পদ্মা সেতু ঢাকাকে বাঁচিয়ে দেবে!
পদ্মা সেতু অবশেষে বাস্তব।
নানান ধরনের ষড়যন্ত্র প্রতিবন্ধকতা সবকিছু কাটিয়ে উঠে এটি এক বিশাল অর্জন জাতির জন্য। পদ্মা সেতুর এই অর্জনের পেছনে একটি বিষয় সামনে এসে যায়, আর তা হলো সরকারের ধারাবাহিকতা। নানান বিতর্কিত নির্বাচন সত্ত্বেও দেশের সরকারের ধারাবাহিকতায় অবশেষে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন হয়েছে।
বাস্তবায়নের পথে আমাদের বেশ কিছু ঘটনার কথা মনে পড়ে। যেমন- মনে পড়ে একজন সচিবের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা, কারাবরণ এবং পরবর্তীতে তিনি হয়ে যান জার্মানির বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত।
তিনি চক্রান্তের শিকার হয়েছিলেন বলেই ধারণা করা যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রী একটি বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়েছিলেন ওই সময়। পদ্মা সেতুর বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের উত্থাপিত দুর্নীতির বিষয়টি নিয়ে প্রথমদিকে বিশ্বব্যাংকের পরামর্শেই কিছু মামলা শুরু হয়েছিল বলে পরবর্তীকালে জানা গিয়েছিল।
সবকিছু কাটিয়ে পদ্মা সেতু আজ একটি বাস্তবতা। পদ্মা সেতুকে নিয়ে বিরোধী দলের নানান বক্তব্য সবসময় দেশের মানুষকে দ্বিধাবিভক্ত করেছে। পরিশেষে, পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বয়কট করার ভেতর থেকে সেই সামাজিক বিভাজনের ধারা অব্যাহতই থেকে গেল।
পদ্মা সেতুর যে অর্জন, তাকে ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত শক্ত হাতে কাজে লাগাতে হবে। বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকা, যা বসবাস অযোগ্য শহরে রূপান্তরিত হয়েছে। বসবাস অযোগ্য শহরের তালিকায় যার অবস্থান ১৬৬ তম। এমনি একটি শহরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি এবং আমরা বসবাস করি। আমাদের আগামী প্রজন্মকে এই শহরে বসবাস উপযোগী করার দায়িত্ব আজকে আমাদের তথা আপনার উপর বর্তায়।
৩০/৩১ হাজার কোটি টাকার পদ্মা সেতুর সামাজিক বিনিময় মূল্য লক্ষ কোটি টাকা হওয়া উচিত। পদ্মাসেতু আমাদের যে সামাজিক অবস্থানের পরিবর্তন করবে তার মূল্য নির্ধারণ করা এখনই সম্ভব নয়। তবে, পদ্মা সেতুর সক্ষমতার সুযোগে শক্ত হাতে ঢাকা থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। এর মধ্যে আছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আছে গার্মেন্টশিল্প, আছে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহ, ব্যাংক-বীমা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি।
ব্যাংকগুলো তাদের কেন্দ্রিকতার মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্যের সকল সুযোগ-সুবিধা ঢাকাকেন্দ্রিক করে গড়ে তুলেছে, ফলে দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতেও ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম খুবই সীমিত, যে কারণে পূর্ণাঙ্গ ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ কম। দেশের রাজশাহী শহরের মতো শহরেও সরকারি এবং বেসরকারি ব্যাংকগুলোর আমদানি-রপ্তানির তেমন কোনো সুযোগ নেই।
ঢাকা বিভাগের চতুর্দিকের রাস্তাগুলোকে জনগোষ্ঠী যেভাবে আঁকড়ে ধরেছে তাতে গোটা শহর মৃত্যুপুরীতে রূপান্তরিত হচ্ছে। এতে দ্রুতবেগে প্রতিটি মানুষের কর্মঘন্টা নেমে এসেছে ৪ থেকে ৫ ঘন্টায়। দিনে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা সবাইকে কর্মস্থলে যাতায়াতের কাজেই ব্যয় করতে হয়। ফলে এর প্রভাব পড়ছে দেশের সামগ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায়। প্রায় সকল প্রতিষ্ঠানই বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হারাচ্ছে। আমাদের গার্মেন্টশিল্প, সরকারি ও আধা সরকারি ব্যাংক, বীমার কিছু অংশ যদি দেশের পশ্চিম ও দক্ষিণ অঞ্চলে নিয়ে যাওয়া যায়, তাহলে ঢাকা শহরের জনজীবন খানিকটা হলেও স্বাভাবিক হয়ে আসবে। এর জন্য প্রয়োজন কঠিন সিদ্ধান্ত।
চীনের উন্নয়নে সাংহাই যখন খুব গুরুত্বপূর্ণ শহর হয়ে উঠেছিল, তখন চীন সরকার সাংহাইতে কর্মসংস্থান না থাকলে সেখানে স্থায়ী বাসস্থান পাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় দেশে ১০৩ টি। এদের অনুমতি পত্রের সঙ্গে নিজস্ব ক্যাম্পাস থাকার শর্ত থাকলেও নিজস্ব ক্যাম্পাসের অভাবে ঢাকা শহরের আনাচে-কানাচে এই প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে উঠেছে। তাদেরকে অবশ্যই ঢাকা থেকে দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের শহরগুলোতে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।
খুলনা এক সময়কার শিল্প নগরী ছিল। আজ খুলনার নাম তেমন শোনা যায়না। খুলনা আর তার শিল্পনগরীর পরিচয় ধরে রাখেনি। কিন্তু পদ্মা সেতু আমাদেরকে ব্যাপকভাবে সে সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে বলে মনে করি।
সরকারের কিছু অর্থনৈতিক সুবিধাসহযোগে ঢাকা থেকে শিল্প কারখানা দ্রুতই স্থানান্তরিত হবে, এই আশা এখন।
চীনের উদাহরণ গ্রহণ করা যেতে পারে প্রধান বন্দর থেকে দূরবর্তী শহরে কিংবা অঞ্চলে অবস্থিত শিল্প কারখানার ক্ষেত্রে। বৈদেশিক মুদ্রা ও চীনের মুদ্রা লেনদেনের হার ভিন্ন ভিন্ন ধার্য করা হয়েছিল।
খুলনা অঞ্চলের প্রাকৃতিক গ্যাসের একটি সংকট আছে। তারপরেও প্রাকৃতিক গ্যাস ছাড়াও বিদ্যুৎ সঞ্চালনের ক্ষেত্রে এখন সারাদেশ প্রায় সমভাবে যোগ্যতা অর্জন করেছে । সেই কারণে সরকার যদি চায় তাহলে দেশের শিল্প কারখানাসমূহকে সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। এর বাইরে আছে সরকারি প্রতিষ্ঠান, আধা সরকারি প্রতিষ্ঠান- প্রায় সকল প্রতিষ্ঠান ঢাকাকেন্দ্রিক করা হয়েছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি শক্ত হাতে বিষয়গুলোকে যদি পর্যালোচনা করেন, তাহলে আগামী দিন ঢাকায় একটি মৃত শহর হওয়া থেকে বেঁচে যায়। এই শহরের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, এই শহরের প্রধান সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকাকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থাকে অবশ্যই বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে, যেন ঢাকার জনবসতি নিজের থেকেই কমে যায়। সকল প্রতিষ্ঠানের চাকরির ইন্টারভিউ ঢাকাকেন্দ্রিক। চাকরির সন্ধানে ঢাকায় অবস্থানের সংখ্যাও তাই ব্যাপক। সবকিছু মিলিয়ে পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে সরকারকে বিকেন্দ্রীকরণের বিষয়টিকে শক্ত হাতে ভাবতে হবে।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক