রাশিয়ার আতঙ্কিত প্রতিবেশীরা আমেরিকার কাছে অস্ত্র ভিক্ষা চাইছে!
পশ্চিমা দুনিয়ার সাহায্য-সহায়তায় রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারছে ইউক্রেন। লড়াই দীর্ঘায়িত হওয়ায় উভয়পক্ষেই বাড়ছে ক্ষয়ক্ষতি। ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হচ্ছে মস্কোয়।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন পশ্চিমাদের কিয়েভকে সামরিক সহায়তা না দেওয়ার হুঁশিয়ারিও দিয়েছিলেন। কিন্তু, তাতে কেউই কর্ণপাত করেনি। এমনকী সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ বা প্রভাব বলয়ে থাকা পূর্ব ইউরোপের ছোট দেশগুলিও ইউক্রেনকে নানানভাবে সাহায্য করছে।
এই প্রেক্ষাপটে, মস্কো ইউক্রেনের নিকট প্রতিবেশীদের আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে– বাড়ছে সে ঝুঁকি। আক্রান্ত হওয়ার ভীতি থেকেই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদারে সর্বাত্মক চেষ্টা শুরু করেছে লাটভিয়া, পোল্যান্ডসহ পূর্ব ইউরোপের দেশগুলি।
ইতোমধ্যেই আমেরিকা (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) এবং ন্যাটো জোট- পূর্ব ইউরোপে সেনা ও সামরিক সরঞ্জাম মোতায়েন বাড়িয়েছে। তবুও আক্রমণের ঝুঁকিতে থাকা লাটভিয়ার মতো দেশ একে যথেষ্ট মনে করতে পারছে না। ন্যাটোর কাছ থেকে আরও সেনা মোতায়েন চায় তারা। চায় অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্র ও অব্যাহত প্রশিক্ষণ।
ইউক্রেনের প্রতিবেশীদের কেউ কেউ ন্যাটো জোটের সদস্য নয়, তবে ঘনিষ্ঠ সহযোগী। ন্যাটোর সাথে রাশিয়ার সংঘাত বাঁধলে তা পরমাণু যুদ্ধে রূপ নিতে পারে, মস্কো যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ না চায়, কিন্তু একইসঙ্গে ন্যাটোকে চরম পরিণতি স্মরণ করিয়ে দিতে চায়; তাহলে অবশ্যই আক্রমণ করতে পারে ন্যাটো জোটের বাইরের সহযোগী কোনো দেশে। তাই এসব দেশেও সামরিকায়ন আরও গুরুত্ব পাচ্ছে।
ন্যাটো সদস্য হয়েও উদ্বেগে আছে লাটভিয়া। প্রতিবেশীদের নিয়েও চিন্তিত। সম্প্রতি ন্যাটোর সহযোগী দেশগুলিকে সামরিক সহায়তা দেওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন লাটভিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী আর্তিস পাব্রিকিস। চলতি মাসে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিনের লাটভিয়া সফরকালে তিনি এ মন্তব্য করেন। পাব্রিকিস বলেছেন, 'যুদ্ধ আমাদের সীমান্তে আসতে পারে'– এমন ঝুঁকি এখন বহুগুণে বেড়েছে।
মিত্রদের উদ্বেগ নিরসনে- যৌথ সামরিক মহড়ার সংখ্যা বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে আমেরিকার বাইডেন প্রশাসন। পূর্ব ইউরোপের মিত্রদের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করার পাশাপাশি সৈন্যদের যুদ্ধ দক্ষতা বাড়ানোই এসব মহড়ার লক্ষ্য।
ইউরোপ মহাদেশে বর্তমানে প্রায় এক লাখ মার্কিন সেনা মোতায়েন রয়েছে। বিগত কয়েক মাসে যা বেড়েছে ২০ হাজার জন। সেনা বৃদ্ধিতে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে পূর্ব ইউরোপকে। তারপরও রাশিয়ার হাতের নাগালে থাকা পূর্ব ইউরোপের দেশগুলি নিশ্চিন্ত হতে পারছে না।
আমেরিকা ও ইউরোপের ধনী দেশগুলি রাশিয়াকে তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি মনে করেছে। এই মনোভাব নিয়ে সন্তুষ্ট রাশিয়া ও বেলারুশের প্রতিবেশী ন্যাটো সদস্যরা।
এজন্য বিগত কয়েক মাসে তাদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে আমেরিকা যে বিনিয়োগ করেছে–তাকে কৃতজ্ঞ চিত্তেই গ্রহণ করে। যদিও এই অঞ্চলের নেতারা মনে করেন, দীর্ঘমেয়াদে ন্যাটো জোটকে আরও আগ্রাসী হতেই হবে।
আমেরিকা চীনকে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে। এজন্য এশিয়ায় সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করছে। এই মুহূর্তে তাই ইউরোপে শক্তিবৃদ্ধির বিপক্ষে মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদ বা কংগ্রেসের অনেক সদস্য। কিন্তু, পূর্ব ইউরোপীয় নেতারা বলছেন, মস্কোর ভবিষ্যৎ আগ্রাসন ঠেকাতে হলে এই অঞ্চলে আমেরিকান উপস্থিতি বাড়াতেই হবে।
বাল্টিক ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলির কর্মকর্তারা বলছেন, মার্কিন প্রতিরক্ষা কোম্পানিগুলোর কাছে তারা গুরুত্বপূর্ণ অনেক অস্ত্রের অর্ডার দিয়েছেন, যা দীর্ঘদিন ধরে ডেলিভারি হচ্ছে। রাশিয়ার সাথে সংঘাতের ঝুঁকিতে সম্মুখসারিতে থাকা দেশগুলির জন্য এই ডেলিভারি প্রক্রিয়াকে আরও গতিশীল করতে হবে।
সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে এস্তোনীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী কুস্তি সাল্ম বলেন, 'হাইমার্স, রিপার এবং কাউন্টার ব্যাটারি রেডারের মতো সরঞ্জাম এই মুহূর্তে আমাদের সবচেয়ে বেশি দরকার। রাশিয়াকে ঠেকাতে হলে মারাত্মক এসব সক্ষমতা অর্জনের কোনো বিকল্প নেই'।
হাইমার্স বলতে তিনি বুঝিয়েছেন, আমেরিকার তৈরি হাই-মোবিলিটি আর্টিলারি রকেট সিস্টেমসকে। আর রিপার হচ্ছে শত্রুর ওপর নজরদারি ও নির্ভুল হামলায় সক্ষম ড্রোন। আর কাউন্টার ব্যাটারি রেডার হচ্ছে, শত্রুর গোলন্দাজ ইউনিটের অবস্থান শনাক্তের প্রযুক্তি।
সাল্ম বলেন, 'আমরা (যুদ্ধের) ঝুঁকির দ্বারপ্রান্তে। আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা বিপন্ন, কারণ আমাদের রিজার্ভে হাত দিতে হচ্ছে। আমাদের প্রতিবেশী অন্যান্য মিত্র দেশকেও একই কাজ করতে হচ্ছে। এই অবস্থায় একমাত্র সমাধান অস্ত্র উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো। সরকারি ও আর্থিক নীতি যেন এই প্রচেষ্টাকে সমর্থন দেয়- তা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে'।
সাল্ম মার্কিন সরকারের প্রতি এমন নীতি সমর্থন বাড়ানোরই আহ্বান জানিয়েছেন।
চলতি বছরের শুরুতে ইউক্রেনকে যুদ্ধ সহায়তা দিচ্ছে এমন বিদেশি রাষ্ট্রগুলির জন্য শত শত মিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তার অনুমোদন দেয় মার্কিন কংগ্রস। ৪ হাজার কোটি ডলারের এ প্যাকেজের আওতায় ইউক্রেনের পাশাপাশি ছিল সম্মুখসারির ন্যাটো রাষ্ট্রগুলো।
এসব রাষ্ট্রের কাছে থাকা সোভিয়েত আমলের অস্ত্রকে ন্যাটো মানদণ্ডের পশ্চিমা অস্ত্র দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে বলা হয়। বিনিময়ে এই দেশগুলি তাদের সোভিয়েত যুগের অস্ত্র ইউক্রেনকে দেবে– এই শর্ত ছিল। এরমধ্যেই সোভিয়েত অস্ত্রের পাশাপাশি নিজেদের রিজার্ভ থেকে ন্যাটো স্ট্যান্ডার্ডের অস্ত্রও ইউক্রেনকে দিয়েছে এসব দেশ। আর তাতেই তৈরি হয়েছে সক্ষমতায় ঘাটতি।
জ্যেষ্ঠ একজন মার্কিন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে দ্য ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেন, ইউক্রেনে হামলার জন্য লাটভিয়ার সীমান্ত থেকে অনেক রুশ সেনাকে ওই সময় সরিয়ে নেয় ক্রেমলিন। তখন কিয়েভকে নিজস্ব রিজার্ভের অস্ত্র দিতে স্বাচ্ছন্দ্যই বোধ করেছে লাটভিয়া। কিন্তু, যুদ্ধ শুরুর পর ন্যাটো সদস্য দেশের প্রতি রাশিয়ার যুদ্ধংদেহী মনোভাব আরও বেড়েছে। তাই এক পর্যায়ে সহায়তাকারী দেশগুলিকে তাদের নিজস্ব প্রতিরক্ষা সক্ষমতার ঘাটতি মেটানোর চেষ্টা করতেই হতো।
এই ঘাটতি পূরণে কতোটা সময় লাগবে উল্লেখ করেননি তিনি। তবে জানিয়েছেন, বাল্টিক দেশগুলোর সাথে প্রশিক্ষণ শিবিরসহ অন্যান্য সামরিক অবকাঠামো নির্মাণের উদ্যোগ নিচ্ছে আমেরিকা। এই অঞ্চলের জন্য চলতি বছর মার্কিন সরকারের দেওয়া সমর সহায়তা ১৮০ মিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন।
এদিকে এক সাক্ষাৎকারে যুক্তরাষ্ট্রে পোলান্ডের প্রতিরক্ষা অ্যাটাশে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ক্রিজিস্তফ নোলবার্ট বলেছেন, 'ইউক্রেন যুদ্ধে জয় ইউরোপের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য একান্ত আবশ্যক'।
ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর তৃতীয় বৃহত্তম অস্ত্রদাতা পোল্যান্ড– একথা উল্লেখ করে তিনি জানান, তার দেশ নিয়মিতভাবে পশ্চিমা দেশগুলির প্রতি ইউক্রেনকে আরও সমর্থন দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে থাকে।
পাশাপাশি নিজস্ব প্রতিরক্ষা জোরদার করাও দরকার বলে মনে করেন পোলিশ কর্মকর্তারা। ওয়ারশ আমেরিকার সঙ্গে প্যাট্রিয়ট মিসাইল ব্যাটারি, হাইমার্স, এফ-১৬ জঙ্গিবিমানসহ অ্যাব্রামস ট্যাংক কেনার চুক্তি করেছে। চুক্তি অনুসারে, প্রতিশ্রুত অস্ত্রের ডেলিভারি দ্রুত করারও তাগিদ দিচ্ছে ওয়াশিংটনকে।
সম্প্রতি এনিয়ে বাইডেনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভ্যানের সাথে আলোচনা করেছেন তার পোলিশ প্রতিপক্ষ পাভেল সোলশ। তবে এই আলোচনার বিবরণ গোপন রাখা হয়েছে।
ওয়াশিংটন পোস্ট জানতে চাইলে, এনিয়ে তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারাও।
পোলিশ অ্যাটাশে নোলবার্ট বলেন, 'আমরা জানি তারা সর্বোচ্চ গতিতে কাজ করছেন। এটা জরুরি সংকটকাল। আমাদের এখনই (অস্ত্রের চালান) দরকার'।
- সূত্র: দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট