ইমরান খানের ভাষণ সম্প্রচারে নিষেধাজ্ঞা গণতন্ত্রের ওপর চরম আঘাত
পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) দলের বর্তমান চেয়ারম্যান ইমরান খানের বক্তব্য জনসম্মুখে সরাসরি সম্প্রচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে পাকিস্তানের ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া রেগুলেটরি কর্তৃপক্ষ। পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম ডন-এ প্রকাশিত সম্পাদকীয় অনুসারে, এই নিষেধাজ্ঞা পাকিস্তানে মত প্রকাশের স্বাধীনতার সাংবিধানিক অধিকারের ওপর আক্রমণ ছাড়া আর কিছুই নয়।
শুধু নিষেধাজ্ঞা দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি কর্তৃপক্ষ, সম্প্রতি ইউটিউবে তার লাইভ স্ট্রিমকেও ব্যাহত করা হয়েছে।
যদিও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান নিজের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, সমালোচক এবং সাংবাদিকদের অপবাদ এবং হুমকি দেওয়ার জন্য সুপরিচিত, এরপরেও তার বক্তব্য প্রচারিত হতে না দেওয়া বা সেন্সর করা তার মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন। সুতরাং অবিলম্বে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়া উচিত।
নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্তকে বৈধ করার চেষ্টায় ইলেকট্রনিক মিডিয়া কর্তৃপক্ষ ইমরান খানকে 'হেট স্পিচ' বা ঘৃণাত্মক বক্তব্য ছড়ানো এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, পুলিশ কর্মকর্তা এবং একজন অতিরিক্ত দায়রা বিচারকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তার করার হুমকির দেওয়ার অভিযোগ এনেছে।
পাকিস্তানের সংবিধানের ১৯ নং অনুচ্ছেদে বাকস্বাধীনতার অধিকার নিশ্চিত হয়েছে, সেইসঙ্গে এই অধিকারকে সীমিত করা যেতে পারে, এমন পরিস্থিতি সম্পর্কেও বলা হয়েছে। এই অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা দিয়েই দেশটির ইলেকট্রনিক মিডিয়া কর্তৃপক্ষ সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তবে এই নিষেধাজ্ঞা অনুচ্ছেদটির চেতনা পরিপন্থী।
যদিও পিটিআই নিজেদের শাসনামলে বিভিন্ন সময়ে ভিন্নমতকে দাবিয়ে রাখতে মূলধারার গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকেও নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করেছিল, তারপরেও ইমরানের ওপর এই নিষেধাজ্ঞা গ্রহণযোগ্য নয়। তাকে এভাবে শাস্তি দেওয়ার পরিবর্তে, মিডিয়া নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল চ্যানেলগুলোতে 'টাইম-ডিলে মেকানিজম' বা সময়-বিলম্বের পদ্ধতি ব্যবহার করে আক্রমণাত্মক বক্তব্য মুছে দেওয়া কিংবা বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে আদালতের হাতে ছেড়ে দেওয়া।
তিনি যদি বেআইনি কিছু বলে থাকেন বা রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা ও বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের হুমকি দিয়ে থাকেন, তাহলে দেশের আইন অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
ইমরান খানের চিফ অফ স্টাফ শাহবাজ গিলের বিতর্কিত মন্তব্য সম্প্রচারের পর বাতিল হয়ে যায় এআরওয়াই-এর লাইসেন্স। এর কয়েকদিন পরেই নিষেধাজ্ঞা আসলো সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ওপর।
সুপরিচিত কোনো রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে এমন নিষেধাজ্ঞার ঘটনা এটিই প্রথম নয়। এর আগেও আমরা দেখেছি, আদালতসহ অন্যান্য সরকারি কর্তৃপক্ষ ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়া রাজনীতিবিদদের টিভি পর্দা থেকেও সরিয়ে দিতে কীভাবে বহিষ্কারের আদেশ দেয়।
২০১৫ সালে আদালতের আদেশে মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা আলতাফ হোসেনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। ২০২০ সালে মিডিয়া কর্তৃপক্ষ চ্যানেলগুলোকে পলাতক এবং ঘোষিত অপরাধীদের বক্তৃতা, সাক্ষাত্কার এবং জনসাধারণের উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণ সম্প্রচারে বাধা দেয়। পাকিস্তান মুসলিম লীগ (এন) প্রধান নওয়াজ শরিফকে লক্ষ্য করেই দেওয়া হয়েছিল সে নির্দেশনা।
ভিন্নমতকে দমিয়ে রাখতে বিভিন্ন সরকার বিভিন্ন সময়ে মিডিয়া কর্তৃপক্ষকে ব্যবহার করেছে। এতে সাবেকদের প্রতি বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে এবং সেইসঙ্গে এটি টিভি চ্যানেলের নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করার পরিবর্তে, স্বাধীন রাজনৈতিক বক্তৃতার নিয়ন্ত্রণ কাজেই বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। রাজনৈতিক ভিন্নমত দমন করতে এভাবে আইনের ব্যবহার খারাপ একটি নীতি। এটি কখনই কাম্য নয়।
এসব নীতি ভিন্নমতকে দমিয়ে রাখার একটি কৌশল। বার বার এ ধরনের কৌশল অবলম্বন কখনোই কাজ করেনি। এটি কেবল গণতন্ত্রকে আঘাত করেছে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও বাকস্বাধীনতার অধিকারকে খর্ব করেছে।
- পাকিস্তানের সংবাদপত্র ডনের সম্পাদকীয় থেকে অনূদিত