বিশ্ববাজারে গ্যাসের দামে আগুন কেন?
গত এক দশকে ইউরোপে গড়ে যে দামে গ্যাস পাওয়া যেত এখন সেই গ্যাস বিক্রি হচ্ছে তারচেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি দামে।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাজ্যের গ্যাস বেচাকেনা হচ্ছিল ৩৮পি পার থার্মে (গ্যাস খরচের একটি পরিমাপ)। আর চলতি মাসে সেই দাম পৌঁছেছে ৫৩৭পি পার থার্মে। প্রশ্ন হচ্ছে, গ্যাসের মূল্য এভাবে পাগলা ঘোড়ার মতো লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে কেন?
গত এক বছরে কী হয়েছে?
কোভিড লকডাউন প্রত্যাহার করায় এবং অর্থনীতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার কারণে বিশ্বজুড়ে জ্বালানির দাম দ্রুত বেড়েছে।
শিল্প ও অবকাশ যাপনের মতো অনেক কর্মক্ষেত্রেই হুট করে একসঙ্গে বাড়তি জ্বালানির প্রয়োজন পড়ে যায়। এর ফলে সরবরাহকারীদের ওপর অভূতপূর্ব চাপ তৈরি হয়।
রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালানোর পর এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে ফের দাম বেড়ে যায়।
আগে ইইউতে মোট ব্যবহৃত গ্যাসের ৪০ শতাংশ সরবরাহই আসত রাশিয়া থেকে। ইউরোপের সরকারগুলো রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানি কমানোর পথ খুঁজছিল। এর ফলে গ্যাসের বিকল্প উৎসের দাম বেড়েছে।
রুশ গ্যাসের ওপর নির্ভরতা কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ইইউ। জুলাই মাসে ইইউয়ের সদস্য দেশগুলো গ্যাসের ব্যবহার ১৫ শতাংশ কমাতে সম্মত হয়েছে।
জার্মানির উদাহরণ দেওয়া যাক। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে জার্মানি তার মোট গ্যাসের ৫৫ শতাংশই রাশিয়া থেকে আমদানি করত। এখন জার্মানির রুশ গ্যাস আমদানির পরিমাণ ৩৫ শতাংশে নেমে এসেছে। পাশাপাশি রাশিয়ার গ্যাস আমদানি সম্পূর্ণ বন্ধ করার জন্যও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েছে জার্মানি।
কিন্তু একদিকে যখন রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভরতা বন্ধ করার জন্য চাপে আছে, সেই মুহূর্তেই ইউরোপ আশঙ্কা করছে যে ইউক্রেনে সামরিক সহায়তা প্রদানের প্রতিশোধ হিসেবে রাশিয়া ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ আরও সীমিত—এমনকি এমনকি বন্ধও করে দিতে পারে।
এর সঙ্গে গোদের ওপর বিষফোঁড়া হিসেবে বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জ্বালানি সরবরাহকারী গ্যাজপ্রম। প্রতিষ্ঠানটি গ্যাসের মূল্য রুবলে প্রদান না করার জন্য বুলগেরিয়া, ফিনল্যান্ড, পোল্যান্ড, ডেনমার্ক ও নেদারল্যান্ডসে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে।
ইউরোপের দেশগুলো যেহেতু রাশিয়া থেকে গ্যাস কেনা বন্ধ করছে, তাই তাদের নিজেদের গ্যাস রপ্তানি ব্যাপক কমাতে হবে। এতে আন্তর্জাতিক সরবরাহের ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করবে।
পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহের বিপরীতে অনেক দেশই তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হচ্ছে। এলএনজি জাহাজে করে সারা বিশ্বে পরিবহন করা হয়।
আগের বছরগুলোতে ইউরোপের দেশগুলো সাধারণত গ্রীষ্মে কাতার ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলো থেকে চাহিদার অবশিষ্ট এলএনজির সরবরাহ কিনত। এই এলএনজি তারা মজুত করত আসন্ন শীতের জন্য।
কিন্তু এ বছর ইউরোপ এলএনজি কিনতে গিয়ে সমস্যায় পড়ে গেছে। কারণ এশিয়ার দেশগুলি ইতিমধ্যে বিশ্বের বেশিরভাগ এলএনজি কেনার জন্য দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি স্বাক্ষর করে রেখেছে। আর এই চুক্তি সই করে রাখা হয়েছে এলএনজি তোলার আগেই। এর ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজি পাওয়া যাচ্ছে খুবই কম।
কী কাজে ব্যবহার হয় গ্যাস?
সারা বিশ্বে সিংহভাগ গ্যাসই নিজ দেশে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু অনেক দেশেরই নিজের চাহিদা মেটানোর জন্য যথেষ্ট পরিমাণে নিজস্ব গ্যাস উৎপাদন নেই। সেজন্য ওই দেশগুলোকে আমদানি করে গ্যাসের চাহিদা মেটাতে হয়। বিশেষ করে শীতকালে এই দেশগুলোতে গ্যাস দরকার হয় বেশি।
আমদানি করা গ্যাস গন্তব্যে পৌঁছালে এটি কিছু জ্বালানি সরবরাহকারীর কাছে স্পট মূল্যে বিক্রি করা হয়। একটি নির্দিষ্ট স্থানে ও সময়ে জ্বালানির বর্তমান মূল্যই হলো স্পট মূল্য। আবার কিছু পরিমাণ গ্যাস ভবিষ্যৎ মূল্যে কেনা হয়। সামনের মাসগুলোতে গ্যাসের মূল্য কত হতে পারে, তার ওপর ভিত্তি করে ভবিষ্যৎ মূল্য নির্ধারণ করা হয়।
গ্যাসের একটি অংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্যও ব্যবহার করা হয়, যার অর্থ চড়া দামে গ্যাস কেনার বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচও বেড়ে যায়। ফলে বাড়ে আমাদের বিদ্যুৎ বিলও।
২০২১ সালে যুক্তরাজ্যের প্রায় ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে গ্যাস থেকে।
বাকি ৬০ শতাংশ গ্যাস ব্যবহৃত হয় বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গরম রাখতে এবং পানি গরম করতে কিংবা শীতের জন্য মজুত করা হয়।
গ্যাসের মূল্য নির্ধারণ করা হয় কীভাবে?
একেক দেশে একেকভাবে গ্যাসের মূল্য নির্ধারণ করা হয়। গ্যাসের কোনো অভিন্ন আন্তর্জাতিক মূল্য নেই।
পাইকারি গ্যাসের দাম নির্ধারণ করা হয় স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে গ্যাস কিনতে জ্বালানি সরবরাহকারীদের কত খরচ হয়, তার ভিত্তিতে। প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্য বৈশ্বিক চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাড়ে-কমে।
নানা জল্পনা-কল্পনা এবং আসন্ন ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কায় আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের দাম বেড়ে যেতে পারে। এর ফলে গৃহস্থালি ও ব্যবসার ক্ষেত্রেও বেড়ে যেতে পারে গ্যাসের দাম।
উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাজ্যে স্পট মূল্য হিসাব করা হয় ইউকে ন্যাশনাল ব্যালান্সিং পয়েন্ট (এনবিপি) ব্যবহার করে, যার ওপর ভিত্তি করে দেশটির জাতীয় সঞ্চালন সিস্টেমের যেকোনো জায়গায় গ্যাস সরবরাহ করা হয়।
এখন যেহেতু ইউরোপের দেশগুলো বিশ্বের অবিক্রীত এলএনজির অবশিষ্টাংশ কেনার জন্য বাজারে ঢুকেছে, তাই আমদানি আকর্ষণ করার জন্য এনবিপি বেশি হতে হবে।
যুক্তরাজ্যের একটি সাধারণ গৃহস্থালি গ্যাসের বিলের মধ্যে পাইকারি মূল্য, জ্বালানি সরবরাহকারীর পরিচালন ব্যয়, নেটওয়ার্ক রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় এবং ভ্যাট ও সবুজ শুল্কসহ ট্যাক্স অন্তর্ভুক্ত থাকে।
লাভ হচ্ছে কার?
চাহিদা বৃদ্ধির ফলে গ্যাস উত্তোলন ও পরিবহনকারী কোম্পানিগুলো ব্যাপক লাভবান হয়েছে।
বিশ্বের সিংহভাগ এলএনজি আসে অস্ট্রেলিয়া, কাতার ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে। নরওয়ে ও উত্তর সাগরেও কিছু গ্যাস উৎপাদন হয়।
চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে তেল কোম্পানি শেল বিশ্বব্যাপী ৯.৪ বিলিয়ন পাউন্ড মুনাফা করেছে বলে জানা গেছে। আর এই সময়ে ব্রিটিশ তেল ও গ্যাস কোম্পানি বিপি মুনাফা করেছে ৬.৯ বিলিয়ন পাউন্ড। ২০২১ সালের একই সময়ের তুলনায় তিনগুণ বেশি লাভ করেছে বিপি।
- সূত্র: বিবিসি