বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ: এক নক্ষত্রের পতন
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি নক্ষত্রের পতন ঘটল। একজন মানুষ রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে কীভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ।
১৯৩০ সালে জন্মগ্রহণকারী সাহাবুদ্দীন আহমদ ১৯৫৪ সালে পাকিস্তানের সেন্ট্রাল সুপ্রিয়ার সার্ভিসে যোগদান করেন। ৬ বছর প্রশাসনিক পদে দায়িত্ব পালনের পর ১৯৬০ সালে পাকিস্তানের বিচার বিভাগে তাকে বদলী করা হয়।
প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনকালে তিনি গোপালগঞ্জ, পটুয়াখালীসহ বিভিন্ন জায়গায় কর্মরত ছিলেন। বিচার বিভাগে কর্মরত অবস্থায় ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জায়গায় তার কার্যকাল শেষ করেন। পাকিস্তানের শাসন ব্যবস্থার মধ্যে এরকম একটি বিষয় তখন ছিল, প্রশাসনের কর্মরত কর্মকর্তাদেরকে বিচার বিভাগে বদলি করা হতো। বাংলাদেশে মাসদার হোসেন মামলার আগ পর্যন্ত এই ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল।
১৯৬৭ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের হাইকোর্টে সাহাবুদ্দীন আহমদকে রেজিস্ট্রার হিসেবে মনোনয়ন দেয়া হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ২০ জানুয়ারি তিনি হাই কোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত হন বঙ্গবন্ধুর সরকার কর্তৃক। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৮০ সালে ৭ ফেব্রুয়ারি জিয়াউর রহমান সরকার কর্তৃক আপিল বিভাগের বিচারপতি নিযুক্ত হন।
১৯৮২ সালে বাংলাদেশে সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর থেকে সামরিক শাসনবিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু হয়। সেই রাজনৈতিক আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে ১৯৮৩ সালে শিক্ষানীতি বিরোধী আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। যার ফলে শিক্ষা ভবনের সামনে তদানীন্তন সামরিক শাসকের নির্দেশনায় জাফর জয়নালসহ বেশ কিছু ছাত্রের মৃত্যু সংঘটিত হয়েছিল। পরিণতিতে এই হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে রাজনৈতিক মহল থেকে তদন্তের দাবি উত্থাপিত হলে বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের নেতৃত্বে এক তদন্ত কমিশন গঠিত হয়েছিল।
বিচার বিভাগে কার্যরত থাকা অবস্থায় আপিল বিভাগের একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার নিষ্পত্তি করেছিলেন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন। অষ্টম সংশোধনী বাতিল নামে খ্যাত তার সেই রায়ের ফলে আদালত কর্তৃক বাংলাদেশের পার্লামেন্টে সংবিধান সংশোধনের বাতিলের পথ সূচিত হয়েছিল। সংবিধানের মৌলিক ধারণা পরিপন্থী সংশোধনী বাতিলের পথ উন্মুক্ত হয়েছিল। আদালতের মাধ্যমে এর আগে কোনো রায়ে কোনো সংশোধনী বাতিলের ইতিহাস সৃষ্টি হয়নি। পার্লামেন্টে রচিত এই সংশোধনী বাতিল করার ভেতর থেকে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছিল।
অষ্টম সংশোধনী রায় এরশাদের সময়ে ৬টি হাইকোর্টে বেঞ্চ স্থাপনার মাধ্যমে বাতিল করা হয়েছিল। যদিও অষ্টম সংশোধনীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ তখন আমলে নেওয়া হয়নি—তা হলো রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের বিষয়টি। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সম্পর্কিত সংশোধনের এই অংশটিকে বলা হয়ে থাকে কেউ চ্যালেঞ্জ করেনি বিধায় মামলা হয়নি। কিন্তু এটি হয়তো সম্ভব ছিল যে আদালতের স্বপ্রণোদিতভাবে এই বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসা। কারণ আজও এক্ষেত্রে অনেকের মত আছে যে এই বিষয়টি আসলে আমাদের সংবিধানের মৌলিক ধারণা পরিপন্থী। ধর্মনিরপেক্ষতা এবং রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম দুটি বিষয় কখনো একত্রিত হয় না।
সামরিক শাসনের গর্ভ থেকে রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত এরশাদবিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনের পরিণতি লাভ করে ১৯৯০ সালে। হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ পদত্যাগে বাধ্য হন। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তিন দলীয় জোটের সৃষ্টি হয় এবং তিন দলীয় জোট তাদের একটি রূপরেখা তৈরি করে ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান হিসেবে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন সাহেবের নাম প্রস্তাব করা হয়।
বিচারপতি সাহাবুদ্দীন তখন বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি। তিনি এই দায়িত্ব নিতে অপারগতা জানিয়ে প্রথমে বলেন তার কর্মজীবনের বাদবাকি সময় প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করতে চান। এর ফলে সেই সময়কার রাজনৈতিক দলগুলো একটি সমঝোতায় উপনীত হয় এবং বিচারপতি সাহাবুদ্দীন সাহেবকে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর তখনকার উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয়। ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ থেকে অক্টোবর ১৯৯১ সাল পর্যন্ত বিচারপতি সাহাবুদ্দীন প্রথমে উপরাষ্ট্রপতি, তারপরে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন।
এই অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করার সময় দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবর্তন হয়। তার অধীনেই ১৯৯১ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যা এ যাবতকালের বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত সফল নির্বাচন হিসেবে ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ আছে।
১৯৯১ সালের অক্টোবর মাসে সাহাবুদ্দীন আহমদ আবার প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব গ্রহণ করার আগে সংসদে একাদশতম সংশোধনী পাস করা হয় তার এই প্রধান বিচারপতি পদে ফেরত যাওয়ার লক্ষ্যে।
ইতিহাসের পাতায় এটি একটি বিরল ঘটনা। একজন ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে একটি রাষ্ট্রের সংবিধানের পরিবর্তন আনার ইতিহাস বোধহয় পৃথিবীর আর কোনো দেশে নেই। এছাড়াও সবচেয়ে বেশি সময় ধরে দায়িত্ব পালন করা বিচারপতিদের একজন তিনি। বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের উপর আস্থা দেশবাসীর তৈরি হয়েছিল যার ফলে এরকম একটি সংশোধনী আনতে তখনকার রাজনৈতিক জোটগুলো একমত হয়েছিল। তিনিও সঠিকভাবে তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছেন। তিন দলীয় রূপরেখার অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন টেলিভিশন ও বেতারকে স্বায়ত্তশাসন দেয়া হবে, যে কাজটি আর কখনোই করা হয়নি।
১৯৯১-এর নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন দল ক্ষমতায় আসার পর তারা নানা টালবাহানা শুরু করে তিন দলীয় জোটের রূপরেখা বাস্তবায়নের জন্য। তিন দলীয় জোটের অন্যতম সমঝোতা ছিল সংসদীয় গণতন্ত্রে ফেরত আসা। বিএনপি সরকার গঠিত হওয়ার প্রথমদিকে তিন দলীয় জোটের প্রধান বিষয় সংসদীয় গণতন্ত্রে ফেরত যাওয়ার সংশোধনী নিয়ে আসতে গরিমসি শুরু করলে বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের দৃঢ়তার ফলে সেই সময় বিএনপি জোট সংসদে দ্বাদশ সংশোধনী গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তে সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তন করা হয়।
দ্বাদশ সংশোধনী বাংলাদেশের ইতিহাসের এক বিরল ঘটনা। এই সংশোধনী আগে তৈরি একাদশ সংশোধনী ও দ্বাদশ সংশোধনী উভয় সংশোধনী রাজনৈতিকভাবে চরম বিভাজিত তিনটি রাজনৈতিক জোটের সমঝোতার ফসল। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন তার দায়িত্ব পালন শেষে ১৯৯১ সালে অক্টোবরে প্রধান বিচারপতির পদে ফেরত যান। এর পরই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং ক্ষমতার বাইরের আওয়ামী লীগের মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতা ভেঙে পড়ে। ১৯৯৪ সালের মাগুরা নির্বাচনের মাধ্যমে তা চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে ১৯৯৫-১৯৯৬ সালে। ফলে নতুন আন্দোলন শুরু হয় এবং ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৯৭৫-উত্তর বাংলাদেশের প্রথম ক্ষমতায় আসে।
তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতি হিসেবে বিচারপতি সাহাবুদ্দীনকেই মনোনয়ন দান করেন এবং বিচারপতি সাহাবুদ্দীন তার সময়কালে যথাযথভাবেই নিজ দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
বিচারপতি সাহাবুদ্দীন ২০০১ সালের নির্বাচনের পর রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। দীর্ঘ ২২ বছর বিচারপতি সাহাবুদ্দীন কখনো গণমাধ্যমের সামনে মুখ খোলেননি তার দায়িত্ব পালনকালীন সময়ের কোনো বিষয় নিয়ে।
বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের অষ্টম সংশোধনী যদিও তাকে ইতিহাসের পাতায় এক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে, তবুও বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক দিকনির্দেশনা সুপ্রিম কোর্টের উপরে দায়িত্ব প্রদান করা ছিল যে দেশের প্রয়োজনে হাইকোর্টের সার্কিট বেঞ্চ প্রতিষ্ঠা করার কথা।
কিন্তু অষ্টম সংশোধনীর সেই রায়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত আর কখনোই সার্কিট বেঞ্চ গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। সেই অর্থে বিচারিক আদালতের রায়সমূহ উচ্চ আদালতে দীর্ঘ জটিলতার শিকারে পরিণত হয়েছে এই সীমিত উচ্চ আদালতের ক্ষমতা নিয়ে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পূর্ণতা অধরাই থেকে গেল।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক