আমরা কি বলতে পারি না ‘টিপ ইজ মাই চয়েজ’
বাংলাদেশে মানুষের মধ্যে একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য দিনে দিনে প্রকট হয়ে উঠছে। সেটা হলো- কাউকে তার নিজের মত করে আনন্দ বা উৎসব করতে দেখলে আমাদের গা জ্বালা করে ওঠে। কাউকে ভাল থাকতে দেখলে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। কারো উন্নতি দেখলে পিছন থেকে টানতে মন চায়। সারাক্ষণ যেকোনো ইস্যুতে শুধু পাপ, পূন্য, বেহেশত-দোজখের হিসাব করছি, আবার অন্যদিকে দুর্নীতিতে শীর্ষ স্তরে থাকছে বিশ্বের সব দেশের মধ্যে। কী অদ্ভুত বৈসাদৃশ্য, কী অসঙ্গতি!
নববর্ষে মঙ্গল শোভাযাত্রা করা যাবে না, করলে ধর্ম থাকবে না। রোজার মাসে পহেলা বৈশাখে রমনা বটমূলে গান গাওয়া কি উচিৎ হবে? কোন নেতানেত্রীর বা বিশিষ্টজনের স্ট্যাচু কেন বানানো হবে? তাতে করে ধর্ম চলে যাবে। এই করে বিমানবন্দর মোড় থেকে লালনের স্ট্যাচু সরিয়ে ফেলা হলো। শহীদ মিনারে ফুল দেয়া কি ঠিক হচ্ছে? এটা তো বেদয়াত ইত্যাদি নানা ধরনের মারপ্যাঁচে পড়ে আমাদের আনন্দ-আয়োজন সব মলিন হতে বসেছে।
ইংরেজি নববর্ষ উদযাপন করতেও বিধিনিষেধের বাড়াবাড়ি। বিশ্বের আর কোনো দেশে এরকম কারফিউ টাইপ নিয়মকানুন জারি করে নববর্ষ পালন করা হয় কিনা আমার জানা নেই। হৈচৈ করে আনন্দ উদযাপনকে মোটামুটি একটা পাপ বা অপরাধের তালিকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
এবার হাত পড়েছে খুব ব্যক্তিগত একটি প্রসাধন 'টিপ' নিয়ে। টিপ পরা নিয়ে এরকম হেনস্তা কি করতে পারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোন সদস্য? কনস্টেবলের এই দুস্কর্ম পুরো বাহিনীকে কালিমা লিপ্ত করেছে। সুখের কথা- তাকে আটক ও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এবার যথাযথ শাস্তিও দেওয়া হলে- তবেই এই লজ্জা ঘুচবে।
একজন মেয়ে বা নারী কী পোশাক পরবেন? কিভাবে সাজবেন? কীভাবে চুল বাঁধবেন, কোন ব্যাগ হাতে নেবেন? কী জুতা পায়ে গলাবেন, এসব একান্তই তার নিজের অভিরুচি। তার সাথে হয়তো পরিবার, বন্ধু সাজেশন দিতেই পারেন। আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে নারীরা সামাজিক বিধিনিষেধের কথা ভেবে সবসময়ই পোশাক-পরিচ্ছদে একটা শালীনতা বজায় রাখার চেষ্টা করেন। সামাজিক অনুষ্ঠানে ও জনসমাগমে কে কী পরছেন বা পরবেন, এটাও মেনে চলা হয়।
নারী হিসেবেই বলি- ঠিক এরকম একটা অবস্থায় আমাদের সাজাসাজি নিয়ে কথা বলাটা পুরোপুরি অপ্রাসঙ্গিক ও অনভিপ্রেত। টিপ নিয়ে এত কথা বলা অবান্তর মনে করছি। আমি একজন বাঙালি নারী। মন থেকে বিশ্বাস করি, এই টিপ পরাটা আমার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অংশ। সেই ষাট ও সত্তুরের দশকে আমি আমার মাকে টিপ দিয়ে সাজতে দেখেছি। আমার পরিবারের অনেকেই টিপ দেয়। আমিও টিপ দেই প্রতিদিন এবং দিয়েই যাব। এর সাথে আমার ধর্ম চলে যাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই।
আশির দশকে আমরা যখন ইউনিভার্সিটিতে পড়তাম, তখন প্রায় সব মেয়েই টিপ পরতো শাড়ির সাথে। আমরা প্রতিটি অনুষ্ঠানে শাড়ি পরে, টিপ, কাজল দিয়ে সাজতাম, চুড়ি পরতাম, মেহেদি দিতাম, আলতা দিতাম পায়ে। কবিতা পড়তাম, গান গাইতাম, ঘুরতাম, বেড়াতাম। কলেজেও তাই করেছি। হঠাৎ করে কী এমন হলো যে- টিপ দেওয়াটা 'লজ্জাকর' কিছু হয়ে গেল। টিপ দিলে জাত চলে যাচ্ছে- এরকম একটা সুরও তোলা হচ্ছে এখন।
সংবিধান আমাকে আমার মতো করে সাজার অধিকার দিয়েছে। এখানে রাষ্ট্র কিংবা কোনো বাহিনী সে অধিকার কেড়ে নিতে পারে না। আমি হিন্দু না মুসলমান, নাকি বৌদ্ধ বা খ্রিষ্টান এটা আমার সাজগোজের ক্ষেত্রে কোন বিচার্য বিষয় নয়। নিজের ইচ্ছায় সাজাটা আমার অধিকার।
টিপ দেওয়ার ইস্যুতে অনেকেই হিজাব ইস্যুকে টেনে আনছেন, যা একেবারেই অর্থহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এখানে হিজাব পরাটা, যারা পরছেন- তাদের অধিকার। ওনারা যেমন বলছেন, "হিজাব ইজ মাই চয়েজ" আমরা যারা টিপ দিতে পছন্দ করি, তারাও বলতে পারি, "টিপ ইজ মাই চয়েজ"। এরজন্য কি কেউ হিজাবধারী নারীর শরীরে বা টিপ দিয়েছি বলে আমাদের শরীরে মোটরসাইকেল তুলে দিতে পারেন? পারেন না।
শুধু একটা কথাই বলতে চাই মুসকানকে যখন ভারতে হিজাব পরার জন্য নিগ্রহ করা হয়েছিল, তখন এই আমিই, টিপ পরিহিতা একজন বাঙালি নারী মুসকানের হিজাব পরার অধিকারের পক্ষে কথা বলেছিলাম এবং লিখেছিলাম।
কেউ কেউ বলেন টিপ দিলে মুসলমান হওয়া যায় না এবং বেহেশতে যাওয়া যাবে না। কথা হচ্ছে, আমাকে মুসলমান বানানোর এবং বেহেশতে নেওয়ার দায়িত্ব তাদের কে দিয়েছে? নিজের কথা ভাবুন, সমাজের সমস্যার কথা ভাবুন, মূল্যবৃদ্ধির কথা ভাবুন, যানজট, জনদুর্ভোগ- এসব নিয়ে ভাবুন। মানুষের পাশে দাঁড়ান। দেখবেন আল্লাহ আপনাদের সহায় হবেন।
বুঝতে পারি না কেন, আমরা এতটা আনন্দবিমুখ হয়ে উঠলাম? কেন আমরা আনন্দ উপভোগ করা মানুষদের প্রতি প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠছি? সবচেয়ে বিপদের কথা, আনন্দ রুদ্ধ করার জন্য সমাজের নেতিবাচক মানসিকতার মানুষগুলো সংঘবদ্ধ হচ্ছে।
আমরা কি জানি যে মানুষকে যতো বেশি বিনোদন বিমুখ করে ফেলা হবে, সমাজে অপরাধ ততোই বাড়বে। আমাদের সবকিছুতেই ভয় দেখানোর প্রবণতা কেন? সারাদিন বেহেশত-দোজখ নিয়ে নানান কথা বলা হয়, পাপপূণ্য নিয়ে কথা বলা হয়, উচিত-অনুচিত নিয়ে বয়ান দেওয়া হয় এবং এর সবই ভয়াবহ ভীতিকর ও বিদ্বেষপূর্ণ।
একবারও বলা হয় না ভাল কাজ করুন, মানুষ ও প্রকৃতিকে ভালবাসুন, অন্যকে আনন্দ দিন, নিজে আনন্দে থাকুন, জীবনকে উপভোগ করুন, আল্লাহর সৃষ্টিকে দু'চোখ ভরে দেখুন। শুধু শাস্তি কী ভয়াবহ হতে পারে, দোজখে কীভাবে পুড়বেন এই জাতীয় কথাবার্তা। যারা দুর্নীতি করছে, যারা ঘুষখোর, যারা নারীকে অবমাননা করে, মানুষকে নির্যাতন করে, নারী-শিশু ধর্ষণ করে, অন্যের জায়গা-জমি কেড়ে নেয়, তাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলুন, তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ান।
অবদমন একধরনের ভয়ঙ্কর মানসিক ও শারীরিক চাপ তৈরি করে মানুষের ওপর। যারা যতো আনন্দ করতে পারে, নিজেদের মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে, জীবনকে উপভোগ করতে পারে, তারা অপরাধ ততো কম করে। এই যে আমাদের সমাজে একটা নিয়ন্ত্রণের সংস্কৃতি চালু হয়েছে এবং গোপনে সবকিছুই চলছে, তাতে করে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এই সমাজের শিশু ও তরুণরা।
নিজের মতো করে ভাল থাকার বিরুদ্ধে আমাদের এই বিপরীত যাত্রা কেন? সমাজের এই নেতিবাচক বিপরীত চিন্তা একটা জ্ঞানহীন, মেধাহীন, গোঁয়ার, ক্ষুব্ধ, লোভী, স্বার্থপর ও অপরিচ্ছন্ন মানসিক পরিবেশ তৈরী করে। সেই পরিবেশে যখন একটি শিশু আসে, সেই সবথেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
যাক আবার মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। টিপ পরার জন্য নারীকে অপদস্থ করায় নানানজন নানানভাবে এ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কেউ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখে, কেউ টিপ পরা ছবি ফেসবুকে দিয়ে, কেউ রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। পুরুষদের কেউ কেউ টিপ পরে নারীদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। এটাকে বলে প্রতিবাদের ভাষা।
যারা ছেলেরা কেন টিপ পরছে এনিয়ে কটাক্ষ করছেন, তারা আসলে প্রতিবাদের ভাষাটিও বুঝতে অক্ষম। কোনো ঘটনার প্রতিবাদে কেউ কেউ অনশন করেন, তারা এটি কেন করেন, পেটের ক্ষুধায় নাকি প্রতীকী প্রতিবাদে? কাফনের কাপড় পরেন প্রতিবাদের জন্য, তখন তারা কি সত্যিই মারা যান?
এনিয়ে ব্যাখ্যা দেওয়ারও কিছু আছে বলে মনে করি না। যে পুরুষ টিপ পরে ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপলোড করেছেন, তিনি নারীর ব্যক্তি রুচি ও সংস্কৃতির প্রতি সংহতি জানিয়েছেন এবং ঐ নারীর ওপর যে অন্যায় ও বর্বরোচিত ঘটনা ঘটেছে, তার প্রতিবাদ জানিয়েছেন তার মতো করে। এটা নিয়ে যারা কটুক্তি করছেন, তারা নিজেদের ছোট করছেন।
একটি সমাজে যখন বিচারবোধ কমে যায়, সিদ্ধান্তগ্রহণে অক্ষমতা তৈরি হয়, বাড়ে বিষন্নতা, বিরক্তি, অসহিষ্ণুতা, অবসাদ, আগ্রহহীনতা ও আগ্রাসী মনোভাব। তখন সেই সমাজকে আমরা ডিমনেশিয়াগ্রস্ত সমাজ বলতে পারি। নিয়মিত আনন্দ উদযাপন না করলে, শরীরচর্চা, পড়াশোনা না করলে এবং সামাজিক ও বুদ্ধিগত বিষয়ে অংশগ্রহণ না করলে- সমাজ ডিমনেশিয়াগ্রস্ত হয়ে পড়তে বাধ্য। আমরা আনন্দ নিয়ে বাঁচতে চাই। আনন্দের মধ্য দিয়ে দায়িত্বও পালন করে যেতে চাই। আমরা চাই না একটি ডিমনেশিয়াগ্রস্ত সমাজ ও অসুস্থ প্রজন্ম।
- লেখক: সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন