শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকট থেকে আমরা কী শিক্ষা নিতে পারি?
শ্রীলঙ্কায় চলমান অর্থনৈতিক দুর্দশা থেকে প্রথমেই যে শিক্ষাটি নিতে হবে তা হলো, কোনো সংকটই একদিনে সৃষ্টি হয় না। যেকোনো সংকট আসার অনেক আগেই তার লক্ষণ ফুটে উঠে। লক্ষণ দেখা দেওয়া মাত্রই উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হলে যে কোন ধরনের বিপর্যয় সামাল দেওয়া সম্ভব।
প্রয়োজন এবং সামর্থ্যের বেশি সরকারি ব্যয় শ্রীলঙ্কার দীর্ঘদিন ধরে চলমান একটা সমস্যা। বাড়তি ব্যয়ের ফলে সৃষ্ট ঋণের চাপ সামাল দিতে গিয়ে দেশটিতে দেউলিয়া পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের পরিস্থিতি এখনও তেমন পর্যায়ে যায়নি। তবে বাংলাদেশেও বেশ কিছু অপ্রয়োজনীয় বড় প্রকল্প রয়েছে, সেইসাথে সরকারি ব্যয়ও দ্রুত বাড়ছে।
শ্রীলঙ্কা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কাটছাঁটে দ্রুত মনোযোগী হতে হবে। সরকারের রাজস্ব আদায়ের পরিমাণও বাড়াতে হবে। এখনই সাবধান না হলে আমাদেরও একই অবস্থা হতে পারে।
গত কয়েক বছরে শ্রীলঙ্কা সরকার যে সব বড় প্রকল্প নিয়েছে, তার অনেকগুলোই আর্থিক ও অর্থনৈতিকভাবে ভায়াবল ছিল না। নিজের সক্ষমতা না থাকায় ঋণ নিয়ে এ সব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এখন এই ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না।
বিদেশি ঋণ পরিশোধের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ ব্যয়ও মেটাতে পারছে না শ্রীলঙ্কার সরকার। পরিস্থিতি সামাল দিতে বেহিসাবি ব্যাংক নোট ছাপানো হয়েছে। এর ফলে দেশটির মূদ্রার মানে বড় ধরনের অবনমন হয়েছে। মূদ্রার ক্রয় ক্ষমতা তলানিতে নেমে আসায় বেড়েছে মূদ্রাস্ফীতি।
ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় দেশটির ওপর থেকে দাতা সংস্থা ও দেশগুলোর আস্থাও কমে গেছে। এখন সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, শ্রীলঙ্কা সরকার তাদের বিদেশি ঋণের দায় মেটাতে পারবে না।
আর্থিক সংকট প্রকট হলে শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশ, ভারত ও চীনসহ বেশ কিছু দেশে সহায়তা চেয়ে যোগাযোগ করে। ওই সময় দেশটির উচিত চিল আন্তর্জাতিক মূদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর সহায়তা চাওয়া। এর আগেও আইএমএফ বেশ কিছু দেশকে বিপদ থেকে পুনরুদ্ধারে সহায়তা দিয়েছে।
ভারতের পক্ষ থেকে কোনো সহায়তা না দিয়ে আইএমএফ এর কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। আর বাংলাদেশ বিদেশি ঋণ দিতে সম্মত হয়। এখন এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে শ্রীলঙ্কাকে দেওয়া অর্থ আগামী এক দশকেও ফেরত পাওয়া যাবে না।
আইএমএফ থেকে ঋণ নিতে হলে সরকারের ব্যয় কমিয়ে আনাসহ বেশ কিছু শর্ত পালন করতে হয়। এ সব শর্ত মেনে নিলে বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন সংস্থা থেকেও ঋণ পাওয়া যায়। এই একটি কারণেই আইএমএফ এর সহায়তা নেয়নি দেশটি।
শ্রীলঙ্কায় যে ক্রাইসিস হয়েছে, তা চলতে থাকলে বিদ্যমান সরকার টিকতে পারবে না। নতুন সরকার এসে হয়তো ব্যয় সংকোচনসহ বিভিন্ন শর্ত মেনে নিয়েই সংকট থেকে পুনরুদ্ধারের পথে হাঁটবে।
শ্রীলঙ্কা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদেরও অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশে সরকারি ব্যবস্থাপনায় বিদেশি ঋণে বেশ কিছু প্রকল্প চলমান রয়েছে। এর সবগুলোর প্রয়োজন রয়েছে, এমনটা আমি মনে করি না।
আমাদের লাখ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে চলমান রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রয়োজনীয়তা কতটা রয়েছে, এ বিষয়ে আমি সন্দিহান। দেশে এমনিতেই বিদ্যুত উদ্বৃত্ত রয়েছে। উৎপাদন ক্ষমতার পুরোটা ব্যবহারও হচ্ছে না। অথচ রাশিয়া থেকে অনমনীয় ঋণ নিয়ে বিশাল ব্যয়ের প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। এর ফলে বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপও বাড়ছে।
আমার বিবেচনায় দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত রেল লাইন নির্মাণে চলমান প্রকল্পে বিশাল অঙ্কের অর্থ ব্যয় অযৌক্তিক। পদ্মা সেতু নির্মাণের চাইতে বেশি ব্যয়ে সংযোগ রেল লাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। যমুনা নদীতে নতুন করে রেল সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। বাস্তবতা হলো আমাদের দেশে সড়ক পথেই বেশি লোকজন চলাফেরা করেন। পণ্যও বেশি পরিবহণ হয় সড়ক পথেই।
গত কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশে সরকারের কর্মীদের বেতন ভাতা ও পেনশন বাবদ ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধের চাপ বাড়ছে। বিভিন্ন খাতে সাবসিডিও বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে। এই ধারা চলতে থাকলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হবে। এর থেকে উত্তরণে সরকারের কর আহরণেও গুরুত্ব দিতে হবে।
- লেখক: বাংলাদেশ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক