ধনী দেশগুলি আগ্রাসীভাবে জ্বালানি কিনছে, অসন্তোষ দানা বাঁধছে দরিদ্র দেশে
ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে কঠিন এক শীতকালের দিকে এগিয়ে চলেছে ইউরোপ। কিন্তু, ইইউ দেশগুলির আছে আর্থিক শক্তি। জ্বালানি বাড়তি দামেও কিনতে পারছে তারা। সে তুলনায়- এই সামর্থ্যে দুর্বল, উন্নয়নশীল দেশের সরকারকে জনগণের অতি-দরকারি জ্বালানি সরবরাহেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। ডলারের মান শক্তিশালী হওয়ার পাশাপাশি জ্বালানির বাড়তি দাম রসদ দিচ্ছে মূল্যস্ফীতির আগুনকে, যা নিয়ন্ত্রণে অসহায়ত্ব বাড়ছে কর্তৃপক্ষের।
দক্ষিণ এশিয়া দিয়ে শুরু করা যাক দুর্ভোগের বর্ণনা: বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য দরকারি জ্বালানি কিনতে না পারায় পাকিস্তানে প্রচণ্ড গরমের সময়ে লোডশেডিং আর বিদ্যুৎ বিল বাড়াচ্ছে সরকার। জ্বালানি সাশ্রয়ে রাত ৮টার মধ্যে দোকানপাট বন্ধের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বাংলাদেশে। জনগণের ওপর চড়া বিদ্যুৎ বিলের চাপ কমাতে আবাসিক গ্রাহকদের মধ্যে ভর্তুকির আওতা প্রসারিত করেছে দুনিয়ার আরেকপ্রান্তের দেশ মেক্সিকো।
বিশ্ব পরিস্থিতির খুব নাজুক সময়ে এসেছে এই আঘাত। মহামারির আগে থেকেই উন্নত দেশগুলি ঝুঁকেছিল নবায়নযোগ্য উৎসের শক্তি উৎপাদনে। এসময় তারা উপেক্ষা করে জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদন বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ। কার্বন নিঃসরণ কমাতে, তারা স্বল্প আয়ের দেশগুলিকে কম দূষণকারী প্রাকৃতিক গ্যাস-ভিত্তিক জ্বালানি নির্ভরশীলতা তৈরির চাপ দেয়।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর, বিশ্ববাজারে গ্যাসের দাম বেড়েছে ১৫০ শতাংশ। ধনী দেশগুলি অনায়সে এই দামে কিনতে পারছে। স্বাভাবিকভাবেই এত দামে কেনার প্রতিযোগিতায় হারছে উন্নয়নশীল দেশ।
বহুজাতিক পরামর্শক কোম্পানি- এক্সেনশিওর- এর বৈশ্বিক জ্বালানি শিল্প শাখার প্রধান মুকসিত আশরাফ বলেন, 'উন্নত দেশের চেয়ে বেশি দর হেঁকে (জ্বালানির চালান) কেনার সুযোগ নেই অন্যদের। তৈরি হচ্ছে এর মারাত্মক অর্থনৈতিক পরিণতি; এতে দরিদ্র দেশগুলির জাতীয় ও অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ খাতে অর্থায়নের সামর্থ্য কমেছে'।
তিনি উল্লেখ করেন, উন্নয়নশীল প্রায় সকল দেশই কমবেশি পড়েছে এই দুর্ভোগে।
জ্বালানি ব্যবসায়ীরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্য থেকে গ্যাসের যে চালানগুলি পাকিস্তান বা ভারতের মতো দেশে আসতো– সেগুলি এখন যাচ্ছে ইউরোপে। কারণ সেখানে বিক্রির মুনাফাও বেশি। ইউরোপের গ্রাহকেরাও গ্যাসের চড়া দাম দিতে পারে।
প্রদীপের অন্ধকার দিক হিসেবে বলা যাক– বৈদেশিক মুদ্রা সংকটে দেউলিয়াত্তের শিকার শ্রীলঙ্কার কথা। সেখানে সাধারণ মানুষের কাছে সরকার রান্নার গ্যাসও দিতে পারছে না। যানবাহনের জ্বালানি তো দূরস্থান। এমনকী বাঁধাধরা সরবরাহকদের থেকেও জ্বালানি কিনতে 'কালো ঘাম' ছুটছে কলম্বোর কর্মকর্তাদের। গত আগস্টে বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম বাড়ার পর থেকে কোনো চালানই কেনেনি আর্জেন্টিনা।
আশরাফ জানান, উন্নয়নশীল দেশের জ্বালানি আমদানির বিল এখন তাদের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি'র ২ থেকে ৪ শতাংশে পৌঁছেছে। উউদীয়মান অর্থনীতির কিছু দেশের ক্ষেত্রে তা পৌঁছেছে ২৫ শতাংশে।
বিপদের ওপর বিপদ– মার্কিন ডলারের বিপরীতে তাদের মুদ্রার মান পতনের প্রবণতা। এতে জ্বালানি আমদানির খরচও বেড়েছে তাদের। আর মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, অধরাই রয়ে যাচ্ছে।
জনকল্যাণ মাথায় রেখে ভর্তুকি বাড়াচ্ছে লাতিন আমেরিকার অনেক দেশ, কমাচ্ছে জ্বালানি তেলের ওপর নির্ধারিত শুল্ক। মেক্সিকো চলতি বছরে এপর্যন্ত ২৫ বিলিয়ন ডলার তেল ও বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দিয়েছে। পানামায় জনতা প্রতিবাদে রাজপথে নেমে এলে বাধ্য হয়েই এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে হয়েছে সরকারকে।
আফ্রিকা মহাদেশের মোজাম্বিকে জ্বালানিতে ভর্তুকি দেওয়ার পদক্ষেপকে সমর্থনের ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্বব্যাংক। বুরুন্ডির গাড়ি চালকরা সরকার নির্ধারিত মূল্যের তিনগুণ বেশি দামে কালোবাজার থেকে কিনছেন তেল।
জ্বালানি ঘাটতি মেটাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর কাছ থেকে ৩০০ কোটি ডলার জরুরি সহায়তা চাইছেন ঘানার প্রেসিডেন্ট নানা আফুকু- আদো। বিক্ষোভ চলছে তার দেশেও।
গত দশকেও কয়লা ও গ্যাসের মতো জীবাশ্ম জ্বালানি ছিল দামে সস্তা আর সরবরাহ ছিল প্রচুর। এ থেকে লাভবান হয় উদীয়মান অর্থনীতিগুলো। অস্ট্রেলিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্র– বিশ্বব্যাপী এলএনজি সরবরাহের নিত্যনতুন উৎস সৃষ্টি হয় তখন। পণ্যটির শীর্ষ আমদানিকারক জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার এলএনজি ব্যবহার নতুন উচ্চতায় পৌঁছে। অন্যদিকে, ধনী দেশগুলি কয়লা বন্ধ করতে থাকায়–বাজারে পণ্যটির অতিরিক্ত যোগান সৃষ্টি হয়। দাম কমে নাটকীয় মাত্রায়। আমেরিকার মহাদেশীয় শিলাস্তর থেকে তেল উত্তোলনের বিপ্লব এসময় বাজারকে অপরিশোধিত জীবাশ্ম তেলের প্রাচুর্যে ভাসায়।
সেদিন আজ অতীতে পরিণত হয়েছে।
এমনকী স্থানীয় গ্রাহকদের জন্য পর্যাপ্ত এলএনজি চালান কিনতে ব্যর্থ হয়েছে ভারতের প্রাকৃতিক গ্যাস বিতরণকারী কোম্পানি- গেইল। সংকট এড়াতে পেট্রোকেমিক্যাল প্ল্যান্ট ও সার উৎপাদন কারখানার মতো প্রধান গ্যাস ব্যবহারকারীদের জন্য কমিয়েছে সরবরাহ।
এলএনজির বাড়তি দামের কারণে থাইল্যান্ডে চলতি সপ্তাহেই বিদ্যুৎ বিল বাড়ানো হয়েছে ১৭ শতাংশ।
গত দুই বছরে ১,৩০০ শতাংশ বেড়েছে এলএনজির দাম। এতে মাসের পর মাস ধরে নিয়মিত চালান কিনতে পারছে না বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মতো দেশ।
বাজার অংশীদারিত্বে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইস্পাত উৎপাদক- বিএসআরএম। বিদ্যুৎ সংকটের কারণে কোম্পানিটি তাদের উৎপাদন অন্তত ২০ শতাংশ কমিয়েছে বলে জানান কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমির আলীহোসেন।
তিনি বলেন, 'এই সংকট থেকে কেউই মুক্ত নয়'।
চলতি মাসের শুরুর দিকে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, 'দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের বিশাল মজুদ আবিষ্কৃত নাহলে–আমি কোনো (সংকট সমাধানের) প্রতিশ্রুতি দিতে পারব না'।
কিন্তু, সরকারি কর্মকর্তাদের প্রতিশ্রুতিতে আস্থা রাখার মতো ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গেছে অনেক উন্নয়নশীল দেশের জনতার।
পাকিস্তানে আন্দোলনকারীরা সড়ক অবরোধ করছেন। এমনই এক ঘটনায় পুলিশের দিকে পাথর ছুঁড়েছেন তারা। পরে নিরাপত্তা বাহিনী জলকামান ব্যবহার করে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে। পানামায় বিক্ষোভের মুখে অচল হয়ে পড়েছে মহাসড়ক ও সমুদ্র বন্দর।
সংকটের উত্তাল ঢেউ ছড়িয়ে পড়ছে দিকে দিকে
ইউনিভার্সিটি অব হিউস্টন ল' সেন্টারের সহকারী অধ্যাপক সুসান সাকমার বলেন, 'জ্বালানি সংকট যত দীর্ঘ সময় ধরে চলবে, ততোবেশি নাগরিক বিক্ষোভ দেখা দেবে পৃথিবীজুড়ে'।
তিনি ব্যাখ্যা করেন, জ্বালানি সংকটে উন্নত বিশ্বও ভুগছে। মস্কো সরবরাহ বন্ধ করলে, এই শীতের জন্য জার্মানির কাছে পর্যাপ্ত গ্যাসের মজুদ থাকবে না। ছয় বছর পর প্রথমবারের মতো অস্ট্রেলিয়া থেকে এলএনজি'র চালান কিনছে যুক্তরাজ্য। যুক্তরাষ্ট্রে জ্বালানি তেলের বাড়তি দাম– আসছে নভেম্বরের মধ্য-মেয়াদি নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ডেমোক্রেট দলের দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক ক্ষতি করতে পারে। এতকিছুর পরও এসব দেশের হাতে সমাধানের উপায় আছে, যা নেই দরিদ্র দেশগুলির।
উন্নয়নশীল দেশগুলি দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ করে এসেছে যে, উচ্চাকাঙ্ক্ষী জলবায়ু লক্ষ্যমাত্রা পূরণে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে আসার জন্য যে বিনিয়োগ তাদের দরকার– সে তুলনায় নগণ্য অর্থায়ন করছে উন্নত দেশগুলি। এই ব্যবধান এখন আরও বেড়েছে, আর তারা জ্বালানি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
মুকসিত আশরাফ বলেন, 'আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রাণকেন্দ্রেই রয়েছে জ্বালানি। এর সংকট এমন উত্তাল ঢেউ সৃষ্টি করে, যার প্রভাব কমবেশি সর্বত্র ছড়ায়।
বর্তমান পরিস্থিতি উন্নয়নশীল দেশগুলোর নীতিনির্ধারকদের মনে, জ্বালানি বাজার সম্পূর্ণ স্থিতিশীল হওয়ার আগপর্যন্ত প্রচলিত উৎস থেকে সরে আসার পদক্ষেপের বিষয়ে সংশয়ের জন্ম দিবে'।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ