আমির হামজাকে পুরস্কার দিয়ে সরকার কি আসলেই তৃণমূলের সাহিত্যসেবীদের তুলে আনল, না কি সংকট অন্যখানে?
রইজ উদ্দিন আহম্মদের কথা নিশ্চয়ই ভুলে গেছেন? তাকেও স্বাধীনতা পুরস্কার দিয়ে পরে প্রত্যাহার করা হয়েছিল। রইজ উদ্দিন আহম্মদের লেখা একটি বই আমি একবার ফুটপাত থেকে কিনেছিলাম। তা হলো "কুমড়ী গ্রামের ইতিহাস ও ঐতিহ্য"। একটা গ্রামের ইতিহাস কেন লিখতে হয়, এমন একটা বইতে কী কী মেলে, সেই রকম কৌতূহল থেকেই কেনা। ভদ্রলোকের কবিত্বশক্তিরও কিছু নমুনা সেখানে মেলে। ভদ্রলোক সরকারি কর্মকর্তাও ছিলেন, ২০২০ সালে খুলনা বিভাগীয় উপ-ভূমি সংস্কার কমিশনারের পদ থেকে অবসরে গেছেন।
মুশকিল হলো কী, এই ভদ্রলোক যিনি নিভৃত অঙ্গনে সাহিত্য বা ইতিহাস চর্চা করেছেন, সাহিত্য বিষয়ে তিনি নিজেকে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদকটি পাবার যোগ্য মনে করতেই পারেন। তিনি যদি এই বিষয়ে তার সহকর্মীদের কাছে নিজের মনোবাসনা প্রকাশ করেও থাকেন, তাতেও অন্যায় কিছু নেই। বরং একটা মানুষকে পুরস্কার দিয়ে সেটা প্রত্যাহার করে নেওয়ায় তার প্রতি খানিকটা সহানুভূতিই তৈরি হয়েছিল।
কথা হলো এই যে, এইখানে একমাত্র গর্হিত অপরাধটা তাদের, যারা এই মনোনয়ন বাছাই ও চূড়ান্ত করার কাজটা করে থাকে। অদক্ষ অযোগ্য এবং সাহিত্য বিজ্ঞান বা ইতিহাসের সাথে ন্যূনতম সম্পর্ক নেই এমন লোকজনের মাঝে যখন এই দায়িত্বটা যায়, তখন যোগ্যদেরও ধরাধরি করে এই পুরস্কার পেতে হয়। বিষয়ের গভীরতা পরিমাপ করার কোনো যোগ্যতা যখন পুরস্কারদাতাদের থাকে না, তখন নিতান্তই স্বজনপ্রীতির বশে প্রথম দিকে অনুল্লেখ্যরা, তারপর একদমই হাস্যকর শ্রেণির লোকজনও এইসব পুরস্কার পেতে থাকেন।
কেন? ধরেন এই কাজটা যদি আমলাতন্ত্রের হাতে থাকে এবং যদি ধরেও নেন আমলাতন্ত্রের মাঝে সমাজের অন্য অংশের মতই কিছু শিল্পসাহিত্য বোঝা মানুষ আছে, তবুও দেশের অন্য কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া পরিষদের তুলনায় আমলাতন্ত্রে ভুল সিদ্ধান্তটি নেওয়ার সম্ভাবনা সব চাইতে বেশি। রইজ উদ্দিনের নামটি যিনি প্রস্তাব করেছিলেন, সেই আমলার কোনো অধস্তনের কি সাহস হবে তাকে বলা যে, "মাননীয় মহোদয়, ইনি কোনো কবি নন?" এবং তার উত্তরে সেই জাঁদরেল সচিব যদি বলেন, "কী বললা তুমি! আমি কবিতা বুঝি না? এই রকম কবিতা কোথায় পাবা তুমি:
"গাছ গাছড়ার কথা কি কহিব আর
গাছ বিনা দুনিয়াতে বেঁচে থাকা ভার।
গাছ থেকে বড় বন্ধু আর কেহ নাই।
গাছ হতে খাদ্য আসে অক্সিজেন পাই।"
জানো এই কবিতা কে লিখছেন? রইজ উদ্দিন আহম্মদ লিখছেন! এমন কবিতা তুমি একটা লিখে দেখাও? এক্ষুণি লিখে আমাকে দেখাও! কী সব নাম তোমরা আনছ...এরা কবিতা কেমনে লিখে তুমি জানো? প্রথমে একটা কবিতা নিয়া তারপর কাঁচি দিয়া দুই পাশ কাটে, মাঝখানের কথাগুলার মানে নাই হয়া যায়, সেইগুলাকে এরা কবিতা বলে।"
কিংবা আমলা মহোদয়ের হয়ে আরেকজন, হয়তো আরেকটু মিষ্টভাষী, বললেন, "তোমার সমস্যাটা আমি বুঝেছি, আসলে আমাদের এই একটা কমপ্লেক্স, আমরা এত ভালো এবং লাজুক যে নিজেদের মানুষদের প্রতিভাকে স্বীকার করতে চাই না। সবাই যদি ভাবে ওরা কেন সব পারে! তাই আমরা নিজেদের লুকিয়ে রাখি! কিন্তু আপনি বলুন, সাহিত্য প্রতিভা কী লুকিয়ে রাখবার বস্তু? আমাদের ঘরের লোক বলে তার প্রতিভা উপেক্ষিত থাকবে! এই তার অপরাধ!"
তখন উত্তরে সেই কনিষ্ঠ, সাহিত্যামোদী কর্মকর্তা কী বলবেন! তিনি কি বলবেন যে তার ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়া মামাতো বোনটাও প্রায় এর মতোই কবিতা লেখে?
সেইটা সম্ভব হয় না কখনোই। এমনকি একজন সমপদবীর আমলার সিদ্ধান্তও বড়সড় ক্ষতির কারণ না ঘটলে অন্যজন প্রতিবাদ করার কারণ নেই। সাহিত্যের জন্য পুরস্কার নিয়ে কেন একজন আরেকজনের সাথে বিবাদ করতে যাবেন! এই কারণেই খাঁটি আমলাতন্ত্রের প্রক্রিয়ায় ঘটা বিষয়গুলোতে ছাঁকনিটা সাধারণত বিপরীতমুখী কাজ করে। ভালো সিদ্ধান্তগুলো ওপরের দিকে বাদ পড়তে থাকে, যত ওপরে ওঠে তত কমে যায়।
বুঝতেই পারছেন, এই সাহিত্য পুরস্কার নিয়ে আমার মাথাব্যথা না। আমি বলতে চেয়েছি, শুধু এই প্রক্রিয়াতে যখন জনস্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবহন, বিচারবিভাগসহ সকল বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, প্রায় একই ধরনের গলতি সেখানে হতে থাকে। দুনিয়ার সকল সভ্য দেশে বিশেষজ্ঞরা সুপারিশ করেন, জনপ্রতিনিধিরা সিদ্ধান্ত নেন, আমলাতন্ত্র সেটাকে বাস্তবায়ন করে। সেই প্রক্রিয়ায় নানান সমস্যা থাকতে পারে, কিন্তু এই ভারসাম্য নড়ে গেলে আমলাতন্ত্র একমেবাদ্বীতিয়ম হয়ে যায়।
সাহিত্যিক পরিচয়ে যারা আছেন, তাদের আঁতে ঘা লেগেছে। তারা প্রতিবাদ করছেন, ন্যায্যভাবেই। কিন্তু জনগণ হিসেবে আমাদের আঁতে কবে ঘা লাগবে?
ভালো কথা, যে কথাটা দিয়ে শুরু করেছিলাম; তৃণমূলের সাহিত্যসেবীকে সম্মান দেওয়া হয়েছি কি না? এর উত্তরে এইটুকুই বলা দরকার যে, সকল সমাজের মতোই আমাদের তৃণমূলেও অজস্র সত্যিকারের সাহিত্যামোদী আছেন। যাদের দার্শনিকতা, যাদের সুরের বোধ, যাদের সৃষ্টিশীলতা মুগ্ধ হবার মতো। তাদের অবদানকে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক স্বীকৃতি দিলে এবং তারা তা গ্রহণ করতে সম্মত থাকলে ক্ষতির কিছু নাই।
কিন্তু খোদার দোহাই ভাইয়েরা ও বোনেরা, তৃণমূলের নামে দলীয় অখাদ্যকে সাহিত্য পুরস্কার দেওয়ার ও রাষ্ট্রীয় পুরস্কার প্রদানের দায়িত্ব আমলাতন্ত্রের হাতে ন্যস্ত করাটাকে বৈধতা দিয়েন না। পৃথিবীতে সব সরকারই দলীয় বিবেচনাতেই এবং বড়জোর উদারতা দেখিয়ে ভিন্ন লোকদেরও জাতীয় পুরস্কার দেয়। সেই তালিকা নিয়ে প্রশংসা বা নিন্দা হয়। কিন্তু সেই তালিকাটা যখন আমলাতন্ত্রের কুক্ষিগত নিয়ন্ত্রণে থাকে, তখন তা রাষ্ট্রের ভয়াবহ একটা বিকারগ্রস্ত দশাকেই ইঙ্গিত করে। তিন বছরে দুই বার এই এক বিষয় নিয়ে আলোচনা, এইটা আসলে এমনি এমনি ঘটেনি।
- লেখক: প্রাবন্ধিক, অনুবাদক এবং রাজনীতিক