতার আমলের নিষ্ঠুর নির্যাতন বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। পশুর প্রতি এ ধরনের নিষ্ঠুর আচরণ কেন কর্তৃপক্ষের নিস্ক্রিয়তায় বেআইনি হিসেবে গণ্য হবে না এবং একই সঙ্গে কেন তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না-এই মর্মে তিনি স্বপ্রণোদিত হয়ে কারণ দর্শানোর নির্দেশও দিয়েছেন।
গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে সাতদিনে মারা গেল ১১টি জেব্রা, একটি সিংহী এবং একটি বাঘ। কেন এই অবুঝ প্রাণীগুলো আমাদের তত্ত্বাবধানে থেকে মারা গেল? এর কোন উত্তর পাওয়া যায়নি। ওখানকার দায়িত্বপ্রাপ্তরা একেকবার একেক কথা বলছেন। বলছেন এনথ্রাক্স, ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ বা কর্তৃপক্ষের অবহেলা। তদন্ত কমিটিও গঠিত হয়েছে।
ইতোমধ্যে মন্ত্রী দলবলসহ পরিস্থিতি দেখতে গিয়েছিলেন। প্রাণীকুলের দুঃখ-ভারাক্রান্ত ও হাড় জিরজিরে চেহারা দেখে মন্ত্রী মহোদয় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এবং মাংসের বদলে হাড্ডি কেন দেয়া হয়েছে এ নিয়ে কথা বলেছেন বলেও গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
অন্য চিড়িয়াখানাতেও বাঘ,সিংহ মারা গেছে। কোন কোন ক্ষেত্রে এদের মৃত্যুর খবর গোপনও করা হয়েছে। এই প্রাণীদের মৃত্যুর কোন নির্দিষ্ট কারণও জানা যায়নি। আমরা মনে করি, এখানেও বিচার বিভাগীয় তদন্ত হওয়া উচিৎ এবং আদালতের স্বপ্রণোদিত হয়ে কারণ দর্শানোর নির্দেশ দেয়া উচিৎ।
একটার পর একটা পশুর মৃত্যুতে দেশের সাফারি পার্কের মান, প্রাণীদের খাবার ও চিকিৎসকের মান, সার্বিক তত্ত্বাবধানের দুর্বলতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যদিও আমাদের মন্ত্রী মহোদয় তদন্তের মাঝখানে মন্তব্য করেছেন যে, ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে প্রাণীগুলো মারা গেছে। কিন্তু কিভাবে উনি এটা তদন্তের মাঝখানে বললেন? এর পিছনে তার যুক্তি আছে কি? আর ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ কী এমন জিনিস, যা ঠেকানো যাবে না? কেন এতগুলো প্রাণীকে মারা যেতে হলো?
জুড়ীতে যখন হাতির বাচ্চাকে অমানবিক অত্যাচার করে বশ করার কথা ছাপা হলো, ঠিক সেরকম একটা সময়েই দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় ছাপা হলো, ৮৪৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা সম্ভাব্য ব্যয় ধরে মৌলভীবাজারের জুড়ীতে এক সাফারি পার্কের মহাপরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে বন অধিদপ্তর।
জুড়ীতে লাঠিটিলা সংরক্ষিত বনের এলাকায় ওই পার্কে মূলত বিদেশি প্রাণী আনা হবে। মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, সাফারি পার্কটিতে বন্য প্রাণী বাবদ ২০৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এর মধ্যে শুধু বন্য প্রাণী কেনা বাবদ রাখা হয়েছে ১৮২ কোটি টাকা। এত টাকা দিয়ে বিদেশি প্রাণী এনে তাদের হত্যা করার অধিকার আমাদের কে দিয়েছে?
যেখানে সাফারি পার্ক তত্ত্বাবধানে আমরা ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছি, সেখানে আবার সাফারি পার্ক স্থাপন করতে হচ্ছে কেন? তাও সংরক্ষিত বনের এলাকায়। কেন এদেশের দুর্বল ব্যবস্থাপনা, দুর্বল চিকিৎসা ব্যবস্থা, যথাযথ খাদ্যসামগ্রীর অভাব, দুর্নীতি ও যত্নআত্তির অভাবের মধ্যে বিদেশি গাছ, বিদেশি প্রাণী আনতে হবে? আমাদের চিড়িয়াখানাগুলোতেও পশুপাখিরা যেভাবে আছে, তাও খুব সুখকর নয়।
এ প্রসঙ্গে পরিবেশবিদ সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানও বলেছেন, আমাদের দেশি বনে বিদেশি পশু আনার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ২০২১ সালে বাংলাদেশে ৩২টি হাতিকে হত্যা করা হয়েছে। হাতির চলাচলের পথকে কৃষিজমিতে রূপান্তর করা হয়েছে। এটি একটি কালো অধ্যায়।
পশুপাখি, প্রকৃতি এগুলো সবই হচ্ছে ভালবাসার ধন। ভালো না বাসলে এরা বাঁচে না, বাঁচলেও কষ্টে থাকে, অনাদরে, অবহেলায় থাকে। আর আমাদের দেশে প্রকৃতিকে ভালবাসে খুব কম কিছু মানুষ। আমরা প্রকৃতি ধ্বংস করে উন্নয়নের পক্ষে। সরকার এবং জনগণ দুইপক্ষই বিশ্বাস করে উন্নয়নের জন্য সব করা যায়। আর তাই সরকারের বন ব্যবস্থাপনা কর্মসূচিতে বন রক্ষার বিষয়টি নাই। সেখানে গাছ , পানি, বন্যপ্রাণী, খাদ্য ও প্রয়োজনীয় সুবিধাদির কোন বন্দোবস্ত নেই।
আমরা যতোই জলবায়ু পরিবর্তন, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ, সাফারি পার্ক ইত্যাদি নিয়ে কথা বলি না কেন, বাংলাদেশে যখন পশুপাখির প্রতি নির্দয় কোন আচরণ করা হয়, বা যখন কোন বনাঞ্চল ধ্বংস বা দখল করা হয়, তখন দেখিনি যে রাষ্ট্রীয় পর্যায়, ব্যবসায়ী মহল, রাজনীতিবিদ, আমলা, তারকা বা অন্য পেশাজীবীরা কেউ এ নিয়ে কোন উদ্বেগ বা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এবং অপরাধীর বিচার দাবি করেছেন।
রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকেও তেমনভাবে বিচারের আশ্বাস দেয়া হয় না। এ ব্যাপারে আইন থাকলেও কাউকে সেভাবে শাস্তিও পেতে দেখিনি। গণমাধ্যমে সংবাদ হয়, সামাজিক মাধ্যমে সামান্য কিছু হৈচৈ হয়, বন্যপ্রাণী সংরক্ষকরা দুঃখ প্রকাশ করেন, বনবিভাগ তৎপর হয়- ব্যস তারপর সব শেষ।
সেদিন পরিবেশবাদী একজনের স্ট্যাটাসে দেখলাম, বন্যপ্রাণীর জন্য সুন্দরবনের একটি প্রাইম এলাকা কচিখালি, ব্যক্তির হস্তগত হয়ে গেছে। এটি একটি সংরক্ষিত এলাকা এবং আইনগতভাবে ঘোষিত অভয়ারণ্য। এই এলাকায় একটি গাছ ঝড়ে পড়ে গেলে সেটির অপসারণও নিষিদ্ধ।
অথচ সরকার ঘোষিত সেই অভয়ারণ্য এলাকায় এই সাইনবোর্ডটি শোভা পাচ্ছে যেটিতে দেখা যাচ্ছে, ১২ একর এলাকায় 'ব্যক্তিগত উদ্যোগে তৈরি' এই ঘোষণাটি। কেন এবং কোন আইনে একজন ব্যক্তি একটি সংরক্ষিত বনে ব্যক্তিগত উদ্যোগে একটি এলাকাকে নিয়ে নিতে পারেন, সেই রেফারেন্সটি এই ফলকটিতে দেওয়া উচিত ছিল।
বিশাল ফলকটিতে বড় আকারে লেখা 'হাবিব গ্রুভ'। বিষয়টা এমন যে এটা এলাকাটার নাম। সুন্দরবন যে ধরণের বন তাকে ইংরেজিতে বলা হয় 'ম্যানগ্রোভ'। সেটার ত্রুটিপূর্ণ বাঙালি উচ্চারণ অনেকে করে থাকে 'ম্যানগ্রুভ'। সেই ম্যানগ্রুভের 'গ্রুভ' থেকেই নাম হয়েছে 'হাবিব গ্রুভ'।
আমরা জানি, বনটি জনগণের এবং এবং মাসিক বেতনের বিনিময়ে এটা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সরকারি কর্মকর্তাদের। তাহলে একজন ব্যক্তি বন দখল করে নিতে পারে কেমন করে?
আমাদের বনবিভাগের দায়িত্ব হল দেশের স্থানীয় বা ইনডিজিনাস বন ও বন্যপ্রাণী রক্ষা করা। কিন্তু আমরা দেখছি তারা নানা জায়গায় কংক্রিটের বাঘ, হরিণ বানাচ্ছে। আর দেশের বায়ো-ডাইভারসিটি ধ্বংস করে বিদেশি বন্যপ্রাণী ও গাছ কিনে সাফারি পার্ক বানিয়ে দেশকে চিড়িয়াখানায় রূপান্তর করার অপচেষ্টা করছে।
বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, "আমাদের উন্নয়নের ন্যারেটিভকে প্রশ্ন করতে হবে। ২৯টি নদী বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত, আমাদের বাতাস বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বাতাস, আমরা সবচেয়ে অবসবাসযোগ্য নগরীতে বসবাস করি। তার মানে আমাদের ওপর যে উন্নয়ন চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তা আমাদের ইচ্ছা অনুযায়ী নয়। এতে আমাদের কোনো অংশগ্রহণ নেই, আমাদের জেলের নেই, কৃষকের নেই সেটি আমাদের বুঝতে হবে।"
শুধু কি সুন্দরবন দখল? মধুপুরের গারোদের যদি জিজ্ঞাসা করা হয় তাদের নিজেদের জায়গায় যে জাতীয় উদ্যান করা হয়েছে, এতে তারা খুশি নাকি? জাতীয় উদ্যান বানিয়ে, এর চারপাশে যে কংক্রিটের দেয়াল দেয়া হয়েছে, তাতে করে এই জমির আদি মালিকরাই আর এখন আর ঢুকতে পারে না। এই জমির অধিকারের জন্য পেটোয়া বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন গারো নেতা।
সিলেটের দিকে গেলে পাবেন খাসিয়াদের। যেখানে খাসিয়াদের জায়গা নিয়ে নেয়া হয়েছিল ইকো পার্ক করার জন্য। এখানে খাসিয়াদের জীবনের প্রতি হুমকি দেয়া হয়েছিল যে, জমি না পেলে তাদের মেরে ফেলা হবে। ইকো পার্কে পর্যটকরা বেড়াতে আসবেন, শুধু এই জন্য এই এলাকার স্থায়ী বাসিন্দারা তাদের জায়গা দিতে রাজি ছিল না। কিন্তু ঠেকাতে পারলো কই। চাকমা, মার্মা, ম্রো, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা প্রত্যেকের ভিতরে আলাদা আলাদা দুঃখবোধ রয়েছে। আরো ছোট ছোট গোত্রগুলোকে জিজ্ঞাসা করলে পাবেন আরেকধরণের দুঃখ।
অপরিকল্পিত উন্নয়নের মাধ্যমে প্রকৃতি ও পরিবেশের ওপর নির্বিচারে অত্যাচার চালানো হচ্ছে। আমরা যেন বুঝতেই পারছিনা যে, পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে যে উন্নয়ন তা আমাদের নয়। আর তাই পরিবেশ বিষয়ক নানারকম আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় বাংলাদেশের অবস্থান খুবই নিচের দিকে থাকে। এই কালিমা নিয়েই আমরা একটির পর একটি বনভূমি ধ্বংস করবো ও সাফারি পার্ক বানাবো।
- লেখক: সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন