কেন নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে?
বর্তমান নির্বাচন কমিশন গঠিত হওয়ার পর দেশে প্রথম কয়েকটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। মেয়র পর্যায়ের একটি নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে কুমিল্লায়। যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে যেয়ে প্রথমেই নির্বাচন কমিশন তার ভাবমূর্তি সংকটে পড়েছে। অতিউৎসাহী গণমাধ্যম প্রিয় এই নির্বাচন কমিশন ক্ষমতা বহির্ভূতভাবে, আইন বহির্ভূতভাবে স্থানীয় সাংসদকে এলাকা ত্যাগ করার নির্দেশ প্রদান করে দেশের সাধারণ জনগণের কাছে তাদের ভাবমূর্তির সংকট সৃষ্টি করেছে।
আসলেই নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষ নির্বাচন করার সক্ষমতা কতটুকু এ আলোচনা সৃষ্টি হয়েছে নতুন করে। এই নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নে নানান বিষয় উঠে এসেছে আলোচনার। এক. ইভিএম মেশিনের ব্যবহার; দুই. নির্বাচন চলাকালীন সময়ে নির্বাচন কেন্দ্রগুলোতে সিসি ক্যামেরার প্রযুক্তি ব্যবহার; তিন. ভোট গণনা শেষে ৪/৫টি কেন্দ্রের ভোটের ফলাফল প্রকাশ করতে অতিরিক্ত সময় ব্যয়- এসব কিছুই নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আলোচনা শুরু এ কারণেই।
ইভিএম মেশিন ব্যবহারের ক্ষেত্রে ১০ কোটি ডলারের যে ঘোষণা তা কতটা কার্যকর তা প্রমাণ করেছে নোয়াখালীর ইউপি নির্বাচন। যেখানে ধীর গতির ইভিএম থাকার ফলে রাত্রি নটা পর্যন্ত ভোটাররা লাইন ধরে ভোট কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে ছিল। এটা নির্বাচনী আইন ভঙ্গ করেছে কিনা সেটাও একটি প্রশ্ন! কারণ ভোট গ্রহণের সময়সীমা বিকেল চারটায় শেষ হয়েছে। তার পরেও রাত্রি নটা পর্যন্ত ভোটকেন্দ্রের মানুষ উপস্থিত থেকে ভোটের লাইনে ছিল এটি একটি অবিশ্বাস্য ঘটনা।
সাধারণভাবে বিকেল চারটার পরে আর ভোটকেন্দ্রে ভোট দেওয়ার জন্য কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়ার কোনো নিয়ম নেই। তারপরও কিভাবে, কেন রাত আটটা পর্যন্ত ভোটকেন্দ্রে লোক দাঁড়িয়ে ছিল ভোট দেওয়ার জন্য তা অস্পষ্ট। গণমাধ্যমে যা জানা গেল, ইভিএমের দূর্বলতার কারণেই গভীর রাত পর্যন্ত ওই ইউনিয়ন কাউন্সিলের ভোট প্রদান চলেছে।
কুমিল্লার নির্বাচনেও আরো কিছু অনিয়মের দৃশ্য গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রের ফলাফল যত দ্রুত প্রকাশ হচ্ছিল শেষ পর্যন্ত সেই ফলাফল প্রকাশের গতি ধরে রাখতে পারেনি। শেষের দিকের পাঁচটি ভোটকেন্দ্রে ফলাফল প্রকাশ করতে প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় অতিরিক্ত নেওয়া হয়েছে।
প্রধান পরাজিত প্রার্থী ইভিএমের ভোট প্রত্যাখ্যান করেছেন। এই নির্বাচনের ফলাফল নৌকা প্রতীকের বিজয় এনে দিলেও নৌকা প্রতীক এবং সরকার উভয়কেই মনে রাখতে হবে, এই নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের বিপক্ষে প্রায় দ্বিগুণ ভোট গণনা হয়েছে। দুজন বিএনপির পরিচিত ব্যক্তিত্ব দুটি ভিন্ন প্রতীকে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে নির্বাচন করেছেন এবং তাদের ভোটের সম্বলিত সংখ্যা প্রায় ৮০/৮৫ হাজার; আর আওয়ামী লীগের প্রার্থী ভোট পেয়েছেন ৫০ হাজারের আশেপাশে।
ভোটকেন্দ্রে উপস্থিতির হার ৫০ শতাংশের নিচে। সেই বিবেচনায় অর্ধেক মানুষ ভোটের ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখাননি। এর কারণ কী তা ভাবতে হবে। ক্ষমতাসীনরা যারা এ নির্বাচন পরিচালনা করছেন, ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে ভোট প্রদানের জন্য বিএনপির বিপক্ষে আওয়ামী লীগের পক্ষে কাজ করেছেন তাদেরকে গুরুত্বসহকারে বিষয়টি মনে রাখতে হবে যে, সকল প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তারা মাত্র এক-তৃতীয়াংশ ভোট নিজেদের পক্ষে আনতে পেরেছেন।
বিএনপি পরিচিত দুই প্রার্থী সম্মিলিতভাবে ভোট পেয়েছে সরকারি দলের প্রার্থীর থেকে দেড় গুণের বেশি। এমনি একটি সামাজিক অবস্থানে যদি কেবলমাত্র কূটকৌশলের মাধ্যমে নির্বাচনে বিজয় অর্জনের প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে তাহলে দেশ সামাজিকভাবে অগ্রসর হতে পারবে না। সামাজিক বিভাজনের পরিণতিতে আমরা আবার অতীতের কোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি চাই না। আমরা চাই না ২০০৬ সালের লগি-বৈঠার ঘটনার সৃষ্টি হোক, আমরা চাইনা ২০০৭ এর সামরিক/ অসামরিক ব্যক্তিত্বের ক্ষমতা দখলের কোন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হোক । আমরা চাই না ২০১৩ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মাসের অধিক সময় ধরে চলতে থাকা রাজপথের আগুন বোমার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হোক। দেশের স্বাভাবিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক কোনো ষড়যন্ত্রে বন্ধ হয়ে যাক তাও আমরা চাই না।
ইতিমধ্যে মার্কিন লবি বাংলাদেশের ক্ষমতার একটি অংশের উপর তাদের চাপ সৃষ্টি করেছে, সামরিক বেসামরিক প্রতিষ্ঠানের কিছু সদস্যের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, যা আমাদের দেশকে, দেশের স্বাভাবিক উন্নয়ন ও উৎপাদনকে উদ্বিগ্ন করেছে।
দেশের প্রধান বাণিজ্য তৈরি পোশাক মূলত ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজার ভিত্তিক। এই ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একই অবস্থান গ্রহণ করে সেই বিবেচনায় আমাদের উদ্বিগ্নতার যথেষ্ট কারণ আছে। দেশের অভ্যন্তরে উন্নয়নের প্রয়োজনে আমরা দীর্ঘদিন যাবৎ চীনের সহায়তা গ্রহণ করছি যা মার্কিনীদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। অন্যদিকে পদ্মা সেতু নির্মাণের বিষয়ে দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপিত হয়ে যে রাজনৈতিক ভাবমূর্তির সংকট সৃষ্টি হয়েছিল সেখান থেকে সরকার তার ভাবমূর্তি ফিরে পেয়েছে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ সম্পন্ন করে। যদিও পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় নিয়ে নানান কথাবার্তা আছে, তার কতটা সত্য কতটা মিথ্যা তা সময়ে প্রকাশ হবে। আসলেই পদ্মা সেতু নির্মাণে ব্যয় অনেক বেশি হয়েছে কিনা তাও স্পষ্ট হবে।
দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক সংকট যখন ঘনীভূত হয়ে চলছে তখন পাতাল রেলের প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য লাইসেন্স হস্তান্তরের ঘোষণা এসেছে, যা উদ্বিগ্ন হওয়ার মতোই। আগামী ৬ বছরে ৬০ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প এই পাতাল রেল। প্রায় ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই পাতাল রেলের নির্মাণ ব্যয় যা ধারণা করা হয়েছে তাই যদি থাকে, তাহলে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হবে পাঁচ হাজার কোটি টাকা আজকের মান অনুসারে।
বিশ্বব্যাপী এখন যেভাবে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিয়েছে তাতে এ নির্মাণ ব্যয় পদ্মা সেতুর মতো আরেকটি ব্যয়বহুল নির্মাণে পরিণত হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াবে আগামী দিনগুলোর অর্থনীতির ধারায় কোন দিকে যাবে এই পাতাল রেলের ঋণ? আমাদের সামনে এটা কোনো সংকট সৃষ্টি করবে কিনা- এসব বিষয়।
পরিশেষে এই কথা বলা যায় নির্বাচন কমিশনকে আগামী জাতীয় নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করার জন্য অনেক লম্বা পথ অতিক্রম করতে হবে। তাদেরকে প্রমাণ করতে হবে যে তারা দেশকে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দিতে সক্ষম। নির্বাচন সংক্রান্ত প্রচলিত যেসব আইন-কানুন আছে তার যদি কোন সংযোজন, পরিমার্জন করা দরকার হয় নির্বাচন কমিশনকে ক্ষমতা প্রদানের জন্য, তাহলে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে উচিত হবে সরকারকে তা অবহিত করা।
প্রয়োজনীয় আইন করার বিষয় অন্যতম হলো: নির্বাচনকালীন সময়ে নির্বাহী বিভাগ ও পুলিশ বিভাগের কর্মকর্তাদেরকে সরাসরি নির্বাচন কমিশনের অধীনস্থ করা। নির্বাচন কমিশন যেন তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে নির্বাচনের নিরপেক্ষতা ভঙ্গের কোনো অভিযোগ তাদের কাছে উপস্থাপিত হলে।
দেশের সকল অংশের মানুষকে মনে রাখতে হবে বিগত কয়েকটি নির্বাচন আমাদের দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে যে সংকটময় অবস্থার মধ্যে ফেলেছে সেখান থেকে আমরা যেন বেরিয়ে আসতে পারি। বিচার বিভাগকেও যথেষ্ট সচেতন ভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে।