আমদানি-রপ্তানিতে কি ডলারের বাইরে অন্য মুদ্রায় বিনিময় চুক্তি হতে পারে?
জার্মানির ডয়চে ভেলে নিউজ নেটওয়ার্কে বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। যেখানে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, বাংলাদেশের বর্তমান বাণিজ্য ঘাটতি দেশকে চূড়ান্ত সংকটের দিকে নিয়ে যাবে। আমাদের নিজ দেশেও আলোচনা অব্যাহত আছে। সরকারের কিছু পদক্ষেপও সেদিকে লক্ষ করা গেছে। কিন্তু সময় থাকতেই আরও দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
বাংলাদেশের জনজীবনের বেশকিছু অপ্রয়োজনীয় অর্থাৎ এই মুহূর্তে প্রয়োজনীয় নয়; এমন পণ্যের ওপর সরাসরি নিষেধাজ্ঞা দেওয়া প্রয়োজন। তার মধ্যে বিশেষত রয়েছে - ব্যক্তিগত গাড়ি, বিভিন্ন ধরনের প্রসাধনী, উচ্চ প্রযুক্তি পণ্য, পোশাক, বিদেশ থেকে আমদানি করা ফল ইত্যাদি। বিশ্বে আপেল আমদানিকারক হিসেবে আমরা তৃতীয় স্থান অধিকার করি। বিগত বছরের সব আমদানির ক্ষেত্রে আমরা প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা এখাতে ব্যয় করেছি, যা বৈদেশিক মুদ্রায় প্রায় ১৫০ মিলিয়ন ডলারের কাছে।
ব্যাংকসমূহকে উচ্চ মার্জিনের নির্দেশ দিয়ে আমদানি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা হচ্ছে, কিন্তু এতে আমদানি কমে না বলেই মনে হচ্ছে। এই মুহূর্তে দেশের যে পরিমাণ বাণিজ্য ঘাটতি দেখা যাচ্ছে তা রক্ষা করার অন্যতম পথ হচ্ছে- অপ্রয়োজনীয় আমদানি সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা। রপ্তানি নিষিদ্ধ যেমন করা যায়, তেমনি আমদানির ক্ষেত্রেও তা করা দরকার। আমদানির ক্ষেত্রে বিনিময় মাধ্যম হিসেবে ডলার ছাড়া অন্য মুদ্রাকে উৎসাহিত করা যেতে পারে। কারণ বৈদেশিক বাণিজ্যে পৃথিবীর বিকল্প মুদ্রাসমূহের মধ্যে যে ভারসাম্যতা লক্ষ যাচ্ছে তা ডলারের ক্ষেত্রে তা লক্ষ করা যাচ্ছে না। সাথে অন্যান্য মুদ্রার বিনিময় মূল্য আর আমাদের দেশে ডলার-টাকার বিনিময় মূল্যে বিস্তর ফারাক দেখা যাচ্ছে।
আমদানিকারক এবং বিদেশের রপ্তানিকারকদের মধ্যে ডলারের বাইরে অন্য মুদ্রায় বিনিময় চুক্তি হতে পারে, যেমন ইউরোপিয়ান দেশ থেকে ইউরোতে। চীন থেকে চীনা মুদ্রা- ইউয়ানে অথবা অন্য কোনো দেশ থেকে ভিন্ন কোন মুদ্রায় আমদানি করা যেতে পারে। ঠিক এই মুহূর্তে বাংলাদেশের মুদ্রার সাথে ডলার ও ইউরোর মূল্য পার্থক্য উল্টোদিকে চলছে। ইউরোর মূল্যবৃদ্ধি হার ডলারের থেকে কম যা সবসময় ডলারের থেকে বেশি ছিল।
অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন স্থগিত করা উচিত; অর্থাৎ মানি চেঞ্জারদের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন সাময়িকভাবে স্থগিত করা সম্ভব। বিদেশ ভ্রমণের জন্য বৈদেশিক মুদ্রার ওপর এক ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারি করা যেতে পারে। বৈদেশিক মুদ্রার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপে করলে তা অবৈধ হুন্ডি বাজারকে শক্তিশালী করবে কিনা বোঝা মুশকিল। এই মুহূর্তে বৈদেশিক মুদ্রার আন্তঃব্যাংক লেনদেনের হার আর মানিচেঞ্জারের মূল্যে অনেক তফাৎ। মানিচেঞ্জারদের জন্য এই সুযোগ অব্যাহত রাখলে দেশে আরো বেশি হুন্ডি ব্যবসা বাড়বে।
রেমিট্যান্স বেশ কয়েক মাস যাবত কম আসছে। খোলা বাজারের সঙ্গে ব্যাংকসমূহের রেটের ব্যাপক তারতম্য রেমিট্যান্সকে আরো অস্বীকৃত পথে ধাবিত করবে। নয় মাসে বাণিজ্য ঘাটতির কারণে প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ কমে গেছে।
বাড়তি খাদ্যমূল্যে এবং অন্যান্য চাপের কারণে মানুষের মধ্যে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। এই মুহূর্তে কোন অবস্থাতেই জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি করা সমীচীন হবে না। বেসরকারি খাতের উদ্যোগে পরিচালিত আমাদের বস্ত্র খাত, তার মৌলিক উপাদান তুলা গত জুন-জুলাইয়ের তুলনায় এই মুহূর্তে দ্বিগুণেরও বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। এই দামের সঙ্গে রপ্তানি মূল্য সামঞ্জস্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। বস্ত্র খাতসহ আমাদের রপ্তানিমুখী শিল্প নানানভাবে আমদানিকৃত জ্বালানির উপর নির্ভরশীল। এমন সময়ে নতুন করে গ্যাস কিংবা বিদ্যুতের মূল্য বাড়ালে তার প্রতিক্রিয়ায় উৎপাদন ব্যবস্থার উপর মারাত্মক অবস্থার সৃষ্টি করবে। পরিণামে কারখানাগুলো টিকে থাকবে না। কর্মসংস্থানে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে।
বর্তমান এ সংকটময় সময়ে উচ্চাভিলাষী প্রকল্পগুলো নিয়ে অতি-উৎসাহ বুমেরাং হয়ে ফিরে আসে কিনা, সেদিকেও আমাদের সকলের লক্ষ রাখা দরকার।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক