বাংলাদেশকে অবৈধ অভিবাসী প্রসঙ্গ তুলে আক্রমণ সমীচিন নয়
গুজরাটি বাবুদের কাছে বর্তমান ভারতীয় রাষ্ট্র ক্ষমতা। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও তার অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহচর অমিত শাহ ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এরা দুজনেই ভারতের গুজরাট রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও গুজরাটের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৪৬/৪৭ সালের ঘটনা প্রবাহের ভেতর থেকে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়েছিল। আর সেই বিভক্তিতে যারা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন তারা ছিলেন একদিকে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ও বল্লভ ভাই প্যাটেল, আর অন্যদিকে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ।
এই ত্রিরত্ন জন্মগতভাবে গুজরাটের ছিলেন। ভারতবর্ষ বিভক্তির ভেতর থেকে যে দুটি রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছিল পাকিস্তান ও ভারত সেই দুটি রাষ্ট্রের জাতির পিতা হয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী নামে পরিচিত মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী আর আর ইসলামী প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানের জাতির পিতা হয়েছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত হয়েছিল ভারতবর্ষ নামক ভূখণ্ডটি। ৭৫ বছর ধরে ভারতীয় উপমহাদেশে এই ধর্মীয় বিভাজন চলছে। ১৯৪৬ সালে যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়েছিল তা আজও অব্যাহত আছে।
সপ্তদশ শতাব্দী বিশ্বের প্রধান অর্থনীতি ভারতীয় উপমহাদেশ। আজ পৃথিবীর ১২৮ তম অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হয়েছে এ খন্ডিত ভারত। গত সপ্তাহজুড়ে দেশটির আনাচে-কানাচে, সর্বত্র যে সাম্প্রদায়িকতা ছড়িয়ে পড়েছে তা চল্লিশ দশকের সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কথা মনে করিয়ে দেয়। যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ভারতকে বিভক্ত করেছিল। দাঙ্গা শুরুর প্রথম তিন দিনেই কলকাতা শহরেই হাজার দশেক মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।
তারপর সে দাঙ্গা আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়েছিল বিহার, নোয়াখালী, পাঞ্জাবসহ ভারতবর্ষের আনাচে-কানাচে। তেমনি একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার চেষ্টা করা হচ্ছে ভারতের নানান প্রান্তরে। দিল্লিও যোধপুরে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো তারই নিদর্শন। ভারতের নানান প্রান্তে কাশ্মীর যোধপুর দিল্লি শহরসহ অনেক জায়গায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছে তার প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে ধর্মীয় উন্মাদনা, আর এর পেছনে রয়েছে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপির কর্মীদের ইন্ধন। যোধপুরে সাধারণ একটি ঈদের পতাকা উত্তোলন কেন্দ্র করে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে, দাঙ্গার পরিণতিতে শহরটিতে কারফিউ দিতে হয়।
এমনি যখন অবস্থা তখন ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ দল গোছানোর কাজে পশ্চিম বাংলার রাজধানী কোলকাতায় নেমে প্রথমেই বাংলাদেশকে নিশানা করেন। তিনি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্দেশ্যে বলেন যে কোভিড-১৯ শেষ হলেই আমরা সিএএ কার্যকর করবই, বাংলাদেশের অনুপ্রবেশকারীদের কোনো সুযোগ দেওয়া হবে না এদেশে বেআইনি ভাবে বসবাস করার। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যখন তার পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বাংলাদেশে প্রেরণ করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ভারত সফরের নিমন্ত্রণ করে গেলেন, তার পরপরই অমিত শাহের বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশিদের অনুপ্রবেশের এই মিথ্যা বয়ানের মাধ্যমে কি সংকেত দিতে চাইলেন তিনি?
ভারত কি আসলে বাংলাদেশের সঙ্গে সত্যিকারের প্রতিবেশীসুলভ বন্ধুত্ব চায় কি চায় না সেটি আজ বড় প্রশ্ন? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ প্রতি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারীদের গল্প প্রচার করে থাকেন। যে তথ্য দ্বারা তিনি এই রাজনীতি করছেন তা মূলত বাংলাদেশ বিরোধী একটি বিদ্বেষ। অমিত শাহের যে রাজনৈতিক দলটি পশ্চিমবাংলা থেকে বিলুপ্ত হতে চলছে সেই দলটিকে পুনরায় অক্সিজেন দেওয়ার জন্য কলকাতা ভ্রমণ করেছেন জনাব অমিত শাহ। এ পর্যন্ত তিনি অনেকবার কলকাতা সফর করেছেন। এই প্রথম সৌরভ গাঙ্গুলীর মতন একজন বিশিষ্ট জনপ্রিয় ব্যক্তির বাসভবন ভ্রমণটাও একটি বিশেষ প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। তবে কি অমিত শাহ এই জনপ্রিয় বাঙালি সৌরভ গাঙ্গুলীর উপরই ভরসা করতে যাচ্ছেন?
একদিকে যখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ভারতের সঙ্গে আন্তর্জাতিক ও দ্বিপাক্ষিক বিষয়াদি নিয়ে সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্যে ভারত সফরে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন, ঠিক তেমন একটি সময়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে সংকটে ফেলার লক্ষ্যেই এই ধরনের বক্তব্য রাখছেন বারবার। বাংলাদেশ ভারত বাণিজ্য সহযোগী। কথিত আছে কয়েক সহস্র ভারতীয় নাগরিক বাংলাদেশের বিভিন্ন শিল্প কারখানায় কর্মরত- পোশাকশিল্পের নানান ক্ষেত্রেই বাংলাদেশে তারা কর্মরত- এবং বাংলাদেশ থেকে তারা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ভারতে পাঠান।
পূর্বের প্রকাশিত এক তথ্য নিয়ে ভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছিল। বাংলাদেশ থেকে প্রকৃতপক্ষে কত রেমিট্যান্স পাঠান হয় ভারতে সে বিতর্কের সূত্রপাত হয়েছিল। বাংলাদেশ থেকে ভারতে চার বিলিয়ন ডলারের রেমিটেন্স পাঠানো হয় এই তথ্যকে তখনকার ভারতীয় হাই কমিশনার ভুল তথ্য হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু কী পরিমাণ রেমিট্যান্স ভারতে যায় এ তথ্য তখন প্রকাশ করা হয়নি। ভারতীয় হাইকমিশনার ছিলেন তখন হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা।
বাংলাদেশ ভারতকে নানান ধরনের ভৌগলিক যোগাযোগ সুবিধা দিয়েছে। কিন্তু এসব কিছুই অমিত শাহ ভুলে যান এবং বাংলাদেশকে অবৈধ অভিবাসী প্রসঙ্গ তুলে আক্রমণ করেন। অর্থনৈতিক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার করার জন্য সামাজিক সম্পর্ক জোড়াদাড় দরকার। বারবার ধর্মীয়ভাবে বিভাজন সৃষ্টি করে ভারত বাংলাদেশের সামাজিক সম্পর্ককে বিনষ্ট করা হচ্ছে। ভারত রাষ্ট্রটির চতুর্পাশে যে দেশগুলো আছে তাদের মধ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে সর্বোচ্চ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও এই আক্রমণ ভবিষ্যতের জন্য কত ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায় তা জনাব অমিত শাহ উপলব্ধি করছেন না।
আমাদের দেশের অভ্যন্তরে মৌলবাদীদেরকে উস্কে দেওয়ার ব্যবস্থা করছেন এই ধরনের বক্তব্য তুলে ধরে। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে ধর্মীয় দাঙ্গা রোধ করতে ব্যাপকভাবে ব্যর্থ অপরদিকে বাংলাদেশ বিদ্বেষ প্রকাশ করে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দিচ্ছেন গুজরাটের এই স্বনামধন্য প্রাক্তন গুজরাটের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। একসময় গুজরাটে দাঙ্গায় মোদী অমিত শাহ জুটির বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল।
গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকা অবস্থায় যে দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছিল গুজরাটে তার ফলে ভারতের আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও এদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করা হয়েছিল, যা উচ্চ আদালতে নিষ্পত্তি হওয়ার প্রাক্কালে এক বিচারকের মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল। ভারতে ওই মৃত্যু নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছিল। ওই বিচারক ছিলেন সিবিআই আদালতের বিচারক এবং তার আদালতে অমিত শাহের বিরুদ্ধে গুজরাট দাঙ্গা মামলা তখন চলমান ছিল।
ভারতীয় বিশিষ্ট লেখিকা অরুন্ধতী রায় তার এক লেখনীতে উল্লেখ করেছেন ভারত এক অন্ধকার পথে হাঁটছে। সত্যিই কি তাই? এ রকম হলে প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সন্দেহ-অবিশ্বাসই শুধু বাড়বে।