‘শুধুমাত্র বিরোধীদের ক্ষেত্রেই বিজেপির দুর্নীতিতে শূন্য সহনশীলতার নীতি’
সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেসের জ্যেষ্ঠ নেতা পার্থ চ্যাটার্জির ঘনিষ্ঠ সহযোগীর বাড়ি থেকে উদ্ধার হয়েছে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থের স্তূপ। এই ঘটনায় আঁতকে উঠেছে পুরো ভারতবাসী, আর দলটি হয়েছে বিব্রত। দলের প্রভাবশালী এ রাজনীতিককে তার মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিতে বাধ্য হয়েছেন মমতা ব্যানার্জি। দলের সকল পদ থেকেও পার্থকে বহিষ্কার করেছেন। আইন অনুসারে, এ হীন অন্যায়ে জড়িত সকলেরই শাস্তি হওয়া উচিত।
তবে ভারতের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সর্বব্যাপী যে অসাধু চর্চা–এই অর্থ উদ্ধারকে সে হিমশৈলের চূড়ামাত্র বলা ভুল হবে না। এতে জড়িত হয়েছে, বিপুল পরিমাণ হিসাব বহির্ভূত অর্থের লেনদেন। আর তা সব রাজনৈতিক দলেরই জ্ঞাত। তবে বিজেপি সরকারের রয়েছে রাজনৈতিক বিরোধীদের দুর্নীতির বিষয়ে 'জিরো টলারেন্স' বা শূন্য সহনশীলতার নীতি। তাই বলে, বিজেপির সদস্যদের মধ্যে কিন্তু অপরাধীদের অন্তর্ভুক্তি রয়েছে। যারা বিজেপিতে যোগ দেওয়ার 'সঠিক' সিদ্ধান্ত নেয়– তাদেরকেও নৈতিক ছাড় দেওয়ার নজির রয়েছে।
বাস্তব ঘটনাপ্রবাহই সেদিকটি স্পষ্ট করে। যেমন ২০১৪ সালের পর থেকে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলো ৬০৯ জন বিরোধীদলীয় রাজনীতিক, তাদের পরিবারের সদস্য ও সরকারের সমালোচকদের টার্গেট করেছে। এরমধ্যে মাত্র ৩৯ জন ছিলেন বিজেপির, আর বাকীরা সকলেই তাদের রাজনীতির বিরোধী। কংগ্রস নেতৃত্বাধীন সাবেক ইউপিএ জোট সরকারের চেয়ে বিরোধীদের এই দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের লক্ষ্যবস্তু করার ঘটনা বিজেপির শাসনামলে বেড়েছে ৩৪০ শতাংশ।
এতে যেন একটি বিষয় অবধারিতভাবে প্রমাণ করার চেষ্টা হচ্ছে, তা হলো– সব দুর্নীতি করছে বিজেপির বিরোধীরা, সে তুলনায় বিজেপি যেন 'ধোয়া তুলসী পাতা'।
২০২২ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলি সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ যাদবের সহযোগীদের বিরুদ্ধে ঝটিকা অভিযান পরিচালনা করেছে। ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনের আগে তৃণমূল কংগ্রেসের ১৪ নেতা, তাদের সহযোগী ও আত্মীয়দের অভিযানের লক্ষ্যবস্তু করা হয়। একই বছর অনুষ্ঠিত তামিলনাড়ুর বিধানসভা নির্বাচনের ভোটগ্রহণের মাত্র চার দিন আগে ডিএমকে দলের আট সদস্যের বিরুদ্ধে তদন্ত করা হয়। এদের মধ্যে ছিলেন, দলটির প্রধান এমকে স্ট্যালিনের ছেলে এবং তার জামাতাও।
কাকতালীয়ভাবে! এই সব দলই তাদের নিজ নিজ রাজ্যে বিজেপির প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিজেপির ক্রুসেড থেকে কেউই ছাড় পায় না। ২০১৯ সালে ভারতের একজন দায়িত্বরত নির্বাচন কমিশনার অশোক লাভাসার স্ত্রী, সন্তান ও কন্যার বিরুদ্ধে করফাঁকির তদন্ত করা হয়। ২০১৯ সালের নির্বাচনে বিজেপি নেতাদের ছাড়পত্র দেওয়া নিয়ে বিরোধী মত পোষণ করেন লাভাসা। তাহলে হয়তো দুর্নীতির তদন্তও ছিল কাকতালীয়! শেষপর্যন্ত লাভাসাকে পরবর্তীতে পদত্যাগ করতে হয়েছে। তিনি ম্যানিলায় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)-র নিরাপদ চাকরিতে চলে গেছনে।
বিরোধীদের দাবি অনুযায়ী, বিজেপি সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলির তদন্তের উদ্যোগ খুবই বেছে বেছে করা হয়। ২০১৯ সালে যেমন জালিয়ারি ও ভূমি কেলেঙ্কারির গুরুতর অভিযোগ তোলা হয় বিএস ইয়াদুরাপ্পার বিরুদ্ধে। এরপরও তিনি কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু, তদন্তকারীদের দাবি, তার কাছ থেকে উদ্ধার করা ডায়েরিতে স্থানীয় বিজেপি নেতা, বিচারক ও আইনজীবীদের বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়ে হাত করার উল্লেখ আছে।
আদালত ও আইনের বিরুদ্ধেও এভাবে দুর্নীতির ইঙ্গিত কেন দেওয়া হয়। চাপের মুখে কর্ণাটকের হাইকোর্ট ইয়াদুরাপ্পার বিরুদ্ধে আনীত অপরাধের অভিযোগগুলি নাকচ করতে অস্বীকার করেন। তবে সম্প্রতি এগুলি স্থগিত রাখার আদেশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট।
২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসে বিজেপি, ওই বছরের সেপ্টেম্বরে সারদা কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকায়
২০১৪ সালে সারদা কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকায় সিবিআই জেরা করেছিল আরেক রাজনীতিক শুভেন্দু অধিকারীকে। ২০১৭ সালেও তাকে জেরা করে আরেকটি সংস্থা। তখন তিনি ছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা। ২০২০ সালে তিনি বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর থেকেই আর তাকে জেরার মুখে পড়তে হয়নি। এখন এই শুভেন্দুই পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভায় বিরোধী শিবির তথা বিজেপির নেতা।
আসামের গোয়াহাটিতে পানি সরবরাহ কেলেঙ্কারিতে মূল অভিযুক্ত হচ্ছেন হেমন্ত বিশ্বাস শর্মা, নিজস্ব প্রচারণায় এমন অভিযোগ করে বিজেপি। এমনকী এই অভিযোগের বিস্তারিত তুলে ধরে বুকলেটও ছাপায়। অভিযোগ করা হয়, প্রকল্পটির কাজ পেতে আমেরিকান একটি ব্যবস্থাপক কোম্পানির থেকে তিনি ঘুষ নিয়েছেন। এমনকী মার্কিন বিচার বিভাগের বৈদেশিক দুর্নীতি নিরোধ আইন- ফরেন করাপ্ট প্রাক্টিসেস অ্যাক্টের আওতায় আসামের অজ্ঞাত একজন মন্ত্রীকে ঘুষ প্রদানের দায়ে অভিযোগ রয়েছে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে। এতকিছুর পরও যেই মাত্র হেমন্ত শর্মা বিজেপিতে যোগ দিলেন—তখনই মামলাটির ভার সিবিআই'কে দেওয়ার আগের দাবি থেকে সরে আসে বিজেপি। বর্তমানে হেমন্ত শর্মাই হলেন আসামে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী।
এমন উদাহরণ আছে ভূরি ভূরি; মহারাষ্ট্রের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী নারায়ণ রানের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ ছিল–অথচ তিনি বিজেপিতে যোগ দেওয়া মাত্র তাকে রাজ্যসভায় দলের এমপি বানানো হয়। তার বিরুদ্ধে থাকা একাধিক অর্থপাচার ও ভূমি দুর্নীতির মামলার কী হাল–তা অন্তত জনপরিসরে কেউই জানে না।
এরই বিপরীতে, কপাল পুড়ছে বিজেপি-ত্যাগীদের। যেমন উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের মন্ত্রিসভা ছেড়ে ২০২২ সালে সমাজবাদী দলে যোগ দেন স্বামী প্রসাদ মৌর্য। তার বিরুদ্ধে রাজ্যের স্পেশাল টাস্ক ফোর্সে নিয়োগ কেলেঙ্কারির অভিযোগ তোলা হয়েছে। কেন্দ্রীয় তদন্তকারীদের রাডারেও রয়েছেন তিনি।
ভারতের নির্দলীয় গণতান্ত্রিক সংস্কারপন্থী একটি সংস্থা– অ্যাসোসিয়েশন অব ডেমোক্রেটিক রিফর্মের মতে, ২০১৯ সালের জুলাইয়ে রদবদল হওয়া মোদির মন্ত্রিপরিষদে যে ৭৮ জন মন্ত্রি ছিলেন–তার মধ্যে ৩৪ জনের বিরুদ্ধে অপরাধমূলক মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ২৫ শতাংশ আবার হত্যা, হত্যাচেষ্টা ও ডাকাতির মতো গুরুতর অপরাধের মামলা।
যেমন তামিলনাড়ুতে বিজেপির সাবেক দলীয় প্রধান এবং বর্তমানে মৎস সম্পদ ও পশুপালন বিষয়ক কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী এল মুরুগানের বিরুদ্ধে ২১টি ক্রিমিনাল কেস রয়েছে। হত্যা ও ডাকাতিসহ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নিশিথ প্রামাণিকের বিরুদ্ধে রয়েছে ১৩টি। সংখ্যালঘু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জন বারলার বিরুদ্ধে অপরাধ মামলা ৯টি। অর্থ প্রতিমন্ত্রী প্রতিমন্ত্রী পঙ্কজ চৌধুরীর বিরুদ্ধে রয়েছে পাঁচটি। এই তালিকাটি আরও দীর্ঘ।
আশা করছি, আমাদের স্বাধীন (!) পুলিশ বাহিনী ও তদন্তকারী সংস্থাগুলি প্রথমে সরকারের বিরোধীদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা রয়েছে- সেই অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিষ্পত্তির পর– আলোচিত মামলাগুলোর দিকেও নজর দেওয়ার সুযোগ পাবে।
- লেখক: পবন কে শর্মা একজন লেখক, কূটনীতিক এবং ভারতের পার্লামেন্ট রাজ্যসভার সাবেক সদস্য
- সূত্র: এনডিটিভিতে প্রকাশিত ১ আগস্টের মতামত নিবন্ধ থেকে সংক্ষেপিত