যেখানে যা কিছু খাই, মন কেন খোঁজে বাংলাদেশের রান্না
বেড়াতে খুব ভালবাসি কিন্তু দিন শেষে খাওয়াটা চাই বাংলাদেশি। এই বদ অভ্যাসের কারণে ভ্রমণসাথীরা প্রচন্ড বিরক্ত হয়, কেউ কেউ বকাবকিও করে। সব মেনে নিয়েই আমি ওদের সঙ্গী হই বারবার। শুধু আমি কেন, বাঙালিরা বিশ্বের যে দেশেই বসবাস করুক না কেন, নিজের দেশের খাবারের স্বাদ তাদের মুখে লেগেই থাকে।
চাঁদা তুলে খাওয়া
আর তাইতো বোস্টনের মাইনাস ৩৫ ডিগ্রী তাপমাত্রার বরফের মধ্যে বসেও বাঙালি ছাত্রছাত্রীরা চাঁদা তুলে খিচুড়ি, আলু ভাজি, মাংস আর ডিম ভুনা করে খায়। শুধু কি তাই? বিদেশি ছাত্রছাত্রীরাও এই খিচুড়ি মাংসের ফ্যান হয়ে গিয়েছিল। বৃষ্টি হলে বা বেশি তুষার পড়লে নিজেরাই নাকি মাংস কিনে এনে হাজির হতো। বিদেশে পড়ুয়া বাঙালি ছাত্রছাত্রীরা বলে সপ্তাহে অন্তত একদিন দেশের রান্না না খেলে তাদের সপ্তাহটাই ভেস্তে যায়। ফেসবুকে দেখি প্রায় প্রতিটি বাঙালির বাড়িতে খিচুড়ি, ইলিশ ভাজি আর মাংসের হাঁড়ি চড়ে যেকোন বর্ষার দিনে।
রান্না খেয়েই প্রেম
ইটালির এক মেয়েকে চিনি, যে শুধু বাংলাদেশি রান্নার গুণে প্রেমে পড়ে গিয়েছিল সালেহীনের। কারণ সালেহীন খুব মজাদার সব বাংলাদেশি রান্না জানতো। বাংলাদেশের অসম্ভব আধুনিক ও 'নাকউঁচু' ছেলে আদনান প্রতিবছর জার্মানি থেকে দেশে আসে, শুধু মায়ের হাতে চ্যাপা শুঁটকির ভর্তা খেতে। খেয়েই ক্ষান্ত হয়না, যাওয়ার সময় খুব গোপনে, নানা কায়দায় ব্যাগে ভরে এতটাই নিয়ে যায়, যেন আরো মাসখানেক এই শুঁটকি দিয়ে ভাত খেতে পারে। আদনান স্বীকার করেছে চ্যাপা শুঁটকির উপর কোন খাওয়া নাই।
মাছ মিল্টন
বরিশালের ছেলে মিল্টন, ঢাকায় থাকার সময়, শত রকমের মাছ খাওয়ার জন্যই ওর বাড়িতে আমরা যেতাম। সেই মিল্টন কানাডাপ্রবাসী হয়েও অবিরত মাছের কথাই বলে যায়, মাছের স্বপ্ন এঁকে যায়। এখন ও কানাডার বড় পাঁচতারকা হোটেলের শেফ। আমার কেবলই মনে হচ্ছে যেকোন দিন ঐ হোটেলের মেন্যুতে বাংলাদেশি রান্না ঢুকে যাবে ছোট ভাই মিল্টনের হাত ধরে।
বিদেশের বাংলা হোটেল কেন ভারতীয় রান্নায় ভরা
বিদেশে বাংলা খাবার নামে হোটেলে যা কিছু বিক্রি হয়, সবই ভারতীয়। কিন্তু কেন! কেন আমরা বাংলাদেশের খাবারকে এসব রেস্টুরেন্টে চালু করতে পারছিনা? কেন বাংলাদেশিরাও ঐসব হোটেলে গিয়ে মাটর পানির বা বিফ ভিন্দালু বা চিকেন করহাইকে বাংলাদেশি ডিস মনে করে খেয়ে আসছি এবং বিদেশীদেরও খাওয়াচ্ছি।
অথচ প্রতিটি বাংলাদেশি বিদেশ যাওয়ার সময় যে বইটি সাথে নিয়ে যাওয়া 'ম্যান্ডেটরি' বলে মনে করতো, সেটা হল সিদ্দিকা কবীরের রান্নার বই। আর এখন তো অনেক ইউটিউব চ্যানেল হয়েছে বাঙালি রান্নার। চাইলেই শুধু বাংলাদেশি রান্নার হোটেল বানানো এখন আর কোন ব্যাপার নয়।
শুধুই কি অভ্যস্ততা
কী জাদু এই বাংলা খাবারে? নাকি শুধুই আমরা অভ্যস্ত বলে এমনটা হয়?
অভ্যস্ততা তো আছেই কিন্তু এর উপরে আছে বাংলাদেশি রান্নার যাদু। কতধরণের খাবার যে বাংলাদেশি মেন্যুতে আছে তা কল্পনাও করা যায় না। শুধু ডাল, ভাত, আলুর ভর্তা আর ডিম ভাজি খেলেই যেন মনে হয় রাজ্যের শান্তি।
মাছেভাতে বাঙালি
বাংলাদেশে কমপক্ষে ১৫ ধরনের চালের সাথে ১০০ রকমের মিষ্টি পনির মাছ, আরো আছে সমুদ্রের মাছ, শতরকমের ভর্তা, ভাজি, সবজির নানা পদ, আলু ভাজি, বেগুন ভাজি, শুক্তো, বড়ি, কলার মোচা, অনেক রকমের শুঁটকি, নানা পদের ডাল, আচার, গরু, খাসি, মুরগি, হাঁসের মাংস রান্না। এই খাবারগুলোর মধ্যে কোনটাতে তেল-মশলার ব্যবহার বেশি, কোনটায় হালকা।
শুধু আমাদের ইফতারির আয়োজনের কথা ভাবলেই তো মাথা নষ্ট হয়ে যায়। বাংলার পিঠেপুলিরও কোন শেষ নাই। আছে বিভিন্ন ধরণের মিষ্টি, পায়েস, জর্দা, হালুয়া, দইসহ আরো কত কী!
কী নেই পাতে
আছে মোগলাই খানা পোলাও-কোর্মা, রোস্ট, রেজালা, মাছ-মাংসের কালিয়া, কোপ্তা-কাবাব, চিংড়ির মালাইকারি, ডিমের কোর্মা, মোরগ পোলাও, কাচ্চি বিরিয়ানি, তেহারি, বোরহানি। আছে বাঙালির খাবার খিচুরি-মাংস-ডিমভাজি এবং সাথে ঘি বা আচার। এত ধরনের আচার আর কোন দেশে বানায় কিনা আমার জানা নেই। এছাড়াও আছে রুটি, পরোটা, নান, বাকরখানি, হরেক রকমের কাবাব, হালুয়া, মিষ্টি, বিভিন্ন ধরনের শরবত।
পথের দোকান
বাংলাদেশের পথের ধারের ছোট ছোট দোকানে যে সিঙ্গারা, সমুচা, ডালপুরি, আলুপুরি, ঝালমুড়ি, মোগলাই পরোটা, আলুর চপ, বেগুনি, ছোলা, হালিম, জিলাপি বিক্রি হচ্ছে, এগুলোর স্বাদও অসাধারণ। যারা একবার এসবের স্বাদ পেয়েছে, তারা আর কোনদিনও সেই স্বাদ ভুলবেনা বাংলাদেশে নিযুক্ত একজন বৃটিশ কর্মকর্তা তার বিদায়ী ভাষণে বলেছিলেন বাংলাদেশে উনি আবার ফিরে আসবেন শুধু এদেশের অপূর্ব রান্না খাওয়ার জন্য। বিশেষ করে সিংগারার কথা উনি কখনও ভুলতে পারবেন না।
বাংলাদেশে বাহারি রান্না কিভাবে এলো
এত ধরনের বাহারি রান্না কিন্তু হঠাৎ করেই বাংলাদেশের রান্নাঘরে ঢুকে যায়নি। এর একটা ইতিহাস আছে। হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে বাংলাতে প্রথম দিকে মাছ, ভাত, দুধ, মিষ্টি এবং শাকসবজির প্রচলন ছিল বেশি। ১৫৭৬ সালে মুগলরা বাংলা শাসন শুরু করলে এখানে মোগলাই রান্নার চল শুরু হয়। ঢাকাতে মুগল রান্নার সাথে বাংলার আদি রান্নার সম্মিলনটা এত বেশি হয়েছিল যে, আজকের ঢাকাইয়া রান্নাতে মোগলাই ঘরানার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
পুরান ঢাকাতেই যেন মুগলরা ছিল
আর তাই আমাদেরও যখন তেলে-ঘিয়ে মাখামাখি করে খুব খানদানি রান্না খেতে ইচ্ছে করে, চলে যেতে হয় পুরান ঢাকায়। ঢাকার সবচেয়ে নামকরা খানদানি খাবারের বাবুর্চিদের ঠিকানা কিন্তু পুরনো ঢাকা। যদিও দিল্লী ছিল মুগলদের রাজধানী, কিন্তু ঢাকার কাচ্চি বিরিয়ানির কাছে দিল্লীর কাচ্চি বিরিয়ানি দাঁড়াতে পারেনি, সে কথা কিন্তু আমরা বলছি না, বলেছেন দিল্লীর খুব বিখ্যাত একজন নিওরোসার্জন। উনি যখনই ঢাকায় আসেন, তখনই তার প্রধানতম খাদ্য হয়ে দাঁড়ায় এই কাচ্চি।
উনি বলেন, "আমি বাংলাদেশের চিতল মাছের কোপ্তা, ইলিশ, কই এসব খাবারের কথা ভুলতে পারিনা। আমি নিজে রাজস্থানের লোক হলেও বাংলাদেশের রান্না এতটাই ভালবাসি যে আমার কুক একজন বাঙালি।"
ব্রিটিশ ও পর্তুগিজ
মুগলদের পরে আসে ব্রিটিশরা। নবজাগরণের যুগে বাঙালিদের রান্নার উপর প্রভাব পড়ে সাহেবী রান্নার। বাঙালিরা অভ্যস্ত হতে থাকে চা, কেক, বিস্কুট, মাংস, আলু দিয়ে নানারকম পদ ও রুটি খেতে। পর্তুগিজরা চালু করে পনির। পারস্য, তুরস্ক ও আরব খাবারেরও একটা প্রভাব লক্ষ্য করা যায় বাঙালি রান্নার উপর। এতধরণের সংস্কৃতির রন্ধন কৌশল বাংলার আদি রান্নার সাথে মিলে একে এতটাই সুস্বাদু করেছে যে, বাংলাদেশের রান্না হয়ে উঠেছে খুবই বৈচিত্র্যমন্ডিত।
বাংলাদেশের জেলাগুলো
শুধু কি তাই, পাক ভারত উপমহাদেশ যখন ছিল, সেসময় পাশের দেশ বার্মার সাথে ছিল আমাদের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ। এই আরাকানি রাজ্যের রান্নার প্রভাব পড়েছে চট্টগ্রামের রান্নার উপরে। চট্টগ্রামের রান্নায় ব্যাপক ঝাল ও ঝোলের ব্যবহার ও শুঁটকি খাওয়ার প্রবণতা এসেছে আরাকান মুল্লুক থেকে।
আবার দক্ষিণে চট্টগ্রামের দিকে রান্নায় মশলার ব্যবহার বেশি। মাছের চেয়ে মাংস বেশি চলে। সবজির ও ডালের প্রচলনও কম। শুধু চট্টগ্রামের মানুষের কাছে নয়, এখানকার মেজবানি মাংস ও গরুর কালাভুনা আজ দেশব্যাপী খুবই জনপ্রিয় একটি খাবার। এই মাংস রান্না একবার যে খেয়েছে, সে কখনও ভুলবেনা।
উত্তরের জেলাগুলোতে মাছ, মাংস রান্না হয় হালকা ধরনের- কম তেল, কম মশলা। তবে অনুষ্ঠানের খাওয়াতে পোলাওয়ের সাথে কোর্মা, রোস্ট, আলু ভাজা, বেগুন ভাজা এসব থাকবেই। এদের রান্নায় আলুর ব্যবহার খুব বেশি। এরা ডাল, সবজিতে পাঁচফোড়নের বাগাড় দেয়। পোস্ত, মেথির ব্যবহার বেশি থাকে। অন্যসব খাবারের সাথে এই এলাকার নিজেদের খাবারের তালিকায় আছে কাউনের খিচুরি, আলুর ডাল, লাফা শাক, সিদল ও প্যালকা।
খুলনা-যশোর অঞ্চলে যেকোন রান্নার সাথে নারকেলের দুধ ও নারকেল ব্যবহার হয় বেশি। রান্নায় চিংড়িসহ নানাধরণের মাছের খুব চল। তবে চুইঝাল বলে একটি অসামান্য মশলা বা হার্বের ব্যবহার হয় এখানে। এখানে চুইঝাল দিয়ে যে মাংস রান্না হয়, সেটার স্বাদও অসাধারণ।
সিলেটের দিকে রান্না হয় বেশ কড়া পাকের এবং মশলার ব্যবহারও বেশি। আর সিলেটের রান্নায় খুব বেশি ব্যবহৃত হয় সাতকড়া নামে একধরনের লেবু জাতীয় ফল ও নাগা মরিচ। এখানেও মাংস রান্না হয় সাতকড়া দিয়ে। চট্টগ্রামের মেজবানি মাংস, সিলেটের সাতকড়া মাংস, আর খুলনা অঞ্চলের চুইঝাল মাংস সবই বিখ্যাত হলেও তিন পদের মাংসের স্বাদ কিন্তু একেবারেই ভিন্ন।
বাংলাদেশে বিভিন্ন আদিবাসীদের বাস। আদিবাসীদের রান্নার স্টাইল একদম আলাদা রকমের। এই রান্নারও একটা বড় ধরনের চাহিদা রয়েছে বাংলাদেশে।
এছাড়া বৃহত্তর কুমিল্লা ও বিক্রমপুরের রান্না স্বাদে অসাধারণ। নরসিংদীর সুগন্ধি লেবু দিয়ে ছোট মাছের ঝোল, টমেটোর খাট্টা একবার না খেলে চলে না। ময়মনসিংহের কুমড়া পাতায় চ্যাপা শুঁটকি, নানা ধরনের ভর্তা মুখে লেগে থাকার মতো স্বাদ। বাংলাদেশের খাদ্য তালিকায় আরো এত শত আইটেম আছে যে, যা লিখে শেষ করা যাবে না। এককথায় বলা যায়, স্বাদের এই ভিন্নতাই বাংলাদেশের রান্নাকে করেছে অসাধারণ।
- লেখক: সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন