কে ছিল টার্গেট? পুতিনের মস্তিষ্কখ্যাত দুগিন? তদন্ত শুরু
শনিবার স্থানীয় সময় রাত ৯টা ৩৫ মিনিট। প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর একটি এলাকা। বিস্ফোরিত হয়েছিল একটি এসইউভি যান। বিস্ফোরণ এতই শক্তিশালী ছিল যে– গাড়িটির টুকরোগুলো এদিক-সেদিক ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনাস্থলের ছবি ও ভিডিওতে দেখা যায়, গাড়িতে আগুন ধরে গেছে।
আকস্মিক এই ঘটনায় যার মৃত্যু হয়েছে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রুশ জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে। নিহত হন রাজনৈতিক ধারাভাষ্যকার দারিয়া দুগিনা (২৯)। তিনি আবার রুশ দার্শনিক আলেক্সান্ডার দুগিনের মেয়ে। তার পিতাকে বলা হয় রাশিয়ার ইউক্রেন যুদ্ধের ভাবাদর্শিক রূপকার। একাধারে তাকে 'পুতিনের মস্তিষ্ক' কিংবা 'পুতিনের রাসপুতিন'-ও বলে পশ্চিমা গণমাধ্যম।
দেখা যাচ্ছে, বাবা ও মেয়ে কেউই কম গুরুত্বপূর্ণ নন। কিন্তু, সেদিন অনুষ্ঠান থেকে বেড়িয়ে দুগিন তার মেয়ের সাথেই ফিরতে চেয়েছিলেন; কিন্তু শেষমুহূর্তে তিনি অনুষ্ঠানে আরও কিছুক্ষণ থাকার সিদ্ধান্ত নিলে দারিয়া তার বাবার টয়োটা ল্যান্ড ক্রুইজার প্রাডো গাড়িটি নিয়ে বেরিয়ে যান। তখনই ঘটে বিস্ফোরণ।
জ্বলন্ত গাড়ির সামনে উদভ্রান্তের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে দুগিনকে।
এই ঘটনা গাড়ি বোমার পেতে রাখার মাধ্যমেই হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। রুশ পুলিশের প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাড়িতে তৈরি এক ধরনের বিস্ফোরক দিয়ে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হতে পারে। কিন্তু, বিস্ফোরণের আসল কারণ বা উদ্দেশ্য তদন্তকারীরা এখনও নিশ্চিত করেননি।
রুশ সরকার বেশ গুরুত্ব দিয়েই তদন্ত করছে এই হত্যাকাণ্ডের। অনুসন্ধানের ভার নিয়েছে খোদ জাতীয় তদন্ত কমিটি। এটি রাশিয়ার প্রধান ফেডারেল তদন্ত সংস্থা। বোঝাই যাচ্ছে, ক্রেমলিন মোটেও হালকা করে দেখছে না এই মর্মান্তিক ঘটনাকে।
তাছাড়া, দেশটি যখন ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত– ঠিক সেই মুহূর্তে শীর্ষস্থানীয় একজন রুশ নাগরিককে এভাবে হত্যা–রাশিয়ার নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর শামিল। এতে সাধারণ নাগরিকরাও নিরাপত্তার অভাব বোধ করবে।
তার চেয়েও বড় কথা, হামলার মূল লক্ষ্যবস্তু আলেক্সান্ডার দুগিনই হয়তো ছিলেন।
মস্কোর নিজস্ব তদন্ত সংস্থার মুখপাত্র ওলগা ভারাদিয়ে বলেছেন, ফরেনসিক টিম ও বোমা বিশেষজ্ঞরা ঘটনাস্থলে তদন্ত করছেন। তাদের সাথে রয়েছেন ফেডারেল সংস্থার বিশেষজ্ঞরা।
ইতোমধ্যেই, এই হামলার দায় অস্বীকার করেছে ইউক্রেন। উল্টো অভিযোগ করেছে, ইউক্রেনের আগামী ২৪ আগস্টের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে ব্যাপক হামলা চালানোর অজুহাত হিসেবে এই ঘটনা রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থাই ঘটিয়েছে।
একে হাস্যকর যুক্তি বলেছেন দিমিত্রি ব্যাবেচ। যিনি হলেন রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত গণমাধ্যম কোম্পানি ইনোসোমির বিশেষজ্ঞ। এই সংস্থাটি পশ্চিমা গণমাধ্যম পর্যবেক্ষণে জড়িত রুশ সরকারের হয়ে।
মস্কো থেকে আল জাজিরাকে দেওয়া ভার্চুয়াল সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, দুগিনই এই হামলার আসল টার্গেট ছিলেন কিনা–তা এই মুহূর্তে বলাটা বেশ কঠিন। তবে বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞ তাই মনে করছেন। তবে দারিয়া নিজেও কম ছিলেন না। রুশ জাতীয়তাবাদের প্রচারে তিনি তরুণ প্রজন্মের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু, ইউক্রেনীয়রা এ ঘটনা সম্পর্কে যা বলছে–তা সম্পূর্ণ অবাস্তব।
ব্যাবেচ আরও জানান, গত কয়েক বছরে রাশিয়ার অনেক গণ্যমান্য জাতীয়তাবাদী ব্যক্তিত্ব নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।
এর পেছনে পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলির হাত থাকতে পারে ইঙ্গিত দিয়ে তিনি বলেছেন, 'আমি মোটামুটি নিশ্চিত– যে পক্ষটি ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যেকার চলমান সংঘাতকে আরও ভয়াবহ পরিণতির দিকে উস্কে দিতে চায়– তারাই সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী'।
হত্যাকাণ্ডের পেছনে কিয়েভের হাত থাকার সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দিচ্ছে না ক্রেমলিন। রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বলেছেন, 'দারিয়া দুগিনাকে হত্যার পেছনে ইউক্রেনের নীলনকশা ছিল– বা দুগিনকে হত্যার চেষ্টা ছিল এটি–এমন প্রমাণ মিললে আমরা কিয়েভের সরকারের রাষ্ট্র-অনুমোদিত সন্ত্রাসবাদ নিয়ে তখন কথা বলব'।
ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদমির জেলেনস্কির সামরিক বাহিনীর প্রধানের একজন উপদেষ্টা মিখাইলো পোদোলিয়ক দেশটির একটি টেলিভিশন চ্যানেলে বলেছেন, 'নিশ্চয় তার (দারিয়ার) মৃত্যুর জন্য আমরা কোনোভাবেই দায়ী নই। আমরা রুশ ফেডারেশনের মতো কোনো দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র নই।'
ইউক্রেন যদি হামলার জন্য দায়ী না-ও হয়– তবু পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থার হাত থাকার বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
তাছাড়া ৬০ বছরের আলেক্সান্ডার দুগিন দীর্ঘদিন ধরেই রয়েছেন পশ্চিমাদের টার্গেটে। রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ২০১৫ সালে তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
ব্রিটিশ সরকারও দুগিনের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। তাছাড়া, প্রভাবশালী সব পশ্চিমা গণমাধ্যমে প্রায়শই দুগিনের তীব্র সমালোচনা করা হয়। ইউরেশিয়াজুড়ে রুশ সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারের ভাবাদর্শ প্রচারের জন্য তাকে একজন বিপজ্জনক বুদ্ধিজীবী বলে উল্লেখ করা হয়েছে তাদের অনেক প্রতিবেদনে।
তার মেয়ে দুগিনার ওপরও যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের নিষেধাজ্ঞা ছিল। তিনি তার বাবার চেয়েও জনপ্রিয় হয়ে উঠছিলেন বলে ব্যাবেচসহ আরও অনেক পর্যবেক্ষক জানিয়েছেন।
আসল ঘটনা যাই হোক–রাশিয়া বিষয়ক রাজনৈতিক পরামর্শক সংস্থা- আর. পলিটিক্সের প্রতিষ্ঠাতা তাতিয়ানা স্তানোভায়া বলেন, 'দুগিনার হত্যাকাণ্ড অবধারিতভাবে রাশিয়ান সমাজে উগ্রবাদের আরও বিস্তার ঘটাবে'।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ, আরটি, আল জাজিরা