পুকুর-কুয়ো-কল, এই তিনে জল + বন্যার পানি
গত সংখ্যাগুলোতে পুরোনো দিনের গল্প করায় একটি বিষয় বুঝলাম। তা হলো, আমার এই লেখার মাধ্যমে শুধু আমি নই, অনেক মানুষই তাদের পুরোনো দিনগুলোতে ফিরে যেতে পারছে। লেখার আগে সত্যিই ভাবিনি এতটা সাড়া পাবো! শুধু দেশের ভেতরেই নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে যেভাবে মানুষের প্রতিক্রিয়া, ফেসবুকে কমেন্ট, মেসেজ, ইমেইল এসেছে তাতে সত্যিই আমি মুগ্ধ।
আমার বন্ধুবান্ধবরা তো লিখছেই সে-ই সঙ্গে ছবি পাঠাচ্ছে, আমার ভুলগুলো ধরিয়ে দিচ্ছে। নতুন তথ্য যোগ করে দিচ্ছে। সবচেয়ে ভালো লাগছে যে, যারা বাংলাদেশে একসময় থাকতেন এবং বর্তমানে প্রবাসে আছেন, তারা লেখাগুলো পড়ার পর আমাকে চিঠি লিখছে। তার মানে এই লেখাগুলো অনেকের স্মৃতিতেই একটু একটু করে নাড়া দিচ্ছে।
তাই সবার প্রথমে ধন্যবাদ জানাই দ্য বিজনেস স্টান্ডার্ড পত্রিকার অনলাইন বাংলাকে এবং বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাই লেখক আলমগীর হক স্বপনকে। যিনি আমার লেখা রিপোস্ট করেছেন ফেসবুকে।
সবাইকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানিয়ে, স্মৃতির ঝুলি থেকে আরও কিছু গল্প নিয়ে লিখতে বসেছি আজ। তবে, যেহেতু আগ্রহ দেখেছি অনেক, তাই গত লেখা নিয়ে আরও কিছু তথ্য এখানে যুক্ত করছি।
আমার এক বন্ধু শাহেদ রহিম জানিয়েছে, ম্যাগনোলিয়া আইসক্রিম নামে একধরনের আইস্ক্রিম ছিল তখন। আমি নিজে সেই আইসক্রিম কখনো খাইনি। তবে ৫৬/৫৭ সালের দিকে এই আইসক্রিম পাওয়া যেত।
আরেকজন লিখেছে, কুলফির হাঁড়িতে পেঁচানো ঐ লাল কাপড়ের কথা এখনো তার মনে পড়ে। তবে এখনও নাকি লাল কাপড়ে মোড়ানো হাঁড়িতেই কুলফি বিক্রি হয়। তার মানে বোঝা যাচ্ছে, এই লাল কাপড়ের সিলসিলা আছে কুলফির সঙ্গে।
আমাদের স্মৃতিতে কুলফি বিশাল এক জায়গা জুড়ে আছে! কুলফির স্মৃতি আমাদের ঢাকাবাসীকে এক করে রেখেছে এখনও।
আলমগীর হক স্বপন একটি পাঠিয়েছিল। কাঠের একটি বাক্স থেকে আইসক্রিমওয়ালা আইসক্রিম বের করে দিচ্ছে। এভাবেই আগে আইসক্রিম বিক্রি হতো।
হারুন কোম্পানির বেবি আইসক্রিম ছিল খুব নামকরা। নায়ক হিসেবে হারুনও ছিলেন অনেক বিখ্যাত। সে সুযোগে আমি হারুনকে নিয়ে আরেকটি স্মৃতিচারণ করি।
সুপারস্টার হতে পারতাম!
মহিউদ্দীন আহমেদ (মোহাম্মদ মহিউদ্দীন নামেই বেশি পরিচিত) পরিচালিত 'গোধুলীর প্রেম' সিনেমার শুটিং আমাদের বাসায় হয়েছিল। আমাদের বাসাটা ছিল দোতালা, গাছগাছালিতে ঘেরা একটি বিশাল বাড়ি। আগেকার দিনে ঢাকার দোতালা বাড়িগুলো যেমন হতো, তেমন। মনে আছে, বড় একটা লাল বোগেনভিলিয়া ফুলের গাছ ছিল। এমনকি বাড়ির নামও হয়ে গেছিল বোগেনভিলিয়া বাড়ি। ছিল কৃষ্ণচূড়ার গাছ।
যা-হোক, সিনেমার শুটিং শেষ হবার কিছুদিন পর, মহিউদ্দীন আহমেদ এবং চিত্রা সিনহা এলো আমাদের বাড়িতে। তারা বাবাকে জানালেন যে, পরবর্তী সিনেমা 'ইয়ে ভি এক কাহানি'তে নায়ক হারুনের ছোটোবেলার চরিত্রের জন্য আমাকে তাদের পছন্দ হয়েছে।
কিন্তু আমার বাবা না করে দিলেন। তখন বাবা রাজি হলে, এখন হয়তো এই গবেষক, সাংবাদিক না হয়ে নামকরা সুপারস্টার হতে পারতাম!
নায়ক-নায়িকারা তখন স্টার বনে যেতেন না!
আর এই মহিউদ্দীন আহমেদ খুব সজ্জন ব্যক্তি ছিলেন। আমার বাবা ছিলেন অনেক নাকউঁচু স্বভাবের একজন মানুষ। তিনি সবার সঙ্গে মিশতেন না, কিন্তু আমার বাবা অনেক পছন্দ করতেন মহিউদ্দিন আহমেদকে।
চিত্রা সিনহা (পরবর্তীতে সিনেমা পরিচালক কাজী জহিরকে বিয়ে করে চিত্রা জহির, বিয়ের পর খুব সম্ভবত চিত্রা জহির অভিনয় ছেড়ে দেন) আমাদের দুই তিন বাড়ি পরে থাকতেন। তখনকার সময়ে সিনেমার লোকজনদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের একধরনের সামাজিক নৈকট্য ছিল। এখন তো নায়ক-নায়িকা মানেই স্টার, তখন এতটা স্টার ভাব ছিল না। আমার মাকে আমি নিজের চোখে চিত্রা সিনহার সঙ্গে গল্প করতে দেখেছি।
অন্য একজন অভিনেতা ছিলেন আমিনুল হক, তিনি পরে কোথায় হারিয়ে গেছেন জানিনা। আরেকজন ছিলেন সোনা মিয়া, তিনি বাংলা সিনেমার কমেডিয়ান ছিলেন। তখন আমাদের বাড়িতে, চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক এবং নায়িক-নায়িকাদের আসা যাওয়া। এখনকার মতো নায়ক নায়িকার দেখা পেলে সেসময়ে এত ভিড় হতো না।
এই হলো ষাট দশকে আমাদের বাড়িতে নায়ক-নায়িকা আর সাধারণ মানুষের চিত্র।
প্রথম ক্যামেরা চালিয়েছিলাম সিনেমার শুটিংয়ে
ঐ সিনেমার ক্যামেরাম্যানের নাম ছিল সাধন রায়। এখন তিনি কই আছেন জানিনা, কিন্তু খুব ভালো মানুষ ছিলেন। আমার সঙ্গে খুব খাতির ছিল, অনেক আদর করতেন আমাকে। আমাকে একবার জিজ্ঞেস করলেন, 'তুমি কি ক্যামেরা চালাবে? আমিও চেষ্টা করেছিলাম ক্যামেরা চালানোর। ওটাই আমার প্রথম ক্যামেরা চালানোর প্রচেষ্টা।
পুকুর কুয়ো কল, এই তিনে জল
আমরা থাকতাম টিকাটুলির ১০ নম্বর অভয়দাশ লেনে। কিছুটা এগিয়ে গেলেই 'তারাবাগ'। সম্ভবত তারাবিবির নামে কেউ ছিলেন, সেখান থেকেই জায়গাটির নামকরণ এমন। ওখানে একটা সাইনবোর্ডের মতো ছিল, তারা তারা লাগানো। ওখানেই থাকতেন কবি সিকান্দার আবু জাফর।
ভিতরের দিকে আমার নানাদের বাড়ি ছিল, সুফিয়া কামালদের বাড়িও ওখানেই ছিল। ওখানে বড় একটা পুকুর ছিল। আমার নানাভাইরা কিন্তু ঐ পুকুরের পানিই খেতেন। শহরে থেকে পুকুরের পানি খাচ্ছে, এমনটা ভাবা যায়? কিন্তু তখন মধ্যবিত্তদের মাঝেও পুকুরের পানি খাওয়ার চল ছিল। আমার মনে আছে কীভাবে হাত দিয়ে পুকুরের পানিটা সরিয়ে নিয়ে, তারপর পরিষ্কার পানি তুলে নিতো। কেউ এই পানি খেয়ে অসুস্থ হয়েছে, এমনটা আমার মনে পড়ে না। তারমানে পুকুরের পানি পরিষ্কার ছিল তখন। এখন এমনটা হলে তো সবার পেট খারাপ হয়ে, বিভিন্ন রোগ বেঁধে যেত।
কুয়োর ভিতরটা দেখার শখ হতো!
আরেকটি হলো কুয়ো। কুয়ো দু'রকম ছিল। সব বাড়িতে একটা কুয়ো থাকতো। ইংরেজিতে একে বলে, ডাগওয়েল।
আমাদের বাড়ির পেছনে একটা কুয়ো ছিল। তবে আমরা কুয়োর পানি খেতাম না, পুকুর দূরে হওয়ায় পুকুরের পানিও খেতাম না। তবে, আমার দুটো স্মৃতি আছে কুয়োটাকে নিয়ে।
কুয়োর নিচে কি আছে সেটা দেখার জন্য আমার আগ্রহ ছিল প্রবল। আমাদের কুয়োটা আবার ঢাকনা দিয়ে রাখা হতো, যেন রাতেরবেলা হাঁটতে গিয়ে কেউ পড়ে না যায়। আমার আবার স্বভাব ছিল ধুপধাপ পড়ে যাবার। কতবার কতজায়গায় যে পড়েছি!
একবার শুধু কুয়োটা ভালো করে দেখার শখ মিটেছিল। কুয়ো পরিষ্কার করার লোক এসেছিল, তখন আমার মামা আমাকে কোলে করে নিয়ে গিয়েছিলেন কুয়োর কাছে।
আমার স্পষ্ট মনে আছে, পরিষ্কার করতে লোকটা কীভাবে কুয়োতে নামলো! এ-পায় ভর দিয়ে ও-পায়ে ভর দিয়ে, এভাবে এ-পা ও-পা করে নিচে নেমে চলে গিয়েছিল। তারপর উপরে যে দাঁড়ানো থাকে, সে বালতিতে করে পানি দড়ি দিয়ে টেনে টেনে উঠায় এবং বাইরে ফেলে দেয়।
আমি একটি গবেষণার রিপোর্ট দেখছিলাম, কুয়োর পানি নাকি পরিষ্কার হয়। আমরা ভাবি কুয়োর মধ্যে যেহেতু মানুষ ময়লা ফেলে, তাই ভীষণ নোংরা হবে সেই পানি। কুয়োকে তাই নোংরাই মনে হয় আমাদের কাছে। তবে, বাড়িঘরগুলোতে যে কুয়োগুলো ছিল, তা ছিল পরিষ্কার। লোকে বলতো কুয়োর পানি সবচেয়ে পরিষ্কার।
বছর দশেক আগের এক গবেষণায় দেখলাম, বুড়িগঙ্গার পানির চেয়ে পরিষ্কার কুয়োর পানি।
মিউনিসিপ্যালিটির কলের পানি
আরেকটি জায়গার পানি আমরা খেতাম, তা হলো মিউনিসিপ্যালিটির কলের পানি। ঢাকার মানুষ একসময় এই মিউনিসিপ্যালিটির কলের পানি খেত। এজন্য লাইন ধরে দাঁড়াতে হতো তাদের। সৌভাগ্যক্রমে আমাদের বাড়ির উল্টোদিকে ছিল পানির কল।
ঢাকার শহরের মানুষদের জন্য তখন ভালো আর নিরাপদ পানি সংগ্রহ করাটা ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। এখন আমরা পানিকে একধরনের 'টেকেন ফর গ্রান্টেড' হিসেবে নিয়ে নিয়েছি। কিন্তু একসময় পানির জন্য অনেক অপেক্ষা করতে হতো। সেই নিরাপদ পানি সংগ্রহের জন্য লোকজন জমা হতো। আমাদের বাড়িতে যারা কাজ করতেন, তারা সকালবেলা গিয়েই কলসি ভরে পানি নিয়ে আসতো। আমরা এই কলের পানিই খেয়েছি।
পরবর্তীতে ৫৭ -৫৮ এর দিকে বাড়ির ভিতর আমাদের নিজেদের একটি কল ছিল।
ঢাকার মানুষদের পানি খাওয়ার এই তিনটা উৎস ছিল তখন। কিন্তু আমার সৌভাগ্য হয়েছিল চারটি জায়গার পানি খাওয়ার!
আমি খুব শান্ত শিষ্ট স্বভাবের হলেও, দুষ্টুমি একেবারে করতাম না, তা নয়। একবার আমি কী মনে করে যেন, কল ছেড়ে কলের মুখে একটা লাঠি ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম। আর ওমনি পানি ছিটকে চারপাশের মানুষের শরীর গেল ভিজে। লোকজন চিৎকার করতে শুরু করলো, আমি এই ফাঁকে দিলাম একটা ভোঁ-দৌড়। তবে ভয় থেকে দৌড় দিলেও, মজা পেয়েছিলাম খুব। ঐ প্রথম মানুষকে উত্যক্ত করার মজাটা পেলাম। অন্যকে উত্যক্ত করার পেছনে যে কত আনন্দ, তা আমি সেবারই বুঝলাম! এরপর বিভিন্নভাবে বিভিন্নজনকে উত্যক্ত করতাম। এমনি একটি কাহিনী দিয়ে আজ লেখা শেষ করবো।
খেয়েছি বন্যার পানিও…
৫৬ সালে ঢাকায় বিশাল এক বন্যা হয়। ৫৭ সালেও হয়েছিল, কিন্তু ৫৬ সালের বন্যা ছিল অনেক ভয়াবহ। বাড়ির ভেতরে বন্যার পানি। মাছেরা ভেসে বেড়াতো, সেই পানিতে।
যা-হোক, আমার মনে আছে আমার মামা এসেছিল তখন বাড়িতে। সে-বার, আমার মামা কাবলি জুতো পরে এসেছিলেন। আমি ভাবলাম, এই কাবুলি জুতোটাকে পানিতে ফেলে দিলে কেমন হয়!
তিন চার বছর বয়স, কেন এই আজব চিন্তা আসলো মাথায়, জানিনা। আমি এক লাত্থি মেরে একটা জুতো ফেলে দিলাম বন্যার পানিতে। তারপর যখন অন্যটাকে ফেলার সময় এলো, তখন আমি নিজেই পড়ে গেলাম ঐ পানিতে। পানিতে পড়ে শ্বাসটাঁস বন্ধ হয়ে একাকার অবস্থা। পরে মামা আর অন্যরা মিলে আমাকে টেনে তুললেন। তাই এখন মজা করেই বলি, আমি বন্যার পানিও খেয়েছি জীবনে! তাই আমার সময়ের লোকজন তিন উৎস (পুকুর, কুয়ো আর কলের পানি) থেকে পানি খেলেও, আমার রয়েছে চাররকম উৎসের পানি খাওয়ার অভিজ্ঞতা!
লেখক: গবেষক ও সাংবাদিক