বাচ্চাকালের অসুখ-বিসুখ আর ডাক্তার
আজ আমার বয়স ৭০ বছর। রোগ বালাইয়ের কমতি নেই শরীরে। অথচ সত্তর বছর বয়সী এই বুড়ো কিন্তু হাসপাতালে রাত কাটিয়েছে কেবল একবার! তা-ও আবার তিন বছর বয়সে। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, খুব ভয়াবহ কোনো অসুখ হয়েছিল আমার সেবার।
অসুখটা ছিল ডিপথেরিয়া। আগে ডিপথেরিয়াতে প্রচুর শিশুমৃত্যু হতো। বড়দের তেমন হতো না। আমাদের দেশের টিকাদান কর্মসূচির একটা বড় উদ্দেশ্য ছিল ডিপথেরিয়া ঠেকানো।
যা-হোক, তিন বছর বয়সের সব স্মৃতি তো মনে থাকে না। কিন্তু এটা মনে আছে, আমার মা আমাকে টয়লেটে নিয়ে যেত। টয়লেটটি ছিল কিছুটা ভারতীয় টয়লেটগুলোর মতো। আর আমার কেবল মনে হতো, আমি বোধ হয় পড়ে যাব গর্তের মধ্যে। তাই মা আমাকে ধরে রাখত আর আমি টয়লেট সারতাম।
ডিপথেরিয়া উপভোগ করেছি!
হাসপাতাল থেকে ফিরে আসার পরও ১০ দিনের মতো বিছানাতেই কাটিয়েছি আমি। সম্পূর্ণ বিশ্রামে ছিলাম। বাচ্চা ছেলের এ ধরনের বিশ্রাম সহ্য হবার কথা না। তবে আমি কিন্তু সময়টা খুব উপভোগ করেছি। এই রোগের জন্য যে আমার মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে, এ নিয়ে আমার কোনো ভয় কাজ করত না। অবশ্য ওই বয়সে এসব বোঝার কথাও না। কিন্তু এই অসুখের ফলে মা যে আমার বিশেষভাবে যত্ন নিত, আদর করে খাওয়াত, এসব খুব ভালো লাগত আমার।
আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে দেখতাম, আমার ভাইয়েরা টেবিলে বসে খাচ্ছে। আর আমি খাচ্ছি বিছানায় শুয়ে শুয়ে। একটা চমৎকার মুরগির স্যুপ বানাতেন মা আমার জন্য। এটা আসলে বাড়ির কেউ অসুস্থ হলেই বানানো হতো। ওষুধের মতো কাজ করলেও, এটা কিন্তু আমার খুব পছন্দের একটি খাবার ছিল।
এরপর আমি সুস্থ হই। আমার জীবনের প্রথম বড় অসুখের অভিজ্ঞতা ছিল এটাই। অসুখটা বড় হলেও, অভিজ্ঞতা হয়েছিল খুব সুন্দর। আরাম-আয়েশে পূর্ণ এক জীবনের অভিজ্ঞতা!
খুব পরিচ্ছন্ন একজন মানুষ ছিলেন আমার মা
তখন তো কলেরা, ডায়রিয়া, ডিপথেরিয়ার মতো বড় বড় রোগগুলো খুব হতো। আমার মা সারাক্ষণ এটা পরিষ্কার হচ্ছে কি-না, ওটা পরিষ্কার হচ্ছে কি-না, এই নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকতেন। আসলে এসবই ছিল আমাদের রোগ-বালাই থেকে সুস্থ রাখার জন্য।
কিন্তু এত সাবধানতার মধ্যেও আমার ডিপথেরিয়া হয়ে গেল। অন্য কারও কিছু হয়নি, কিন্তু আমার হয়ে গেল।
একটা ঘটনা মনে আছে, রাতের বেলা আমাদের পারিবারিক ডাক্তার এলেন, আমাকে দেখতে। দেখে বললেন, ডিপথেরিয়া হয়েছে, দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে।
এরপর বাবা রাতের বেলা গাড়ি করে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। যাবার সময় আমি মাকে কাঁদতে দেখেছিলাম। বাবার মুখটাও খুব ভারী হয়ে উঠেছিল।
মশারি টাঙ্গিয়ে আম খেতাম!
মশা তো ছিলই। মাছির উৎপাতও ছিল খুব। মশারি থাকায় মশার কষ্টটা তেমন বুঝতাম না। কিন্তু মাছির উৎপাত অতিষ্ঠ করে ফেলতো।
ওই সময় বড় বড় মাছি ছিল। কোনো ফল বা মিষ্টি কিছু খেলেই বড় বড় মাছিরা এসে হাজির হতো। যেন মাছির মেলা বসেছে! আর আম খেতে গেলে তো কথাই নেই। সে যে কী উৎপাত চিন্তা করা যায় না!
এজন্য আমরা মশারি টাঙ্গিয়ে আম খেতাম। খাবার টেবিলে মা মশারি টাঙ্গিয়ে দিত, আর আমরা মশারির তলায় আম খেতাম। কত অদ্ভুত মনে হচ্ছে আজ বিষয়টা! অথচ একটা সময় তা-ই করতাম। এটা শুধু আমার মা না, অনেক বাড়ির মায়েরাই এভাবে তাদের সন্তানদের আম খাওয়াত।
সুতরাং, ঢাকা শহরে একটা সময় মাছির উৎপাতেও মশারি ব্যবহার করা হতো!
কখনো পেট খারাপ হতো না
ওই সময়ে ঢাকার পানির অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। তাই আমরা পানি ফুটিয়ে খেতাম। তখনকার দিনে জগে পানি খাওয়ার একটা চর্চা ছিল। যেটা অনেকখানি কমে গেছে বর্তমানে। এখন তো মানুষ প্লাস্টিক কন্টেইনারে খায়। আমার মা সবসময় সচেতন থাকত পানির ব্যাপারে। যে কারণে আমাদের কখনো পেট খারাপ হতো না।
গুটি বসন্ত নির্মূল হতে ৩০ বছর লাগল!
ছোটোবেলায় এই তিনটে রোগ অনেক হতো। হাম এবং জলবসন্ত এত ভয়াবহ না হলেও, গুটি বসন্ত হলে মানুষ মারা যেত খুব। মিউনিসিপালটি থেকে লোক আসত টিকা দিতে। আমাদের দেশে '৫৬-র দিকে টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়। এই টিকা ছিল প্রধানত গুটিসবন্তের টিকা। যেদিন টিকা দিতাম, এরচেয়ে ভয়াবহ দিন আমার সারা বছরে লাগত না।
একটা চাকতি ছিল, চার আনার চেয়েও ছোটো হবে, কিছুটা খোঁচা খোঁচা ধরনের ছিল। এটাকে প্রথমে ওষুধ দিয়ে মুছে নিত। তারপর ঘুরিয়ে হাতের উপরিভাগে (মাংসের উপর) বসিয়ে চাকতিটা ঘোরাত, ওর মধ্যে ওষুধটা ঢেলে দিত। পুতপুত করে রক্ত বের হতো। খুব ব্যাথা পেতাম।
মাঝে মাঝে এই জায়গাটা আবার পেকে যেত। তখন হলুদ হলুদ পুঁজ বের হতো। ব্যাথায় খুব কষ্ট হতো, মাঝে মাঝে জ্বরও আসত।
গুটিবসন্ত নির্মূল হতে অনেক সময় লেগেছিল। অনেক পরে গিয়ে এই গুটিবসন্ত কমেছিল। আমার বাবা যখন ৮০-র দশকে প্ল্যানিং কমিশনের সদস্য ছিলেন, তখন গুটি বসন্ত নির্মূল হয়। তারমানে গুটি বসন্ত নির্মূল হতে ৩০ বছর লেগেছিল!
বাড়ির বাচ্চাগুলোকে ঘর থেকে বের হতে দিত না
এখন তো মানুষ ভুলে গেছে কলেরার কথা। কলেরা শব্দটাই মৃত এখন। টিকাটুলিতে থাকার সময় একবার একজনের কলেরা হয়েছিল। এই খবর শোনামাত্রই মানুষের মনে যে কী রকম এক ভীতি ঢুকে পড়ল! আমার মনে হয় ডাকাত পড়লেও এত ভীতি কাজ করত না।
বাড়ির বাচ্চাগুলোকে ঘর থেকে বের হতে দিত না তখন। কারণ বাইরের বাতাসে কলেরা ছড়াবে। কিন্তু কলেরা যে মলবাহিত, এটা কেউ মাথায় রাখত না তেমন।
সেবার আইসক্রিম খাওয়া একদম বন্ধ হয়ে যায় আমাদের। আমরা প্রায় ৬ মাস কোনো আইসক্রিম খাইনি। বাইরের খাবার খাওয়াও পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। সব খাবার, এমনকি বিয়ের অনুষ্ঠানগুলোতেও বাবুর্চির বদলে ঘরের মানুষ রান্না করত।
কলেরা-বিষয়ক সচেতনা ছড়াতে গলিতে হেঁটে হেঁটে মাইকিং করা হতো। মানুষ কতটা শুনত জানি না, কিন্তু লোকজন বুঝত যে স্বাস্থ্যের কথা বলা হচ্ছে। মধ্যবিত্তরা সচেতন হলেও, গরীবদের ভেতরে এত সচেতনবোধ ছিল না। গরীব মানুষরা অনেক মরত কলেরায়। মরত বেশিরভাগ গরীবরাই।
পারিবারিক ডাক্তার মানেই 'বাড়ির লোক'
পারিবারিক ডাক্তারের বিষয়টা সমাজ থেকে উঠে গেছে এখন। আগে এই রেওয়াজটা ছিল। আমাদের যিনি ছিলেন, তার নাম ড. আইয়ুব আলী। আইয়ুব আলী ঢাকা মেডিকেল কলেজের শারীরতত্ত্বের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি যে ক্লিনিকে বসতেন, তার নাম ছিল, ট্রপিক্যাল ক্লিনিক। ক্লিনিকটা ছিল জিন্নাহ এভিনিউর (বর্তমান বঙ্গবন্ধু এভিনিউ) ওখানে। প্রায় সময়ই সন্ধেবেলা বাবা আমাদের ডাক্তার সাহেবের ক্লিনিকে ঘুরতে নিয়ে যেতেন। ডাক্তারের চেয়ে আত্মীয় হিসেবেই বেশি পরিচিত ছিলেন তিনি আমাদের কাছে।
১৯৫৬-৫৭-র দিকে ঢাকায় একটা ফুটবল খেলা হয়েছিল, বাবা-মামাদের সঙ্গে আমি গিয়েছিলাম খেলা দেখতে। হঠাৎ খেলার মাঝে মারপিট শুরু হলে বাবা আমাকে নিয়ে আশ্রয় নিলেন এই ট্রপিক্যাল ক্লিনিকেই। আইয়ুব ডাক্তার তখন সেখানে রোগী দেখায় ব্যস্ত। দাঙ্গায় আহতদের ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছেন; যাদের চোখে টিয়ারগ্যাস চলে গেছে, তাদের চোখে পানি ঢালছেন—এরকম একটা ব্যস্ত পরিবেশ তখন।
তারমধ্যে আমি বাবার কোলে বসে হুট করে বলে উঠলাম, 'আমার খুব খিদে পাচ্ছে।' এত ব্যস্ততার মাঝেও ডাক্তার সাহেব বিরক্ত তো হলেনই না, উলটো আমার জন্য এক প্যাকেট বিস্কুত কিনে আনতে পাঠালেন।
বিস্কুট পেয়ে আমি মহা আনন্দে বিস্কুট খেতে লাগলাম আর চারপাশের তান্ডব দেখতে লাগলাম। চারপাশে হইচই, আর তাদের মাঝে তিন-চার বছরের একটা বাচ্চা মজা করে বিস্কুট খেয়ে যাচ্ছে! কোনো ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে এখন এই দৃশ্য ভুলেও ভাবা যায় না। কিন্তু আমাদের মধ্যে সেই সম্পর্কটা ছিল। এটাই হলো পারিবারিক ডাক্তারের সম্পর্ক। এ সম্পর্ক যে কতটা গভীর আর ঘনিষ্ঠ, তা বলে বোঝানো যাবে না।
ডাক্তার সাহেব মারা যান ১৯৬৮ সালে। খুব প্রিয় মানুষ ছিলেন তিনি আমার। আমাকে খুব আদর করতেন, গেলেই কোলে উঠিয়ে বসিয়ে রাখতেন। তার ছেলে ড. সারোয়ার আলী মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের একজন ট্রাস্ট সদস্য।
তখন অনেক বাড়িতেই পারিবারিক ডাক্তারের চল ছিল। এদেরকে আমরা একজন চিকিৎসক হিসেবে নয়, বরং পরিবারের মানুষ হিসেবেই পেয়েছি। এই সংস্কৃতির পরিবর্তন হলো '৭১-এর পর। যখন ডাক্তারদের অনেক বেশি বাণিজ্যিকীকরণ হয়েছে, রোগীসংখ্যা বেড়ে গেছে।
এখন চিকিৎসাব্যবস্থা অনেক উন্নত। তখন এত উন্নত ছিল না। কিন্তু তা-ও সে সময়গুলো মনে পড়ে ভালো লাগা থেকেই। হয়তো এর জন্য দায়ী আমার মা এবং ড. আইয়ুব আলী, যারা আমার প্রতিটি অসুস্থতার (ছোটোবেলার) সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
- লেখক: গবেষক ও সাংবাদিক