ইউক্রেন সংকট: পশ্চিমা গণমাধ্যমের একপেশে উপস্থাপন
ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের প্রায় দেড় মাস হতে চললো। পূর্বের এই সংকটে পশ্চিমও জড়িয়ে পড়েছে পরোক্ষভাবে। সরাসরি সেনা না পাঠালেও, অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইউক্রেনকে সাহায্য করছে পশ্চিমা দেশগুলো। দীর্ঘায়িত হতে থাকা এই সংকটের প্রভাব কমবেশি বিশ্বের সব দেশের ওপরেই পড়ছে। কারণ সংকটের সঙ্গে জড়িয়ে আছে পরাশক্তি রাশিয়া।
আর রাশিয়াকে ঠেকাতে পশ্চিমা শক্তি যেন সুপারহিরো রূপে ফিরেছে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে। একদিকে, রাশিয়ার ওপর তাদের নিষেধাজ্ঞা বিশ্ব বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলছে; অন্যদিকে, পশ্চিমা মিডিয়ার প্রপাগান্ডাও প্রভাব ফেলছে মানুষের মগজে।
হলিউডের সিনেমায় যেমন হিরোকে আকর্ষণীয় করে তুলতে খলনায়কের প্রয়োজন পড়ে; ঠিক তেমনি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নিজেদের গুরুত্ব ধরে রাখতেও পশ্চিমা মিডিয়া নতুন নতুন ভিলেন নিয়ে আসে সামনে। রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটও এর ব্যতিক্রম নয়।
রাশিয়ার যেসব আচরণে মিডিয়া আজ এতটা সরব, অন্যান্য রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে কিন্তু তারা ঠিক ততটাই নীরব ছিল বা আছে। আজ যে ধরনের পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে এবং এ ধরনের পদক্ষেপের জন্য মিডিয়া তাদের সরকারের সাহসিকতার প্রশংসা করছে, ঠিক একই ধরনের পরিস্থিতিতে ইসরাইলকে যুক্তরাষ্ট্র নীরব সমর্থন দিয়ে আসছে- যুগ যুগ ধরে। আর এ বিষয়ে পশ্চিমা গণমাধ্যম কী ধরনের ভূমিকা অতীতে রেখেছে এবং বর্তমানে রাখছে, তা বোধ করি বিস্তারিত বলারও প্রয়োজন নেই।
আজ ইউরোপে ইউক্রেনের শরণার্থীরা যেমন অভ্যর্থনা ও সহযোগিতা পাচ্ছে, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। তবে এর পেছনে যে শরণার্থীদের শ্বেত বর্ণের প্রভাব রয়েছে তাতেও সন্দেহ নেই। এক্ষেত্রে, পশ্চিমা গণমাধ্যম ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের জন্য যেভাবে সহানুভূতি তৈরি করেছে তার নজির কিন্তু সিরিয়া বা মধ্যপ্রাচ্যের অন্য কোনো রাষ্ট্রের সংঘাত থেকে পালিয়ে আসাদের বেলায় দেখা যায়নি।
জাতিসংঘ থেকে বহু আগে ঘোষণা দেওয়া হলেও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মাত্র কিছু দিন আগে রোহিঙ্গা গণহত্যার স্বীকৃতি দিয়েছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা মিডিয়া ইতোমধ্যেই ইউক্রেন সংকটে গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ এনেছে।
সংবাদ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট পুতিনের কাছে ইউক্রেন যুদ্ধের যৌক্তিকতা জানতে চাওয়া হলে তিনি পাল্টা জানতে চেয়েছিলেন, ন্যাটোর মত কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী সামরিক জোট যদি যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তবর্তী রাষ্ট্র কানাডা অথবা মেক্সিকোতে সেনা মোতায়ন করতে চায়- তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া কী হবে?
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তার এই পাল্টা প্রশ্ন পরিস্কার বুঝিয়ে দেয়, ইউক্রেনের দখল নেওয়া এই যুদ্ধের প্রধান উদ্দেশ্য নয় বরং সীমান্তবর্তী নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই চলমান অভিযানের মূল লক্ষ্য। একইসঙ্গে তার এই বক্তব্য স্নায়ুযুদ্ধকালীন 'কিউবার মিসাইল সংকট' পরিস্থিতির কথা মনে করিয়ে দেয়। একথা মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, প্রেসিডেন্ট পুতিনের মনে ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্যপদ পাওয়া নিয়ে যে সন্দেহ ছিল, তা পুরোপুরি অমূলক নয়।
পশ্চিমা রাষ্ট্র ও মিডিয়াগুলো চলমান সংকট ও যুদ্ধ উত্তেজনা নিয়ে কঠোর সমালোচনা করলেও, যুদ্ধ থামাতে কিন্তু তারা কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়নি এখনও। বরং তাদের উস্কানিতে, আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, ইউক্রেনকে তাদের সহায়তাই মূলত এই সংঘাতকে আরও দীর্ঘায়িত করছে।
সম্প্রতি এক টুইট বার্তায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেছেন, রাশিয়া যুদ্ধের পূর্বে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী প্রথম ১০টি দেশের মধ্যে ছিল। কিন্তু যুদ্ধ শেষে তারা প্রথম ২০টি দেশের মধ্যেও থাকবে না। তার এই বক্তব্য থেকেই বোঝা যায়, ইউক্রেনকে সংকট থেকে ওঠানো কিংবা ইউরোপে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা তাদের উদ্দেশ্য নয় বরং সুযোগের উপযুক্ত ব্যবহার করে প্রতিদ্বন্দ্বীকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করাই মূল উদ্দেশ্য।
অন্যদিকে, বলতে গেলে এই সংঘাতে যেখানে বিশ্বের প্রায় সব রাষ্ট্রই কম বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, সেখানে যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে সবচেয়ে বেশি লাভবান। তাদের সর্বশেষ নির্বাচনের বিব্রতকর অবস্থা নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এখন আর আলোচনা হচ্ছে না, মধ্যযুগীয় আইন নিয়ে সিনেটে চলমান হাস্যকর বিতর্কে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কান দিচ্ছে না, তার ওপর রাশিয়াকে জ্বালানির বাজার থেকে বিতাড়িত করার পর তৈরি হওয়া শূন্যস্থান দখল করে নিচ্ছে মার্কিন ব্যবসায়ীরা। যদিও কিছুদিন আগেও তারা নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে প্রাধান্য দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিল। তাছাড়া যখন রাশিয়ার ধনকুবেরদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার খবর ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে, সেখানে দশগুণ বেশি সম্পদশালী মার্কিন ধনকুবেরদের কর ফাঁকি দেওয়ার খবরগুলো চাপা পড়ে যাচ্ছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট যে এতদিন গড়াবে- এটি হয়তো অনেকেই চিন্তা করেনি আগে। তাই এই সংঘাতের ভবিষ্যৎ নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরাও হয়তো পরিষ্কার কিছু বলতে পারবেন না এখনই। তবে এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার। পরিস্থিতি যদি এভাবেই চলতে থাকে, তবে এই সংকটের জের ধরে পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র রাষ্ট্রগুলো একচ্ছত্র আধিপত্য দেখাবে নতুবা স্নায়ুযুদ্ধের সময়ের চেয়েও চরম দ্বি-মেরুকরণের দিকে যেতে থাকবে বিশ্ব-ব্যবস্থা।
যুদ্ধ কোনো সময় বা পরিস্থিতেই কাম্য নয়। এনিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ রাখাও উচিত নয়। যুদ্ধের ডামাডোলে বরাবরই পরাশক্তিদের স্বার্থের জাঁতাকলে পিষ্ট হতে থাকে সাধারণ মানুষ এবং অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাষ্ট্র। জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে ইউক্রেনও সেই পরিণতির শিকার।
- লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
- ই-মেইল: [email protected]